কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

"তুমি আজকাল একা দাঁড়িয়ে থাকো কেন?"
ফিসফিস করে জানতে চাইলো ফুটের সেই রেলিংটা।
একটু চমকেই উঠেছিলাম। কেমন একটা ধাতব কন্ঠ। কঠিন। হঠাত করেই যেন ছুঁয়ে গেল আমায়।
সদ্য সদ্য পুজোর মনশুন শেষ হয়েছে। দূর্গা, লক্ষ্মী তারপর কালীপূজা। রাস্তাঘাটে এসময় কিছুদিনের জন্য ভিড়ভাড় একটু কম। ছটপুজো শেষ হলেই আবার সেই বড়দিন। মধ্যে মাস দেড়েকের বিরতি। সেই অবসরে একটু জিরিয়ে নেয় ক্লান্ত শহরটাও।
আসলে সেদিন রাত দশটা পেরিয়ে গেছিল ফিরতে ফিরতে। এতটা দেরি আজকাল সাধারণত হয় না। মেট্রো থেকে নেমে রোজই মোড়ের ফুটে দাঁড়াই। একটা নির্দিষ্ট জায়গা আছে। যেদিন দেখি, ওই জায়গা কেউ আগে থেকেই দখল করে নিয়েছে, মেজাজ ঘেঁটে যায়। নীল সাদা রেলিংয়ে হাতের ভর দিয়ে দাঁড়াই। চা খাই। সিগারেট খাই। তারপর আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে ফ্ল্যাটের রাস্তায় হাঁটা দিই।

সেরাতে দেরিতে ফেরায়, বেশিরভাগ দোকানপাটই ততক্ষণে ঝাঁপ ফেলেছে। রাস্তা বেশ ফাঁকা। মোড়ের সিগন্যালের চোখও যেন ঘুমে ঢুলুঢুলু। অতিকষ্টে লাল, সবুজ চোখদুটো খোলা রেখেছে। গাড়িঘোড়া কম, মানুষজনও কম। ভাবছিলাম কখন ঘুমায় রাস্তাটা? কতক্ষণই বা ঘুমায়? আমার চেয়েও অনেকটাই কম। ঘুমের যে ব্যাঘাত ঘটে না এমনটাও নয়। নাকি ঘুমের নামে আসলে অপেক্ষা। অপেক্ষা শেষরাতের। অপেক্ষা আবার কখন রাস্তার বুক দাপিয়ে ছুটবে বাস, ট্যাক্সি, গাড়িঘোড়া। আড়মোড়া ভাঙবে মহানগর। এরমধ্যেই চায়ের ভাঁড় ধরিয়ে দিয়ে গেল দোকানি। সঙ্গে ছোট্ট এক টুকরো হাসি। ফাউ। আজকাল উঠেই গেছে। সবকিছুই এখন নিক্তিতে মাপা। ফাউয়ের মজাটা সেই জানে, যে পেয়েছে।
প্রথমদিকে ওই দোকানিও থেকে থেকেই জিজ্ঞাসা করতো, "এখনই দেব নাকি?"
- "দিন।" একটু হেসে বলতাম।
- "কটা চা, একটাই?" একটু থেমে পরের প্রশ্ন, "দিদির আসতে দেরি আছে নাকি?"
কী আর জবাব দেব! একটু হেসে চুপ করে যেতাম। তারপর একদিন দোকানিও চুপ মেরে গেছিল। বুঝতে পেরেছিল, দিদি আর আসবে না। নিজের  মতো করে, নিশ্চয়ই কিছু একটা ভেবে নিয়েছিল ও। মানুষ তো। তাও আবার কলকাতার। অন্যের ব্যাপারে অত মাথাব্যথা ধাতে নেই। আর থাকলেও, তার প্রকাশ নেই।

কিন্তু রেলিং লোহার। অমানবিক। মন বলতে কিছু নেই ওর। যা আছে ওই শরীরটুকুই। তবে সেই শরীরে উষ্ণতা আছে। কখনও গরম, কখনও ঠান্ডা। আমার শরীরের উষ্ণতাও ওকে ছুঁয়ে যায়। ও সেই উষ্ণতা মেপেই, যা বোঝার বুঝে ফেলে। তবু সেই নিঝুম এক রাতে, সময় সুযোগ বুঝে রেলিং জিজ্ঞেস করেই বসলো- "একা কেন? আরেকজন কোথায়?"
এই রেলিংয়ে ভর দিয়েই যে আগে পৌঁছতো, অপেক্ষা করতো। চোখ রাস্তার দিকে। কয়েক হাত দূরেই এক মোড়। মাস্টারদা মেট্রো স্টেশনে নেমেই, বাঁদিকে কয়েক পা এগিয়ে আসা। তারপরেই এই রেলিংয়ের গায়ে গা লাগিয়ে, দুজনের সারাদিনের গল্প জুড়ে দেওয়া। একসঙ্গে চা সিগারেট বিলাসপর্ব। সবশেষে ধীরেসুস্থে আস্তানার দিকে পা বাড়ানো। তবে একজন আসতে দেরি করলে, ততক্ষণে আর এক কাপ চা হয়ে যেত। অঘোষিত আইন ছিল, অপেক্ষা মাস্ট। অপেক্ষা করতেই হবে।

আজও আইন ভাঙিনি আমি। পুরনো যে আইন, মেনে চলার অভ্যেসটা আজও রয়ে গেছে।
"ঠারে রহিয়ো, ও বাঁকে ইয়ার ঠারে রহিয়ো।"
দেখতে দেখতে আরও একটা নভেম্বর। গত অগাস্টেই পেরিয়ে এসছি একটা বছর। যত দিন গেছে, ক্লান্তি এসেছে। এখন মোড়ে দাঁড়ানোর সময় এদিক ওদিক হয়ে যায়। মন উতলা হলে সন্ধ্যা সাতটা বাজতে না বাজতেই হাজির। আবার আটটা, সাড়ে আটটাও হয়ে যায়। মন সেদিন ক্লান্ত।

চোখ ঘুরে ফিরে মোড়ের মাথার 'ম্যাক্স'- এর দিকেই। মেট্রো থেকে নেমে 'ম্যাক্স' ডান হাতে রেখে, বাঁ দিকে ঘুরলেই, যেখানে দাঁড়াই তা চোখে পড়ে।
খুব ভালভাবেই জানি, ওই মোড় ডিঙিয়ে আর কোন দিন কেউ এই রেলিংয়ের দিকে এগিয়ে আসবে না। তবুও অবুঝ চোখ। মোড়ের দিকেই চেয়ে থাকে হ্যাংলার মতো। সামনে দিয়ে পেরিয়ে যায় কতশত মুখ। কেউ এক টুকরো হাসি ছুঁড়ে দিয়ে যায়। আবার কেউ অটোরিক্সা, গাড়িতে যেতে যেতে 'হায়'। কল করে। "আটটা দশ নাগাদ তোমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম তো মোড়ের মাথায়। চিনতেই পারলে না বস!"
- "কার জন্য হাঁ করে তাকিয়ে ছিলে গুরু?"
ওরা কেউ মানতে চায় না, "আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ।"

কী করে বোঝাই আমার সামনে দিয়ে যারা পেরোয়, তারা আজ শুধুই মানুষ। সুন্দর অসুন্দর, নাটা লম্বা, ফর্সা কালা একাকার। সবাই একরকম। তফাত করতে পারি না, একজনের সঙ্গে আরেকজনের। কিভাবে বুঝবো কে বন্ধু, কেই বা শত্রু? কাউকেই আজকাল চিনতে পারি না।
তবু রোজ দাঁড়িয়ে থাকি। কে যেন টেনে ধরে রাখে পেছন থেকে।
"তোমার মতো এমন টানে, কেউ তো টানে না!"
সেই টানে কেউ বনবন করে লাট্টুর মতো চক্কর মেরেই চলে। আদি অনন্তকাল ধরে। অপেক্ষা পৃথিবীর। ঠিক কোনদিন ছুঁয়ে ফেলতে পারবে দিবাকরকে। সে জানে ছুঁয়ে ফেললেই বিপদ। নিমেষেই জ্বলেপুড়ে শেষ। ঠিক ওই পতঙ্গের মতো। প্রদীপের শিখা দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। অপেক্ষা সর্বনাশের।
"জ্বলনে মে কেয়া মজা হ্যায়/ পরওয়ানে জানতে হ্যায়।"

সবাই যেন অপেক্ষা করে চলেছে।
আকাশের জন্য তেপান্তরের অপেক্ষা। ভোরের জন্য তারার। ঝড়ের জন্য মেঘের। বিশ্বব্রহ্মান্ড জুড়ে শুধুই পথ চেয়ে থাকা। এ এক অন্তহীন অপেক্ষা, আমার আর রেলিংয়ের।
সত্যিই কি অপেক্ষা?
আসলে দাঁড়িয়ে থাকাটা আজ অভ্যেস হয়ে গেছে। তোমরা সেটাকে নাম দিয়ে বসেছ- অপেক্ষা।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours