স্বপন সেন, ফিচার রাইটার, হালিশহর:

সন 1941 , বহু পথ অতিক্রম করে বার্লিনে
পৌঁছেচেন নেতাজী , উদ্দেশ্য হিটলারের সাহায্যে  সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দেশের স্বাধীনতা লাভ । পরিকল্পনা করলেন আজাদ হিন্দ ফৌজ নামে এক এলিট বাহিনীর যারা জার্মান সেনার দ্বারা উচ্চ প্রশিক্ষণ পাবে, প্রতিটি সেনা লড়বে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে । লক্ষ্য হবে  একটাই ...স্বাধীনতা ! এর জন্য প্রয়োজন বাহিনীর মধ্যে একটা একাত্মতা গড়ে তোলা আর সেখানেই তিনি পড়ে গেলেন সমস্যায় ।
রয়্যাল আর্মির যেসব ভারতীয় সেনা জার্মান দের হাতে বন্দী হয়েছিল মূলত তাদের নিয়েই গঠন করা হয় INA . এরা শিখ বালুচ গোর্খা রাজপুত প্রভৃতি রেজিমেন্টের সেনা, কেউ সম্বোধন করে 'রাম রাম' কেউ 'সৎ শ্রীআকাল' কেউ আবার 'সালাম আলাইকুম কেউ বা নমস্তে', আর এটাই ছিল তাঁর নাপসন্দ ।
তিনি চাইলেন বিশেষ একটা শব্দ যেটা হবে সমগ্র বাহিনীর সাধারণ সম্বোধন এবং বহন  করবে তাদের পরিচিতিও । সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এলো জার্মান প্রবাসী এক ভারতীয় যুবক।

1919 সালে হায়দ্রাবাদে এক সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারে জন্ম নেয়া এই যুবক ছোট থেকেই ইংরেজ বিদ্বেষী । মা হাজিয়া বেগম গল্প শোনাতেন কিভাবে তারা এই দেশটা দখল করে সবকিছু লুটপাট করে নিচ্ছে । মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কয়েকবার সাবরমতী আশ্রমেও গেছিলেন । স্নাতক হবার পর বন্ধুরা যখন উচ্চ শিক্ষার জন্য ইংল্যান্ড গেল সে চলে এলো জার্মানিতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে । বছর দুয়েক থাকার পর হঠাৎই একদিন দেখলেন নেতাজীকে .. ঘুরে গেলো তার জীবনের মোড় ।
সেদিন নেতাজী  জার্মানির এক যুদ্ধ বন্দী  (Konigsbruck) শিবিরে ভারতীয় সেনাদের আজাদ হিন্দ বাহিনীতে যোগ দেবার আহ্বান জানাচ্ছিলেন ।শুনে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেল যুবকটি, সভা শেষে দেখা করলো তাঁর সাথে । নেতাজী তাকেও এই লড়াইয়ে সামিল হতে বললেন। ইঞ্জিনিয়ার হবার আশা জলাঞ্জলী দিয়ে পরদিনই সে যোগ দিল আজাদ হিন্দ ফৌজে ।
জার্মানি ভাষায় পারঙ্গম থাকায় নেতাজী তাকে নিজের সেক্রেটারি করে নিলেন । পরবর্তীতে এই যুবকই নেতাজির সমস্যার সুরাহা করেন, তারই উদ্ভাবন এই জয়হিন্দ ধ্বনি, যা হয়ে ওঠে আজাদী সেনার সম্বোধন ও রণহুঙ্কার । রাইন ও দানিয়ুব নদীর তীরে SS সেনার 'ডয়েচল্যান্ড উইবার আলস্' ধ্বনির পাশাপাশি শোনা যেতে লাগলো #জয়হিন্দ । নেতাজী তার সমস্ত বক্তৃতার শেষে এই ধ্বনি দিতেন এমনকি প্রথম স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লায় ত্রিবর্ণ পতাকা উত্তোলনের পর নেহেরুজীর কণ্ঠেও ছিল এই জয়হিন্দ ধ্বনি।

হায়দ্রাবাদী এই যুবকের পিতৃদত্ত নাম ছিল জয়নাল আবদিন হাসান কিন্ত জার্মানিতে উনি  আবিদ হাসান বলেই পরিচিত ছিলেন । পরের কাহিনী তো সকলের জানা, জার্মানি থেকে ঐতিহাসিক সাবমেরিন (U 180) যাত্রায় তিনিই ছিলেন নেতাজীর সফরসঙ্গী । টোকিওতে এসে নেতাজী যখন বাহিনীর সর্বাধিনায়কের পদে আসীন হন তখন আবিদ মেজর পদে নিয়োগ হন । নিজের ধর্মে বিশ্বাস রাখার সাথে সাথে তিনি ছিলেন অন্য ধর্মের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল । অস্থায়ী আজাদ হিন্দ সরকার গঠন হবার পর, পতাকার রঙ কি হবে এনিয়ে হিন্দু ও মুসলমান সেনাদের মধ্যে হলো মতভেদ । একদল চাইছিল পতাকার রঙ হোক গেরুয়া বা saffron, অন্যদল চাইলেন সবুজ । মতভেদ থেকে মনান্তর,  শেষে নেতাজীর হস্তক্ষেপে হিন্দুরা তাদের দাবী থেকে সরে এলো । এই সরে আসাকে সম্মান জানাতে সেদিন থেকে ঐ যুবক নিজের পরিচয় দিতে লাগলেন Abid Hassan Safrani।

1943 সালে নেতাজী আজাদ হিন্দ সরকারের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ঠিক করলেন  'জনগণমন' এর অনুকরণে একটা কিছু, তবে হিন্দীতে ।  আবিদকেই  দিলেন হিন্দি রূপান্তর করার ভার, সহকারী দিলেন মুমতাজ হুসেন ও জে আর ভোঁসলে কে । রাম সিং ঠাকুরির কম্পোজিশনে আবিদ রচনা করলেন এক অনবদ্য সঙ্গীত " সব সুখ চেইন"!

আগষ্ট 1945, যুদ্ধ শেষ । মিত্রশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করেছে জাপান । পরিকল্পনা হলো নেতাজী আবিদ হাসান সহ পাঁচ বিশ্বস্ত অনুচর কে নিয়ে সিঙ্গাপুর থেকে টোকিও উড়ে যাবেন ভায়া ব্যাঙ্কক সায়গন তাইপে ও মাঞ্চুরিয়া । কিন্ত সায়গনে পৌঁছে নেতাজী আবিদকে দায়িত্ব দিলেন কিছু অসমাপ্ত কাজ শেষ করে টোকিওতে তাঁর সাথে মিলিত হতে । শেষমেশ হবিবুর রহমান কে নিয়ে জাপানী মিৎসুবিশি Ki21 বোমারু বিমানে একাই সওয়ার হলেন নেতাজী।
তারপর ...... ......শেষটা তো আমরা সব্বাই জানি অথবা কেউই কিছু জানিনা!

1946 এ লালকেল্লার ঐতিহাসিক বিচারের পর আবিদ মুক্তি পান, ঘরে ফিরে যোগ দেন কংগ্রেস দলে । অচিরেই দলের আভ্যন্তরীণ চেহারা দেখে বীতশ্রদ্ধ হয়ে বেরিয়ে আসেন রাজনীতির আঙিনা থেকে । 1948 সালে Indian Foreign Service তৈরীর পর প্রথম ব্যাচের অফিসার হিসেবে যোগ দেন । 1969 এ অবসর নেবার সময় ইনি ছিলেন ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত ।
অনেকেই জানেন না আত্মীয়তার সম্পর্কে আবিদ হাসান ছিলেন নেতাজীর বেয়াই । তাঁর ভাইপো অরবিন্দ বোস বিয়ে করেছিলেন আবিদ হাসান সাফ্রাণী সাহেবের ভাইঝি সুরাইয়া হাসানকে।

1984 সালে পঁচাত্তর বছর বয়সে মহাপ্রস্থানের পথে যাত্রা করেন স্বাধীনতার এই স্বতন্ত্র সেনানী। জন্ম শতবর্ষে রইল আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।
জয়হিন্দ স্যার...


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours