গৌতম দাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার, রাজ্য আবগারি দফতর ও লেখক, কলকাতা:

ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, অসম্ভব সাহসী বীর শহীদ তিতুমির ও তার বাঁশেরকেল্লা এ যেন এক রূপকথার গল্পের মতো, এই কথা গুলো ইতিহাস পড়া বা নাপড়া প্রায় সকল বাঙালীরই জানা। কে ছিলেন এই তিতুমির, কেনোই বা বানিয়েছিলেন সেই ঐতিহাসিক বাঁশের কেল্লা! সেই ছোট্ট বেলা থেকে শোনা গল্প, তিতুমির ছিলেন বৃটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে ক্ষুদিরাম, বিনয়, বাদল, দীনেশ, সূর্য সেন, প্রফুল্ল চাকী বা যতীন দাসের মতো আর একজন মহান বীরযোদ্ধা, যারা একক বীরত্বে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন দেশ মাতৃকার স্বাধীনতার জন্য, আসলে কি তাই !  সত্যিই কি শুধু বৃটিশ-বিরোধিতার জন্যই  তিতুমিরের জিহাদ শুরু হয়েছিল, নাকি হিন্দু-বিরোধিতাও জড়িয়ে ছিল! তিতুমির কি শুধু ভারতমাতাকে ভালোবেসে বৃটিশের বিরোধিতা করেছিলেন, নাকি এই দেশকে ‘দারুল ইসলামে’ রূপান্তরিত করতে গিয়েই  বৃটিশ-বিরোধিতায় জড়িয়ে পড়েছিলেন! সত্যি মিথ্যা জানতে ইতিহাসে চোখ রাখলে বা প্রচলিত গল্প থেকে যা শোনা যায়, সেই গল্পেই আসছি:-

প্রথমে তিতুমিরের পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাক, তার জন্ম হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে,1782 তে এই বাংলাদেশেই, বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনার জেলার বসিরহাটের চাঁদপুর গ্রামের এক মুসলিম পরিবারে।

তিতুমিরের পিতা ছিলেন সৈয়দ মীর হাসান আলী এবং মাতা আবিদা রোকাইয়া খাতুন। তার পরিবারের লোকেরা নিজেদের হযরত আলীর(রাঃ) বংশধর বলেও দাবি করতেন শোনা যায়। তিতুমির প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহন করেন তার নিজের গ্রামেই, মুসলিম পরিবারের সন্তান বলে স্থানীয় একটি মাদ্রাসায়ও কিছুদিন পড়াশোনা করেছিলেন, মাত্র আঠারো বছর বয়সে তিতুমির কোরানের হাফেজ-হন এবং হাদিস বিষয়ে পান্ডিত্যের কারণে বেশ সুনাম অর্জন করেছিলেন, জানা যায় কোরান-হাদীসের পাশাপাশি তিতুমির বাংলা, আরবি ও ফারসি ভাষায়ও বিস্তর পড়াশোনা করে ছিলেন। চল্লিশ বছর বয়সে তিতুমির মক্কায় পবিত্র হজ পালনের উদ্দেশ্যে গিয়েছিলেন।                                            এবারই সেই লোকশ্রুতি বিতর্কের সূত্রপাত:-    উদারপন্থী মোগল সম্রাট আকবরের মৃত্যুর পর সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে শায়খ আহম্মদ শিরহিন্দি নামের এক ইসলামি কট্টরপন্থীর উদয় হয় ভারতবর্ষে, যিনি নিজেকে ‘মুজাদ্দিদে আলফে সানি’ বলে দাবি করতেন। ভারতে পরিপূর্ণ ইসলাম এসেছিল সুফিদের মাধ্যমে, সুফিরা যে পরিপূর্ণ ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করেছিলেন, ভারতে এসে ক্রমশ তা হিন্দু ধর্মের সঙ্গে মিশে গিয়ে ইসলামের আদি ও স্বতন্ত্র রূপ ধরে রাখতে পারেনি বরং কিছু হিন্দু সংস্কৃতিকেও গ্রহণ করে ফেলতে হয়েছিল ইসলামকে, ফলে আরবের উর্দু ইসলাম আর ভারতের নতুন মিশ্র ইসলামের মধ্যে একটা তফাৎ তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু প্রচণ্ড হিন্দু বিদ্বেষী এই 'শায়খ আহম্মদ' ভারতের এই নতুন মিশ্র বা সমন্বয়ধর্মী ইসলামকে ইসলাম বলে স্বীকার করতে চাননি, তাই তিনি এই নতুন জন্ম নেওয়া মিশ্র বা সমন্বয়ধর্মী ইসলামের বিলুপ্তি ঘটিয়ে নতুন করে আরবীয় ইসলামের প্রতিষ্ঠা করতে স্বচেষ্ট হয়েছিলেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ ভারতবর্ষে শরিয়ত-ভিত্তিক এক গোঁড়া সুফিবাদের প্রবর্তন করে  সাম্প্রদায়িকতার আগুন জ্বালাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তার মৃত্যু তে সেই কাজ তিনি সম্পন্ন করে যেতে পারেননি, কিন্তু তার মৃত্যুর পর আরও এক কট্টরপন্থীর শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভি নিভে যাওয়া সাম্প্রদায়িকতার আগুনকে  নতুন করে খুচিয়ে আবার জ্বালানোর চেষ্টা শুরু করেছিলেন এবং বলা বাহুল্য তিনিও ছিলেন কট্টরপন্থী আরবিয় ইসলামের সমর্থক। মনে রাখতে হবে মোগল আমলের সম্রাটগণের মধ্যে একমাত্র আওরঙ্গজেব ছাড়া আর কেউই কিন্তু হিন্দুদের কাফের আক্ষা দিয়ে দমন করতে চান নি, কিন্তু ওয়ালিউল্লাহ দেহলভি প্রথম থেকেই ভারতকে  ‘দারুল ইসলামে’ পরিণত করতে চেয়েছিলেন যদিও  তার আশা পূরণ হওয়ার আগেই তার মৃত্যু হয়, এরপর তার অসমাপ্ত কাজের দায়িত্ব নেন সায়িদ আহমদ বেরলবি নামের আর এক কট্টরপন্থী, এবং তার সেই আন্দোলন ইতিহাসে ভারতীয় ওয়াহাবি আন্দোলন নামে পরিচিত, উগ্র জেহাদি সংগঠন তৈরী  করে হিন্দু ধর্ম তথা পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা এবং বিশ্বজুড়ে ইসলামী রাজত্ব কায়েম করবার বিষয়ে চরম আত্মবিশ্বাসী ছিলেন তিনি। দুর্ভাগ্যের বিষয় ‘দারুল ইসলাম’ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বালাকোটের যুদ্ধে মর্মান্তিক ভাবে তার মৃত্যু হয়েছিল। এইবার সেই বিতর্কিত গল্পে আসছি, তিতুমিরের কথা বলতে গিয়ে কেন এত অতীত ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি!
সেই সায়িদ আহমদ বেরলবি যখন হজ্বযাত্রার পথে কলকাতায় আসেন তখন অনেক বাঙালিই তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন, এবং এই নতুন শিষ্যদের মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন বারাসাতের মীর নিসার আলী ওরফে তিতুমির। ছোটবেলা থেকেই অসীম সাহসী আর বাহুবলী ছিল তিতুমির, পেশাদার কুস্তিগীর ছিলেন তিনি, প্রথম জীবনে কিছুদিন নদীয়ার এক হিন্দু জমিদারের অধীনে লাঠিয়াল সর্দার ছিলেন, এবং সর্দারি করতে গিয়ে আটক হয়ে, কারাদণ্ড ও ভোগ করেন। তারপর মেয়াদ শেষে যশোহর-জেল থেকে বেরিয়ে তিনি বেরলবির ‘তরিকায়ে মুহম্মদিয়া’য় যোগ দেন। এই তিতুমিরের হাত ধরেই পরবর্তীকালে শিরিয়তী বিচ্ছিন্নতাবাদী ইসলামের প্রবেশ ঘটে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই বাংলাদেশে। এর আগে উনিশ শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত বাংলাদেশে একটা সুন্দর মিশ্র সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কৃতির আবহাওয়া ছিল। জীবনযাত্রা বা ধর্মাচরণের মধ্যে অনেক বৈসাদৃশ্য থাকলেও হিন্দু-মুসলমানরা মূলত "এক জাতি এক প্রাণ-আমরা বাঙালি" হিসেবেই মিলে মিশে সেই বাংলাদেশে বসবাস করতো। ধর্ম নিয়ে কখনও কোনো বিভেদ ছিল না, গ্রামীণ মুসলমানদের মধ্যে তখনও পর্যন্ত এইসব জেহাদি-তত্ত্ব প্রবেশ করেনি, তাদের আচার-আচরণ চেহারা, পোশাক-আসাক খাদ্যাভ্যাস কোনো ভাবেই হিন্দুদের থেকে বেশী আলাদা ছিল না। দাড়ি রাখা নিয়েও সেরকম বাছবিচার ছিল না, বোরখার ও সেভাবে প্রচলন ছিল না। একটিও আরবি শব্দের অর্থ না জেনেই নামাজ পড়ত তখনকার সিংহভাগ বাঙালি মুসলিম। পীর-ফকিরের বাংলার চিরন্তন মুসলিম লোকসংস্কৃতিই মুলত তখন তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ছিল। তিতুমির প্রথমে তার নিজের এলাকায় ওয়াহাবিদের নিয়ে একটা দল গঠন করলেন, তারপর স্থানীয় মুসলমানদের বাধ্য করলেন নাম পরিবর্তন করতে, আরবিয়দের মতো জোব্বা পরতে এবং দাড়ি রাখতে। উল্লেখ করা যেতে পারে স্থানীয় মুসলমানরা বরাবর মহরমের দিনে স্থানীয় দরগাতে ‘নজর’ দিত, তিতুমির এর বিরোধিতা করেন, তারাগানিয়া গ্রামে তিতুমিরের অনুসারীরা মহরম অনুষ্ঠানে বাধা দেওয়ায়, স্থানীয় মুসলমানরা জমিদারের কাছে নালিশ জানায়, স্থানীয় জমিদাররা এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার কারণেই প্রথম শুরু হয়ে যায় জমিদারের সঙ্গে তিতুমিরের বিবাদ, এবং এই সংঘর্ষ যখন চরমে পৌছোয়, ইংরেজ সরকার সংঘর্ষ আর রক্তপাত  থামাতে হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয়, হয়তো ইংরেজদের পোষা জমিদারদের অনুরোধেই ইংরেজরা প্রথমিক ভাবে এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেছিল। এরপর মামলা হয় তিতুমির ও তার অনুগামী বাহিনীর বিরুদ্ধে। আর এইভাবেই ইংরেজরা   তিতুমিরের চিরশত্রু হয়ে গেল! এখনও পর্যন্ত তিতুমিরের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস খুজে পাওয়া যায়নি কিন্তু!

এবার একটু বাঁশের কেল্লার  গল্প:- আজকের এই বারাসাতের কাছেই বাদুড়িয়া থেকে দশ কিলোমিটার দূরে,  নারিকেলবাড়িয়া গ্রামে মৈজুদ্দিন বিশ্বাসের জমিতে সামান্য বাঁশ আর কাদা দিয়ে তিতুমির ও তার অনুগামী বাহিনীর লোকজন নির্মাণ করেন দ্বি-স্তর বিশিষ্ট এই কেল্লা, সেটাই ‘বাঁশের কেল্লা’ নামে পরবর্তী কালে বিখ্যাত হয়ে যায়। এরপর সেই কেল্লায় অস্ত্রশস্ত্র মজুদ করতে শুরু করে তিতুমির, ওই কেল্লা থেকেই তিতুমির ডাক দিয়েছিলেন বৃটিশ বিরোধী আর একই সাথে হিন্দু বিরোধী আন্দোলনের। জনশ্রুতি আছে যেদিন আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন তিতুমির সেই দিনই তার অনুগামীরা পুঁড়ার বাজার আক্রমণ করে মহেশ চন্দ্র ঘোষ নামের এক ব্যক্তির একটা গরু জোর করে নিয়ে এসে, সেটি স্থানীয় একটি মন্দিরের সামনে জবাই করে সেই রক্ত ছিটিয়ে দেয় মন্দিরের গায়ে, তারপর লুট করেছিল অসংখ্য হিন্দুবাড়ি, তাই অনেকেই মনে করেন, তার জিহাদ যদি শুধু ইংরেজদের বিরুদ্ধে বা স্বাধীনতা সংগ্রামের উদ্দেশেই হতো  তাহলে হিন্দুদের উপর এই অত্যাচার হতো না! তিতুমিরের এই সাম্প্রদায়িক জেহাদি কর্মকাণ্ড আর তার শক্তিশালি হয়ে ওঠা কে স্বাভাবিক ভাবেই ভালো চোখে দেখেনি ব্রিটিশ সরকার, তাই তার বিরুদ্ধে  ব্যবস্থা নিতে তৎপর হয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক আর লেফটেন্যান্ট কর্নেল স্টুয়ার্টের নেতৃত্বে শেষপর্যন্ত ইংরেজ বাহিনীর গোলার আঘাতে ধ্বংস হয়ে যায় তিতুমিরের স্বপ্নের বাঁশের কেল্লা, মারা যান তিতুমির আর তার অনেক সঙ্গী। ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ দিয়ে তিতুমিরের জীবন শেষ হলেও বাংলাদেশের ধর্ম নিরপেক্ষ তৎকালিন নাগরিকরা তিতুমিরকে কিছুতেই শুধুমাত্র একজন মহান ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী বা স্বাধীনতা সংগ্রামী বলে মেনে নেয়নি! তবুও 'তিতুমির আর তার বাঁশের কেল্লা' নিয়ে তর্ক বিতর্কের অনেক ইতিহাস থেকেই যায়, তিতুমীরের প্রথমিক লক্ষ্য ও পথ যদিও ছিল শুধুমাত্র ইসলামে পরিপূর্ণ, তবুও একথা অনস্বীকার্য যে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়েরই অত্যাচারীত কৃষকদের সাথে নিয়ে ইংরেজ মদতপুষ্ট জমিদার ও নীলকরদের বিরোধিতা করাই শেষপর্যন্ত হয়ে উঠেছিল তার অন্যতম লক্ষ্য তাই তিতুমিরের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু হিন্দুদের জমিদারদের পাশাপাশি ধনী মুসলমানও ছিল। মতান্তর থাকলেও এটাও সত্যি অর্থ আর লোকবল সংগ্রহ করে তিনি হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন বিতর্কিত এক সম্রাট তবু অনেকের মতে তিতুমিরের এই সংগ্রাম ছিল প্রকৃত কৃষক বিদ্রোহ, যার প্রধান উদ্দেশ্যেই ছিল অত্যাচারী জমিদার ও ইংরেজ শাসকদের হাত থেকে গরীব-অত্যাচারিত কৃষকদের রক্ষা করা। তিতুমির কিছুটা হলেও  হয়তো পেরেছিলেন অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের নতুন ভাষার জন্ম দিতে তাই হয়তো তিতুমিরের মতো সাহসী একজনের হাত ধরেই বাংলার গরিব কৃষকরা একদিন মুক্ত হতে চেয়েছিল অত্যচারী জমিদার আর ইংরেজদের অন্যায় শাসনের হাত থেকে।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours