কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

কলির লঙ্কাকান্ডের অবসান।
ধর্মের রং গুরুত্ব পেলো না।
পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনই শেষকথা বললো।
সেই সঙ্গে আরও একবার প্রমাণিত হলো, ভারত ধর্মনিরপেক্ষতার রাস্তাতেই চলছে, চলবে।
ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্যপ্রমাণের ওপর নির্ভর করেই, অযোধ্যার বিতর্কিত জমিতে রামমন্দির তৈরি করার ছাড়পত্র দিল দেশের শীর্ষ আদালত। তাঁর কর্মজীবন শেষ করার আগেই প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ চেয়েছিলেন, শতাব্দি পুরনো এই মামলার ইতি টানতে। শনিবার অযোধ্যার 'বহু বিতর্কিত রামমন্দির বাবরি মসজিদ মামলা'র রায় দিয়ে, তিনি দেশের আইনি ব্যবস্থার ওপর আদালতের দায়বদ্ধতার এক নজির তৈরি করলেন।

বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যাগ্র মেদিনী !
স্বীকার করুন, না করুন এমনই এক অবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়েছিল দেশের দুই মূল সম্প্রদায়। যতোই তারা তথ্যপ্রমাণের কথা বলুন না কেন গোটাটাই ছিলো মূলত ধর্মীয় আবেগ। আর এই আবেগের ফায়দা তুলতে কোনও সুযোগ হাতছাড়া করেনি রাজনৈতিক দলগুলিও। যাবতীয় আবেগকে উপেক্ষা করে শীর্ষ আদালত সরাসরি খারিজ করে দিলো নির্মোহি আখড়া আর সিয়া ওয়াকফ বোর্ডের যাবতীয় দাবিদাওয়া। শনিবার দেশের সর্বোচ্চ আদালতের পাঁচ বিচারপতি একমত হয়ে এই রায় ঘোষনা করেন। তার আগে শুক্রবার থেকেই নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে ফেলা হয়েছিল আদালত চত্বর। পূর্ব নির্ধারিত সময় মতোই শনিবার সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ শুরু হয় ঐতিহাসিক রায়দান।

এক বিশাল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখী দাঁড়িয়েছিল গোটা দেশ। অবশেষে সমাধান।
শুক্রবার থেকেই চলে সাজ সাজ রব। একেবারে যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি। টানটান উত্তেজনা। গোটা অযোধ্যার নিরাপত্তা বলয় ছিলো দেখার মতো। বিনা অনুমতিতে মশা মাছি ঢোকাও যেন নিষিদ্ধ। ঘুম উড়ে গেছিলো গোটা শহরের চোখ থেকে। গভীর রাতেও রাস্তাঘাটে মানুষজন। সবাই টগবগ করে ফুটছে উত্তেজনায়। আবার কারও কপালের ভাঁজ গোপন করার বিফল চেষ্টা। তবে সাধারণ মানুষের সবাই চাইছিলেন, সবকিছু ভালোয় ভালোয়, নির্বিঘ্নে মিটে যাক।
নিউজ চ্যানেলের লাইভ টেলিকাস্টের দৌলতে সব ঘটনা ঘরে বসেই দেখলেন দেশ, বিদেশের মানুষ। এমনকি গোটা সুপ্রিম কোর্ট চত্বরও চলে গেছিল কড়া নিরাপত্তার ব্যূহে। ঘটনাস্থল উত্তরপ্রদেশের প্রশাসনও তৈরি ছিল যেকোনও বিস্ফোরক পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য। যার ছাপ পড়েছিল পাশের রাজ্য দিল্লিতেও।
সিল করা হয়েছিলো উত্তরপ্রদেশ নেপাল সীমান্ত।

অযোধ্যার বিতর্কিত পরিকাঠামো কোন সম্প্রদায়ের? স্পষ্ট ভাষায় সেই প্রশ্নের জবাব দিলো শীর্ষ আদালত।
পাঁচ বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ সর্বসম্মতিক্রমে নির্দিষ্ট করে দিলো ২.৭৭ একর জমির হক রামলালার। আর সুন্নি বোর্ডের হাতে তুলে দিতে হবে পাঁচ একর জমি। আদালতের এই রায় খুশি করতে পারেনি সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে। বোর্ডের আইনজীবী জফরয়াব জিলানি বলেন, "আদালতের রায়কে সম্মান করি। তবে আদালতের কাছে সম্ভবত আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট হয়নি।  আমরা আদৌ জমির দাবি করিনি।" অতীতেও  শীর্ষ আদালতের রায় সংশোধন করার দৃষ্টান্ত আছে বলে জানান জিলানি। রায় সম্পূর্ণ ভাবে পড়ার পর পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করা হবে।

আদালতের নির্দেশে রামলালার জমিতে রামমন্দির তৈরির দায়িত্ব বর্তাবে এক ট্রাস্টের ওপর। আগামী তিন মাসের মধ্যে সেই ট্রাস্ট তৈরি করে দেবে সরকার।
কিসের ভিত্তিতে রামলালার এই হক প্রতিষ্ঠা করার আদেশ দিল শীর্ষ আদালত?
বিচারপতির বেঞ্চ জানায়, যে পরিকাঠামোকে বাবরি মসজিদ বলে দাবি করা হচ্ছে, তা আদৌ কোনও খালি, পড়ে থাকা জমিতে বানানো হয়নি। পুরাতত্ত্ব বিভাগের খনন কাজে প্রমাণ মিলেছে, মাটির নীচে অন্য এক পরিকাঠামোও ছিল। আর সেই পরিকাঠামোর স্থাপত্যকলাও ইসলামের রীতিনীতি মেনে আদৌ তৈরি হয়নি। তবে মন্দির ভেঙে মসজিদ তৈরির কোনও ঘটনা উঠে আসেনি পুরাতত্ত্বের পর্যবেক্ষণে।
প্রসঙ্গত রামমন্দির প্রবক্তারা শুরু থেকেই দাবি জানিয়ে আসছিলেন, মসজিদ ভেঙে মন্দির তৈরি করা হয়েছিল। ১৫২৮ সালে বাবর জমানায় ওই ঘটনা ঘটে। তথ্যপ্রমাণ ঘেঁটে আদালতও ওই ঘটনার কথা স্বীকার করে নেয়। জানানো হয়, ভারতের প্রথম মুঘল সম্রাট বাবরের আমলেই মির বাকি ওই মসজিদ বানায়।
ধর্মীয় ভাবাবেগকে প্রাধান্য না দিলেও আদালত জানিয়েছে, অযোধ্যাই যে রামের জন্মভূমি এই বিশ্বাস হিন্দুদের। তবে আদালতে বিবাদিপক্ষ এমন কোনও প্রমাণ পেশ করতে পারেনি, যা ওই বিশ্বাসের বিপক্ষে যায়।

প্রায় দুশো বছরের পুরনো মামলা।
রাম জন্মভূমি বাবরি মসজিদ মামলা প্রথম আদালতের মুখ দেখে ১৮৪২ সালে। তবে ফৈজাবাদ আদালত সেই মামলা ধর্তব্যের মধ্যে আনেনি। স্বাধীন ভারতে ওই ঘটনা ফের মাথাচাড়া দেয়। সাল ১৯৪৯। ওই বিতর্কিত পরিকাঠামোর মধ্যে রামসীতার মূর্তি রেখে চলে আসে কিছু উৎসাহীরা। পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে আদালত আদেশ দেয়, ওই জায়গায় কোনও ধর্মানুষ্ঠান করা যাবে না। তালা ঝোলে বিতর্কিত পরিকাঠামোয়। এরপরেই কোমর বেঁধে ময়দানে নেমে পড়ে দুই সম্প্রদায়। অযোধ্যার বিতর্কিত পরিকাঠামো নিয়ে ঝড় ওঠে দেশের সমাজ, রাজনীতিতে। দুই সম্প্রদায়ের একাধিক মামলা রজু হয় আদালতে। তারপর দীর্ঘকাল নিশ্চুপ।

সাঁয়ত্রিশ বছর পর ফের বাজারগরম। নতুন বোতলে ফিরে এলো পুরনো কাসুন্দি। বন্দিদশা থেকে রেহাই পেলো পরিকাঠামো। ফৈজাবাদ জেলা আদালতের রায়ে তালা খুলেছিলো বিতর্কিত পরিকাঠামোর। ১৯৮৬ সালে তৎকালীন রাজীব সরকারের অনুমতিতে হয়ে গেছিলো মন্দিরের শিলান্যাস। উত্তেজনার আরেক অধ্যায় শুরু।

রামমন্দিরের দাবিতে রথযাত্রার সূচনা করেন লালকৃষ্ণ আদবানি। ১৯৯০-৯১ সালের ওই ঘটনা নিয়ে ব্যাপক হল্লা বাঁধে। এর ঠিক একবছর পরেই ১৯৯২ সালে কার সেবকের হামলায় গুড়িয়ে গেল বিতর্কিত ওই পরিকাঠামোর চূড়ো। আবার মামলা। সেদিনের ওই ঘটনাকেও বেআইনি বলে মন্তব্য করেছে শীর্ষ আদালত।
২০১০ সাল। বিবাদে ঘেরা পরিকাঠামোর জমিকে তিন ভাগ করার আদেশ দিলো এলাহাবাদ হাইকোর্ট। নির্মোহি আখড়া, সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ড আর রামলালার হাতে তুলে দিতে হবে সেই জমি। আদালতের রায় পছন্দ হলো না আবেদনকারীদের। এবার সবাই দ্বারস্থ হলো শীর্ষ আদালতের। গোটা ঘটনায় শান্তি- শৃঙ্খলা অটুট রাখতে প্রথমেই ফরমান জারি করা হলো স্থিতাবস্থার।

ঘটনার জল ২০১৯ পর্যন্ত গড়াতেই তৎপর হলো সর্বোচ্চ আদালত। বহুকাল ধরে ঝুলে থাকা এই মামলার নিষ্পত্তি করতে টানা চল্লিশ দিন শুনানির নির্দেশ দেওয়া হলো। অগাস্টের ছ'তারিখে শুনানি শুরু হয়ে নাগাড়ে তা চললো অক্টোবর ষোল তারিখ পর্যন্ত। এর আগে আর একটিমাত্র মামলাতেই এরকম লাগাতার শুনানি চলেছিল।

প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিলেন, অবসরের আগে তিনি অযোধ্যার বিতর্কিত পরিকাঠামো মামলার শেষ দেখে যেতে চান। প্রসঙ্গত চলতি মাসের সতেরো তারিখেই তাঁকে শেষবারের মতো দেখা যাবে শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতির কুর্শিতে। তাঁরই সদিচ্ছায় শেষ পর্যন্ত শনিবার ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছলো অযোধ্যা মামলা।
সেই সঙ্গে শেষ হলো আধুনিক ভারতের লঙ্কাকান্ড।



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours