দেবলীনা দাশগুপ্ত, লেখিকা, কলকাতা:
 
“চণ্ডালোহপি দ্বিজশ্রেষ্ট হরিভক্তি পরায়ণ”
সমগ্র বাংলাদেশ ও বঙ্গীয় সমাজে শ্রী চৈতন্যদেবের প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। ঘুণপোকায় ধরা এই বঙ্গসমাজের সংস্কারক ছিলেন তিনি। সংস্কার করতে চেয়েছিলেন এই ক্ষয়িষ্ণু সমাজের। সেই সময়ে সমাজে বর্ণবৈষম্য এক দুরারোগ্য ব্যাধির আকার ধারণ করেছিল। মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্যদেব সমাজে ঐক্য ফিরিয়ে আনার জন্য একতার বাণী প্রচার করেছিলেন। হরি নামের মাধ্যমে একতার বাণী প্রচার করেছিলেন। হরণ করতে চেয়েছিলেন সামাজিক এই ব্যাধিকে। এককথায় নবজাগরণ ঘটিয়েছিলেন নিজগুণে। কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন সমগ্র বাংলাদেশ ও উড়িষ্যা। অথচ তাঁর মত মহামানবের কপালেও ঘটল এমন মর্মান্তিক পরিণতি।
বিশ্বকবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর লেখা ‘মদনভস্মের পরে’ কবিতায় বলেছেন –
                                 “পঞ্চশরে দগ্ধ করে   করেছ একি সন্ন্যাসী
                                       বিশ্বময় দিয়েছ তারে ছড়ায়ে!
                                 ব্যাকুলতর বেদনা তার   বাতাসে উঠে নিশ্বাসি,
                                       অশ্রু তাঁর আকাশে পড়ে গড়ায়ে”।
কবিগুরুর মতে, দেবাদিদেব মহাদেব মদনদেবকে তাঁর ক্রোধানলে ভস্ম করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু মহাদেবের সেই অভিশাপ নাকি আশীর্বাদে পরিণত হয়েছিল। কারণ মদন ভস্মের পূর্বে প্রেমাধিকার একমাত্র সেই লাভ করত। যাকে উদ্দেশ্য করে কামদেব নিক্ষেপ করতেন তাঁর পুষ্পশর। কিন্তু মদন ভস্মের পরে কামদেবের ভস্মাবশেষ বাতাসের মাধমে সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ায় সমগ্র প্রাণীকুল পেয়েছে প্রেমের অধিকার। সবার হৃদয়ে জেগেছে প্রেমানুভূতি।
কিন্তু সত্যি কী তাই? তাহলে কেন এত হিংসা? মানুষের হৃদয়ে প্রেমানুভূতির এত অভাব কেন? কেন হারিয়ে ফেলছে মানুষ তার মানবিকবোধ? পাঁচশত বছর আগেই হোক বা পরে হিংসা এখনও সমানভাবে রাজত্ব করে চলেছে মানবসমাজে। দাবিয়ে রেখেছে অন্যান্য অনুভূতিগুলিকে। তাই হয়তো চৈতন্যদেবের মত মানবপ্রেমিককেও এমন নৃশংসতার শিকার হতে হয়েছিল। কী অপরাধ ছিল তাঁর? তিনি শুধু সমাজের ক্ষত নিরাময় করতে চেয়েছিলেন। হরি নামের মাধ্যমে বর্ণবৈষম্য হরণ করতে চেয়েছিলেন। হরিভক্তি পরায়ণ হলে একজন চণ্ডাল দ্বিজর থেকেও শ্রেষ্ঠ হয়ে ওঠে – এই মহামন্ত্রের মাধ্যমে এক ঐক্যবদ্ধ সমাজ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, প্রেমের বাণী প্রচার করতে চেয়েছিলেন। অথচ তাঁকেও মানবসমাজের লোভ, হিংসা আর লালসার শিকার হতে হয়েছিল।
ডঃ নীহাররঞ্জন রায় তাঁর লেখা একটি দীর্ঘ পত্রের একটি জায়গায় খুব জোর দিয়ে লিখেছেন, “শ্রীমন্মহাপ্রভু চৈতন্যদেবকে গুমখুন করা হয়েছিল পুরীতেই এবং সন্ন্যাসী চৈতন্যদেবের দেহের কোন অবশেষের চিহ্নও রাখা হয় নি কোথাও। এবং তা হয়নি বলেই তিনটি কিম্বদন্তী প্রচারের প্রয়োজনও হয়েছিল”।
এই তিনটি কিম্বদন্তী হল – ক) শ্রী চৈতন্যদেব জগন্নাথদেবের মূর্তিতে বিলীন হয়েছেন (অধিকাংশ চৈতন্যজীবনীকার এই মতামত ব্যক্ত করেছেন), খ) শ্রী চৈতন্যদেব সমুদ্রে বিলীন হয়েছেন, গ) রথযাত্রার সময় নাচতে নাচতে চৈতন্যদেবের বাঁ পা ইঁটের আঘাতে জখম হয়, এবং সেই ক্ষতস্থান বিষিয়ে ওঠার ফলে তাঁর মৃত্যু হয় (চৈতন্যমঙ্গল রচয়িতা জয়ানন্দের মতামত)। এছাড়াও রোমা রোলাঁর মতে মহাপ্রভুর মৃত্যু হয় এপিলেপসিতে। ওড়িয়া বৈষ্ণব কবি ও মহাপ্রভুর ভক্ত বিজয় দাস লিখেছেন, তিনি নাকি নিজে মহাপ্রভুর নিথর দেহ দেখেছিলেন গরুড় স্তম্ভের পিছনে পড়ে থাকতে। কিন্তু তারপর তাঁর দেহের কী পরিণতি হয়েছিল তার কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না।
তাই এসব তথ্য বা কিম্বদন্তীর কোনো বিশ্বাসযোগ্যতাও নেই এবং সঠিক প্রমাণও নেই। কারণ মহাপ্রভু রথের সময় অন্তর্হিত হয়েছিলেন। কিন্তু রথের দিন তো জগন্নাথদেবের মূর্তি মন্দিরে থাকার কথা নয়। আর মহাপ্রভুর মৃত্যু যদি ইঁটের আঘাতে বা এপিলেপসিতে হয়ে থাকে তাহলে তাঁর দেহ কোথায় সমাধিস্থ করা হল? এই প্রশ্নের উত্তর এখনো পাওয়া যায় নি। শুধু তাই নয়, এই প্রশ্নের উত্তর যিনি বা যাঁরা খুঁজতে গেছেন তাঁদেরও নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে, অথবা তাঁদের থামিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ডঃ নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেন – কীভাবে তাঁর (মহাপ্রভুর) দেহাবসান ঘটেছিল সে সম্বন্ধে আমার কিছু যুক্তিনির্ভর ধারণা আছে। কিন্তু সে ধারণাটি আমি প্রকাশ্যে বলতে বা ছাপার অক্ষরে লিখতে পারব না; যদি বলি বা লিখি, তাহলে বঙ্গদেশে প্রাণ নিয়ে বাঁচতে পারব না। ডঃ রায়ের আশঙ্কা ভুল নয়। মহাপ্রভুর অন্তর্ধান রহস্য উদ্‌ঘাটন করতে গিয়েই তো নির্মম পরিণতি হয়েছিল ডঃ জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের।
১৫৩৩ সালের ২৯শে জুন মতান্তরে ১৫৩৪ সালের ১৪ই জুন রথের উৎসবের সময়। এই দিনটিই মহাপ্রভুর অন্তর্ধানের দিন। ওই দিন  মহাপ্রভু মন্দিরে প্রবেশ করার পর মন্দিরের কপাট বন্ধ করে দেওয়া হয় দীর্ঘক্ষণের জন্য। ডঃ দীপক চন্দ্র তাঁর লেখা “সচল জগন্নাথ শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য” বইটিতে লিখেছেন – “নির্ভীক সন্ন্যাসী শ্রীচৈতন্য সব জেনেই বিদ্যাধরের ফাঁদে পা দিল”। এখানে উড়িষ্যার মন্ত্রী গোবিন্দ বিদ্যাধরের কথা বলা হয়েছে। তিনিই ছিলেন চৈতন্যদেবের বিরুদ্ধে মূল ষড়যন্ত্রকারী। এছাড়া ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে দীনবন্ধু প্রতিহারীর নামও পাওয়া যায়। ডঃ দীনেশ চন্দ্র সেন তাঁর “Chaitanya and his age” বইটিতে লিখেছেন, “ They buried him somewhere under the floor of the temple and would not allow any outsider to enter it until the place was thoroughly repaired and no trace left after his burial.”
মহাপ্রভুর এই করুণ পরিণতি একেবারেই কাম্য নয়। অনেকের মতে তাঁকে মন্দিরের মধ্যেই হত্যা করা হয়েছিল। এই ঘটনা জানার পর সত্যি জানতে ইচ্ছে করে যে ঈশ্বর তখন কোথায় ছিলেন? কেন হল এই পাপাচার মন্দিরে? শুধু তাই নয়,তথ্য অনুযায়ী ২০০০ সালে পুরীর মন্দির সংস্কারের সময় দুটি কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছিল। অনেকেই সন্দেহ করেছিলেন যে কঙ্কালগুলি মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব ও তাঁর একজন সঙ্গীর। কঙ্কালগুলি ফরেনসিকে পাঠানো হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে সেই কঙ্কালগুলিও লোপাট হয়ে যায়।
শ্রী রূপক সাহা তাঁর লেখা “ক্ষমা করো, হে প্রভু” উপন্যাস্টিতেও চৈতন্যদেবের হত্যার কথাই বলেছেন। অবশ্য মহাপ্রভুর এই করুণ পরিণতির কথা জেনে তাঁর কাছে হাতজোর করে বলতে ইচ্ছে করে, “ক্ষমা করো, হে প্রভু”।
কিন্তু এই কি প্রাপ্য ছিল মহাপ্রভুর। চৈতন্যদেব সম্পর্কে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বলেছেন -
                       “বাঙালীর হিয়া অমিয় মথিয়া নিমাই ধরেছে কায়া”।
এই মহামানবের মৃত্যুর সত্যতা আজও রহস্যের অন্তরালে রয়ে গেছে। যিনি বা যাঁরা এই রহস্য উদ্‌ঘাটন করার চেষ্টা করেছেন তাঁদেরই নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে, নাহলে হুমকি দিয়ে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই প্রসঙ্গে একটি কথা বলতেই হয়, বিখ্যাত চৈতন্য জীবনীকার কৃষ্ণদাস কবিরাজ তাঁর চৈতন্য চরিতামৃতে লিখেছেন –
                        “শেষ লীলার সূত্রগণ   কৈলুঁ কিছু বিবরণ,
                               ইহাঁ বিস্তারিতে চিত্ত হয়।
                          থাকে যদি আয়ু শেষ    বিস্তারিব লীলা শেষ
                               যদি মহাপ্রভুর কৃপা হয়”।।
অর্থাৎ কৃষ্ণদাস কবিরাজ শ্রীচৈতন্যদেবের শেষ লীলা সম্পর্কে আরো কিছু বলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর আর বলা হয়ে ওঠেনি।
এমন একজন মানবপ্রেমিকের মৃত্যু চিরকালই জনসাধারণের অজ্ঞাতই থেকে গেল। আর আমরাও সেইভাবে জানার জন্য কখনো আগ্রহ প্রকাশ করিনা। আধুনিক জীবনে আমরা বড়ই যান্ত্রিক, বড়ই ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। তাই গণতান্ত্রিক দেশেও আমরা বলতে পারিনা যে মহাপ্রভুর মৃত্যু কীভাবে হয়েছিল তা জানার অধিকার আমাদের সকলের আছে। আমরা প্রশ্ন তুলতে পারিনা যে মন্দির থেকে পাওয়া কঙ্কালগুলি কোথায় গেল? এমনকি কঙ্কালের সংখ্যা নিয়েও সংশয় রয়েছে। ইন্টারনেট ঘাঁটলে দেখা যায়, কোথাও কোথাও কঙ্কালের সংখ্যা নিয়েও সংশয় রয়েছে। কয়েকটি কাগজে এই বিষয়ে লেখালিখি হলেও তারপর সব চাপা পড়ে যায়।
“হে মোর দুর্ভাগা দেশ”, একজন সমাজসংস্কারকের এই নির্মম পরিণতি সত্যিই আশা করা যায় না। চিৎকার করে বিদ্রোহী কবির লেখা একটি পংক্তি বলতে ইচ্ছে করে –
                       “ওগো ভগবান, তুমি আজিও আছো কি”?
পরিশেষে বলতেই হয়, প্রেমের জলজ্যান্ত প্রতিমূর্তির এমন পরিণতি মানবসমাজের হিংস্র রূপটিই প্রকাশ করে। যিনি বর্ণবৈষম্য মুছে এক ঐক্যবদ্ধ সমাজ গঠন করতে চেয়েছিলেন, তাঁকেই পৃথিবী থেকে নিষ্ঠুরভাবে মুছে ফেলেছিল ষড়যন্ত্রকারীরা। আমাদেরই দুর্ভাগ্য যে আমরা সঠিক মানুষের সঠিক মুল্যায়ণ করতে পারিনি। তাঁর মৃত্যু নিয়ে জনসাধারণ জোরালো কোনো প্রশ্নও তোলেনা। সঠিক প্রমাণের অভাবে আজও রহস্যের জালে আবৃতই রয়ে গেছে মহাপ্রভুর অন্তর্ধানের বিষয়টি, হত্যাকারীরা রয়ে গেছে ভদ্র মুখোশের আড়ালেই।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours