কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

"গল্প শুনে তারে আমি অল্প অল্প ভালবেসেছি !"
ওই গান কানে যেতেই মনে হয়েছিল, "ছিল মন তোমারি প্রতীক্ষা করি, যুগে যুগে দিন রাত্রি ধরি।" আহা, কী দরাজ গলা। পৌরুষ যেন উপচে পড়ছে গানের গমকে। কিন্তু সে যখন সামনে এসে দাঁড়ালো, তখন সে যদি হয় 'রাজা' নাটকের কদাকার সেই রাজা।
চমকে গেলেন তো? স্বপ্ন ভেঙে চৌচির।
পত্রপাঠ বিদায় না। প্রত্যাখান না। আরও একবার ভেবে দেখবেন। কদাকার হলেও রাজা তো। ট্যাকের জোর আছে। যাকে কেউ উলঙ্গ বলার স্পর্ধা দেখায় না। ওসব মেধা ফেধা, গানের গলা মাথায় উঠলো। রাজা মানেই রাজকীয়, রাজপ্রাসাদ। বৈভব। প্রতিপত্তি। ক্ষমতা। ট্যাঁকের জোরেই বাজিমাত। সেই "অল্প অল্প ভালবাসার" প্রত্যর্পণ হয়ে উপচানো প্রেমের রূপোর ঘড়া।

সে যদি হয় নারী?
যার কোকিলকন্ঠে, 'প্রেম একবার এসেছিল নীরবে' শুনে আপনি 'ঝিঙা লালা' হয়ে গেছিলেন।
এবার সে সামনে এসে দাঁড়ালো। ঠিক যেন রানু মন্ডল। এক সাদামাটা, চমক- দমকহীন মহিলা। অস্থিচর্মসার এক নারী। যার গলায় আপনি ওপরের ওই গানের কলি শুনে প্রেমে পড়ে গেছিলেন। এই মুহূর্তে হাত বাড়ালেই সে। অনায়াসে তাকে ছুঁয়ে ফেলতে পারে আপনার যে কোনও হাত। কিন্তু হাত তখন অচল। নিস্পন্দ। থমকে গেছে বিস্ময়ে। ড্যাবডেবে দুচোখ খুঁজে বেড়াচ্ছে নারীশরীরের পরম রমনীয় চড়াই উতরাই। কোথায় কী? ষোড়শী, অষ্টাদশী নাকি শুধুই বিরাশি, তা বোঝারই উপায় নেই। এবার? নীরব প্রেমের বাঁশি বাজবে তো? নাকি, বাঁশি শুনে আর কাজ নাই !

মুখে যতই হাতি ঘোড়া মারুন না কেন- প্রেম স্বর্গীয় ! প্রেমে শরীর গৌণ। প্রেম দেহাতীত। সব কথার কথা। আসল কথা বেশ মনমতো একখানা নধর শরীর চাই। একেক জনের প্রেফারেন্স একেক রকম। পুরুষ হোক বা নারী, সবারই নিজের নিজের পছন্দ আছে। 'আগে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারী !

কিছুদিন আগেই স্যাপিয়োসেক্সুয়াল নিয়ে লিখেছিলাম।  অনেকেই তখন নেচে উঠেছিলেন,  আমরাও তাই। স্যাপিয়োসেক্সুয়াল। মেধাতেই প্রেম। 'নোপ' টু শরীর। এবার ওপরের ওই গান "অল্প অল্প ভালবেসেছি" গেয়ে আয়নার সামনে গিয়ে  দাঁড়ান। কী দেখলেন? স্যাপিয়ো গায়েব। আয়নার বুকে ধরা সেক্সুয়াল এর ছবি।
'ভিঁগে হোঁঠ তেরে। পিয়াসা দিল মেরা ।"

নিজেকে চিনলেই মুশকিল।  নিজের কাছে নিজের ধরা পড়ে যাওয়া।
স্যাপিয়োসেক্সুয়ালের মধ্যেও আধ্যাত্মিকতা লুকিয়ে আছে। প্লেটোনিক প্রেম দুই মানবের। ঈশ্বর- ভক্ত যুগল প্রেমের মতোই। এপ্রেম বিরল প্রজাতির।
'নরেন যেদিন নিজেকে চিনতে পারবে, সেদিন আর দেহ রাখবে না।' হ্যাঁ এতটাই মুশকিল নিজেকে চিনতে পারা। নরনারায়ণ। সেই স্বরূপ চিনতে পেরে দেহ রাখা যায় না। মন তখন দেহাতীত। কিন্তু আপনি নিজেকে চিনতে পারলেন কি? আপনার তো উল্টোটা, গোটাটাই দেহতে। সত্যিই কি আপনিও স্যাপিয়োসেক্সুয়াল? প্রেম মেধার সঙ্গে। যৌনতার সঙ্গে জড়িয়ে সৃষ্টি। হতেও পারে ! তবে, তাতেও সমস্যার শেষ না।

একদিন যার গান শুনে ভালবেসেছিলেন, তার গলা যদি কোনও কারণে নষ্ট হয়ে যায়? যার ছবি দেখে মুগ্ধতাই প্রেমের জন্ম দিয়ে ছিলো কোনও দুর্ঘটনায় যদি তার হাত খোয়া যায়।  যে লোকটার অসীম জ্ঞানে তাকে বরণ করেছিলেন,  সে যদি ধীরে ধীরে সব ভুলে যেতে থাকে। বিস্মৃতির গর্ভে চলে যায় তার সেই বিদ্যা। অ্যালজাইমার্স। তখন ভালোবাসা থাকবে তো? বড্ড জটিল এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া।

তারচেয়ে অনেক সহজ সরল শরীরী প্রেমের দর্শন।
প্রেমবাজারের শেয়ার ওঠানামা করে শরীরের সঙ্গে। তাই এত যোগা জিমের ছড়াছড়ি।  ত্বকের যত্ন নিন। শরীরের 'প্যাক' বাড়ান। শরীর যেটুকু বেলেল্লাপনা করে বসেছে তা ঢাকতেই এত আয়োজন। সমস্যার গোড়ায় জল না ঢেলে শরীরকে পাতাবাহার করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা। রকমারি পোশাক আশাকের সম্ভার।

হালফ্যাশন। সাজগোজ মেয়েদের ব্যাপার ! সেই দর্শন  আজ ইতিহাস। পুরুষরাও আজকাল দিব্য ফ্যাশন সচেতন। হাতের আসুরিক পেশি দেখাতে আগেকার স্যানডো গেঞ্জি এখন নবরূপে। আগে তা থাকতো জামার তলায় লুকিয়ে। আজ জামা গেছে, স্যানডো আছে। মেয়েদের ব্রায়ের মতো। কাঁধে বা পিঠের দিকে স্ট্র্যাপ উঁকি মেরে বসলেই হলো। লজ্জায় লাল। সখের ফিসফিস, "সামাল দে, পৈতে আউট।" এখন ওটাই ফ্যাশন। ছেলেমেয়ে যে যতটুকু পারে শরীর প্রদর্শন। কারণ? ওই যে বাজারদর বাড়ানো।
ছেলেদের ফ্যাশন আয়োজন আজও অতটা ব্যাপক না। হাতকাটাতেই শেষ। আর পা কাটা। আগে ছিল হাফপ্যান্ট। মজদুর শ্রেণির জন্য। আজ তা সার্বজনীন। ফ্যাশন ফানডা। থ্রি কোয়ার্টার, বারমুডা, লোমভর্তি পায়ের প্রদর্শন। তবে এখনও গলা পেট বুক কাটা কোনও টপ আবিষ্কার হয়নি পুরুষ মানুষের জন্য। কেন? হয়তো এখানেও অবচেতনে কাজ করে সেই পুরুষতন্ত্র। টেরা হোক বাঁকা হোক তবু সোনার আংটি। ওই হাত, পা বড়জোর জামার ওপরে দুটো খোলা বোতাম। রোমশ বুকের উঁকিঝুঁকি। এরবেশি শরীর না দেখালেও চলবে পুরুষের।
তবে সবকিছু মিলিয়ে কেমন যেন এক জগাখিচুড়ি। লম্বা চুল, খোঁপা বাঁধা। আবার কানে রিং। বেশ একটা নারীসুলভ 'লুক'। আবার অন্যদিকে, সিক্স প্যাক এইট প্যাক শরীর। গাময় বাহারি উলকি। চুলের বাহার। সবমিলিয়ে এক বুনো 'হিম্যান' ব্যাপার। দিকভ্রান্ত পুরুষ নয় তো? মোটেই না, এ হলো সেই ময়ূরের পেখম মেলা !

সেই বহুরূপী পুরুষদের ঘায়েল করতে কতোই না আয়োজন।
হোক নারীশরীরের খোলামেলা প্রদর্শন। লো কাট থেকে আরেকটু ডিপ কাট হোক। ক্লিভেজ শো অনেক হলো। আরেকটু সাহসী হও দেখি ম্যাডাম।
কিন্তু কেন এই খোলামেলা পোশাক?
- 'এবার থেকে কি পুরুষদের জিজ্ঞাসা করে জামাকাপড় পড়তে হবে নাকি?'
ক্লিশে হয়ে যাওয়া নারীবাদীদের এই উত্তর তো আছেই।  'বেশ করি। যা ভালো লাগে তাই পরি।'
তাহলে পরের প্রশ্ন, ভালোটাই বা লাগে কেন?
"আত্মবিশ্বাসের অভাব মেয়েদের।" স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন কিংস্টন স্কুল অফ আর্টের, ডায়ভার্সিটির প্রফেসর ক্যারিন ফ্র্যাঙ্কলিন। "এই মেয়েরা নিজেরাই ভেবে বসে, তাদের যতটা ভালো হওয়ার কথা, তারা ঠিক ততটা ভালো নয়।" কি বলবো একে হীনমন্যতা? ক্যাথরিন বলেন, "এই মেয়েদের ভয়,  তাঁরা ততটা ভালো না বলে, মনমতো বয়ফ্রেন্ড জুটবে না। তাই এরা আকর্ষণীয়, হট জামাকাপড় পরে 'ভালো না হওয়ায় ঘাটতি' মেটাতে চায়।
"ডেটিংয়ের সময় পুরুষ, নারী দুজনের ছবিটা আরও স্পষ্ট হয়।" মত ইউনিভার্সিটি অফ নেব্রাস্কা'র যোসেফ বেঞ্জের সমীক্ষার। "পুরুষ নারী দুজনেই চায় দুজনার কাছে স্পেশাল হয়ে উঠতে। ডেটিংয়ে গেলে সঙ্গীকে আগলে রাখে পুরুষ। কোনভাবেই যাতে সে কোনও অসুবিধায় না পড়ে।  সোজাকথায়, তখন বয়ফ্রেন্ডের ভূমিকা হয় পাহারাদার বা বডিগার্ডের। অন্যদিকে নারীর হাতিয়ার সেই কোমল তুলতুলে দেহ। বডি ইমেজ। শরীর দিয়েই বাজিমাত। পোশাকের আড়ালেও নগ্নতা। শরীরের দুষ্টুমিষ্টি উঁকিঝুঁকি !

আপনার পোশাকই বলে দেয় আপনার পরিচয়। ফুটে ওঠে আপনার মানসিকতা। মত মনস্তত্ত্ববিদের। তবে যার পোশাক মুখর, ঢাকা পড়ে তার ব্যক্তিত্ব। এক জলজ্যান্ত মানুষ তখন 'সাবজেক্ট' না হয়ে 'অবজেক্ট'। পোশাক যে মানুষ সবসময় নিজের ইচ্ছেতেই পরে, এমনটাও নয়। অন্যের মন রাখতেও পোশাক পরতে হয়। আবার অনেকে কী পরবেন না পরবেন, সে সবকে পাত্তাই দেন না। তবে আপনি মানুষটা কেমন, এর প্রথম ইঙ্গিত দেয় কিন্তু ওই পোশাকই।
"লোগ মেক আপ করতে হ্যায় দিখানে কে লিয়ে।  তুম ছুপানে কে লিয়ে করো।" 'জুলি' সিনেমার সেই ডায়লগ মর্মান্তিক বাস্তব।

"মন নিয়ে কি মরবো নাকি শেষে?"
সত্যিই তো। শরীরের ভাষা বোঝাও সোজা, বোঝানোও সহজ। ঘোমটাকে 'দূর ছাই' করে আজ প্রকাশ্যেই খেমটা নাচ। ইন্টুমিন্টু হলে দুজনেরই 'আঁখি হতে ঘুম কে নিল হরি?' হোয়াপে মেসেজ। "ভালো লাগছে না !" নিশুতি রাতের ফোনকল। বুক ধকধক। আরও কত কী সিম্পটমস। তবে ইতিহাস হতে চাইলে, হাঁটুন উল্টো রাস্তায়। প্রেমে ছন্দপতন। শরীর নিস্তেজ। উস্কখুস্ক চুল। ক্রিমবিহীন শুকনো খসখস গাল। খসখসে ত্বক, খড়ি ওঠা। আপনার শরীরময় বিরহসঙ্গীত। 'দেবদাস'- এর মতো হয়ত আরেকটা কালজয়ী উপন্যাস লিখে ফেলবেন কেউ। এরপরেও প্রেমে শরীরকে 'অবান্তর' বললে বেইমানি করা হবে।
মনতো আধ্যাত্মিক ব্যাপার। কথাও বলে দেবভাষায়। অং বং ছাড়া কিছুই মাথায় ঢোকে না। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, অরুন্ধতী দেবীর সেই গান মনে আছে তো- মন বলে আমি মনের কথা জানি না।

আরে মশাই গোটাটাই কেমিস্ট্রি। ওই 'অল্প অল্প ভাল লাগা থেকে', 'প্রেম একবার এসেছিল নীরবে', গোটাটাই রসায়নের খেলা। মগজের ষড়যন্ত্র। অক্সিটোসিন আর কর্টিসল ক্ষরণ। ব্যাস আপনি ঘায়েল। মন উড়ুউড়ু। প্রেম পায়। অক্সিটোসিন চাবুক কষায় প্রেমের ঘোড়া ছোটাতে। আর 'প্রেমেতে চাপ' বাড়ায় কর্টিসল। উদ্বেগ। প্রেমের ভ্রূণেই প্রোগ্রামিং করা উদ্বেগ। তাই প্রেম- উদ্বেগ জমে ক্ষীর। এবার আপনিই ঠিক করুন সেজেগুজে, গান গাইতে গাইতে, সেই ক্ষীরের স্বাদ চাখতে যাবেন কিনা?


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours