ভবানীপ্রসাদ ভট্টাচার্য্য, ফিচার রাইটার, দুর্গাপুরঃ

 'জগদ্ধাত্রী ' শব্দের  অর্থ ('জগৎ+ধাত্রী ) জগতের  ধাত্রী অর্থাৎ  ত্রিভুবনের  পালন  কর্ত্তী! দেবী  দুর্গা  ও মা  কালীও  জগতের  পালন  কর্ত্তী  এবং  শক্তির  দেবী! মা  জগদ্ধাত্রীও  দেবী  দুর্গার  আর  একটি  রূপ! উপনিষদে  দেবী জগদ্ধাত্রীকে  উমা  হৈমবতী  নামে  উল্লেখ  করা  হয়েছে!ভিভিন্ন  তন্ত্র  ও পুরানেও  এই  দেবীর  উল্লেখ  আছে! হিন্দু ধর্মে  দেবী  দুর্গা রাজসিক, দেবী  কালী  তামসিক  ও দেবী  জগদ্ধাত্রী  সত্ত্বগুনের দেবী! দেবী  জগদ্ধাত্রী  হস্তিরূপধারী  করিনেদ্রাসুরকে  বধ  করেন! তাই  তিনি  করিন্দ্রাসুরনাশিনী  নামেও  খ্যাতা!
            জগদ্ধাত্রী  পুজা  বঙ্গদেশেই  প্রচলিত! যদিও  সারা  বঙ্গদেশেই  জগদ্ধাত্রী  পুজার  ব্যপক  প্রচলন  নেই,তবে  নদিয়ার  কৃষ্ননগর  ও হুগলীর  চন্দননগরের  জগদ্ধাত্রী  জগৎ বিখ্যাত !
             বঙ্গদেশে  কোন  সময়ে  জগদ্ধাত্রী  পুজার  প্রচলন  হয়  সে  বিষয়ে  দ্বিমত  থাকলেও  কৃষ্ননগরের  মহারাজা  কৃষ্নচন্দ্র  পুজার  প্রচলন  করেন  এ  বিষয়ে  সন্দেহের  অবকাশ  নেই!
         
  সালটা  সম্ভবতঃ  ১৭৫৪  বাংলার  নবাব  তখন  আলিবর্দী খাঁ, কৃষ্ননগরের  মহারাজা  কর  দিতে  না  পারায়  নবাবের  নির্দ্দেশে  মুশিদাবাদের  কারাগারে বন্দী! ৯ লক্ষ  টাকা  বকেয়া  কর  মিটিয়ে  তিনি  বন্দী  দশা  থেকে  মুক্তি  পেলেন! তিনি  নৌকা  যোগে  যেদিন  কৃষ্ন  নগরে   ফিরলেন  সেদিন  বিজয়া
দশমীর বিকাল ! গঙ্গার  ঘাটেচলছে প্রতিমা  নিরঞ্জন! মহারাজা হতাশায়  মূহ্যমান, এবার  মা  রাজ রাজেশ্বরীর  অঞ্জলী  দিতে  পারলেন  না!বাড়ী  ফিরেও ভারাক্রান্ত  হৃদয়ে  মা  রাজরাজেশ্বরীর  জন্য  কেঁদে  কেঁদে ঘুমিয়ে  পড়লেন! হঠাৎ  স্বপ্নে  দেখলেন  এক  অপরূপা  কিশোরী  তাঁকে  বললেন," কাঁদছো  কেন  তুমি  আমাকে   কার্তিকী  নবমী  তিথিতে, সপ্তমী, অষ্টমী  ও নবমীর  পুজা  করো!" এই  বলেই  অদৃশ্য  হয়ে  গেল  তার  স্বলে  দেখা  দিলেন  হস্তির মুন্ডের  উপর  দন্ডায়মান  শ্বেত  সিংহের  উপর বসে  আছেন  ত্রিনয়না  চতুর্ভুজা,শঙ্খ, চক্র  ধনুক  ও বান  ধারিনী  এক  দেবী  তাঁর  গাত্র বরন  উদীয়মান  সূর্যের  ন্যায়!!
       ঘুম  ভাঙলেই  মহারাজা  ছুটলেন  স্বনামধন্য  তান্ত্রিক  কালীশঙ্কর  মৈত্রের  নিকট! তিনি  বিধান  দিলেন  জগদ্ধাত্রী  পুজা করার !  সেই  বছরেই  বঙ্গে  জগদ্ধাত্রী পূজার  পত্তন  হলো  কৃষ্ননগরে!
          অন্য  একটি  মত  হলো,বাংলার  নবাব  তখন  মীরকাশিম! তাঁর  সাথে  ইষ্ট  ইন্ডিয়া  কোঃ  দ্বন্দ্ব  চলছে! কৃষ্ন নগরের  মহারাজা  কৃষ্ন চন্দ্র যেহেতু  পলাশীর  যুদ্ধে  ইংরেজদের  সাহায্য  করেছিলেন তাই  তাঁকে  ইংরেজদের  পক্ষপাতিত্ব  করার  অপরাধে  বন্দী  করে মুঙ্গের দুর্গে  বন্দী করে  রাখেন! ছাড়া  পেয়ে গঙ্গা  বক্ষে  নৌকা যোগে যেদিন  তিনি  কৃষ্ননগরের  সন্নিকটে  রসুনপুরের  ঘাটে  পৌঁছান  সেদিন  বিজয়া  দশমী! দেবীর  দর্শন  করতে  না  পারায়  মন  কষ্টে  নৌকায়  ঘুমিয়ে  পড়লে  গঙ্গা  বক্ষেই  তিনি  স্বপ্নে  দেবী জগদ্ধাত্রীর  দেখা  পান  পুজা  প্রচলন  করার  নির্দ্দেশ ও!আবার  মহারাজা কৃষ্নচন্দ্রের  বংশধর  মনীশচন্দ্র  রায়ের অভিমত   বাংলার তৎকালীন  সিরাজ  ১৭৫৬  সালে  মহারাজ  কৃষ্নচন্দ্রকে  বন্দী  করেন! তাই  জগদ্ধাত্রী  পুজার  পত্তনের  সময়কাল  নিয়ে  দ্বিমত  আছে! আবার  পুজা  কে শুরু  করেছিলেেন সে  বিষয়েও  দ্বিমত  আছে! কারো  মতে  মহারাজা  কৃষ্নচন্দ্র  কৃষ্ননগরে  জগদ্ধাত্রী  পুজার  পত্তন  করেন!আবার  অন্য মতটি  হলো  চন্দননগরের  ফরাসী  সরকারের  দেওয়ান  ইন্দ্রনায়ান  চৌধুরী  ছিলেন  মহারাজ  কৃষ্নচন্দ্রের  সুহৃদ, তাঁর  পরামর্শে  রাজরোষ  থেকে  বাঁচতে  কৃষ্নচন্দ্র  চন্দন  নগরে  চলে  যান  এবং  কৃষ্নচন্দ্রের  পুত্র  শিবচন্দ্র  পুজা  করেন  মহারাজ  নবমী  তিথিতে  মায়ের অঞ্জলী  দেন! কৃষ্ননগরের  পুজা  দেখে,মোহিত  হয়ে  পরের  বছর  ইন্দ্রনারায়ন  চৌধুরী  চন্দনগরের  লক্ষীপুর  চাউল পট্টিতে  জগদ্ধাত্রী  পুজা  শুরু  করেন!
             গোপভুমে  কত  বছর পূর্বে  জগদ্ধাত্রী  পুজার  প্রচলন হয়েছে  তা  সঠিক  ভাবে  বলা  সম্ভব  নয়া! গোপভুমে  জগদ্ধাত্রী  পুজার  ব্যাপকতা নেই ! বর্তমানে  কিছু  সার্ব্বজনীন পুজা  শুরু  হলেও  পারিবারিক  পুজার  সংখ্যা  খুব  কম!
         বর্তমান  পূর্ব বর্ধমান  জেলার  গলসী  থানার  আদরাহাটী  একটি  প্রত্যন্ত  গ্রাম ! গ্রাম্য দেবতা  আদারেশ্বর  শিবের  নামে  গ্রামের  নাম করন  হয় ' আদরাহাটী '!এই  গ্রামের  বন্দ্যোপাধ্যায়  পরিবারের  জগদ্ধাত্রী পুজো  ২৮২ বছরে  পদার্পন  করল!এই  পরিবারের  বর্তমান  সেবাইতদের এক জন  মলয়  বন্দ্যোপাধ্যায়  জানালেন "তাঁদের  পরিবার  বংশানুক্রিমকভাবে  পন্ডিত  ছিলেন, সুশীল  বন্দ্যোপাধ্যায়  ছিলেন  তৎকালীন  মহা পন্ডিত! তাঁর  পুত্র  দামোদরও  ছিলেন  সংস্কৃত  পন্ডিত ! সুশীল  বন্দ্যোপাধ্যায়ের  পৌত্র  ও  দামোদরের  পুত্র  দ্বারিকা নাথ  বন্দ্যোপাধ্যায়  ছিলেন  তৎকালীন  বর্ধমান  মহারাজার কৌশলী! তিনি তিনি  ফার্সি,সংস্কৃত  ও  ইংরাজী ভাষায়  পন্ডিত  ছিলেন! " জনশ্রুতি, দ্বারিকানাথ  বন্দ্যোপাধ্যায় স্বপ্না দেশ  পেয়ে  ২৮১বছর  পূর্বে জগদ্ধাত্রী  পুজার  পত্তন করেন! অন্যমতে  কৃষ্ননগরের  মহারাজা  কৃষ্নচন্দ্রের  পুজা  থেকে  অনুপ্রানিত  হয়ে  নিজ গৃহে  জগদ্ধাত্রী  পুজার  পত্তন  করেন!
          আদরাহাটির  বন্দ্যোপাধ্যায়  জগদ্ধাত্রী  পুজা  কার্তিকী  শুক্লা  নবমী  তিথিতে  অনুষ্ঠিত  হয় ! এখানে জগদ্ধাত্রী দেবীর  দুই  পাশে  দুই  পাশে  দুই  ঋষি  অগস্ত্য ও বিশ্বামিত্র !একই  দিনে  সপ্তমী, অষ্টমী  ও নবমীর  পুজা  হয়! সপ্তমীতে  মায়ের  ভোগ  দেওয়া  হয় ,  পঞ্চ ব্যঞ্জন সহ  খিঁচুড়ি,চাটনি, অষ্টমীতে পোলাও,নবমীতে লুচি,পায়েস   মিষ্টি!
            সমাজে, অষ্টমী ও নবমী তে  ছাগ  বলি  দেওয়া  হয়! অষ্টমীতে  কালো  বর্নের  ছাগ  বলি  দিতে  হয়!
          অষ্টমীতে পুজার  অঙ্গ একটি  বিশেষ  স্ত্রী আচার  'ধুনোপোড়া ' বিশেষ  এই  স্ত্রী আচার  পালন  করেন মহিলারা  তাঁরা  মাথায়  মালসায়  ধুনো জ্বালিয়ে মন্ডপে  উপস্হিত  হয়ে অন্য  পদ্ধতিতে  আরতি  করেন! পুর্বে  শতাধিক  মহিলা  অংশ  নিলেও  বর্তমানে ১০/১২ জন  অংশ  নেন!
           নবমীতে  কুমারী  পুজার  প্রচলন  আছে! নবমীতে  হোম  হয়! কিন্তু  দেবী  জগদ্ধাত্রী এবং তন্ত্র ধারক  ও পুরোহিত যজ্ঞের  টিকা  নিতে পান  পরদিন  অর্থাৎ  দশমীতে  পরিবারের  সদস্যরা  টিকা  পরেন!
            দশমীতে  প্রতিমা  নিরঞ্জনের  পুর্বে  বিশেষ  স্ত্রী  আচার ' সুবচনী ' পালন  করা  হয়! এটি  সধবা  মহিলাদের  দীর্ঘ  এয়োতি  জীবন  অর্থাৎ  অক্ষয়  শাঁখা - সিঁদুর  কামনার  অনুষ্ঠান ! এরপর দেবীবরনের  পর  প্রতিমা  নিরঞ্জন আর  আকুল প্রার্থনা  " আবার  এসো  মা "!


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours