গৌতম দাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার, রাজ্য আবগারি দফতর ও লেখক, কলকাতা:

অবন ঠাকুরের রাজকাহিনীতে রানী পদ্মিনী আর আলাউদ্দিন খিলজীকে নিয়ে একটা ছোট্ট সুন্দর অধ্যায় আছে, হয়তো সেখান থেকেই প্রথম বাঙালি মনে স্বপ্ন-সুন্দরী পদ্মিনীর গল্প মনে গেঁথে গেছিলো, কিন্তু সত্যিই কি রানী পদ্মিনীর গল্প কোনো ইতিহাস ভিত্তিক ঘটনার উপর দাঁড়িয়ে আছে, নাকি নিছকই এক রূপকথার গল্প মাত্র! আসলে এই পদ্মিনীর কাহিনী অনেকটাই কবি মালিক মুহম্মদ জাইসির লেখা 'পদ্মাবৎ' কাব্যের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, যা ওই সময়কালের প্রায় 250 বছর পর লেখা, যাইহোক এবার একটু সেই চিত্তাকর্ষক কাহিনীতে আসি:-                    রাজস্থানের মেওয়ারের এক রাজা ছিলেন রাজপুত বংশিয় রাওয়াল রতন সিং, রতন সিং এর প্রথম রানী ছিলেন নাগমতি। সেই সময়েই উত্তর ভারতের হরিয়ানার সিংঙ্ঘাল মতান্তরে সিংহলের রাজকন্যা ছিলেন পরমাসুন্দরী পদ্মাবতি, যার সৌন্দর্য ছিল কিংবদন্তির মতো ছড়িয়ে গেছিলো সেই সময়। এই রাজকুমারী পদ্মাবতি সেকালের হিন্দু রাজবংশের পরম্পরা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন তিনি স্বয়ংবর সভায় প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যোগ্যতম রাজপুত্রের গলায় বরমাল্য তুলে দেবেন।  পদ্মাবতির রুপে মুগ্ধ হয়ে রাজা রতন সিং নিজের মা এবং নিজের প্রথমা-স্ত্রী রানী নাগমতির প্রবল আপত্তি সত্তেও রাজকন্যা পদ্মাবতির সেই স্বয়ংবর সভায় যোগ দেন, তারপর অন্যান্য আগত রাজা ও রাজপুত্রদের পরাজিত করে পদ্মাবতিকে জিতে নেন এবং বিবাহ করেন। চিতোরগড়ের রানী হওয়ার পর এই পদ্মাবতিরই নামই হয় পদ্মিনি।

রাজপূতরা জন্মগত ভাবেই বীর এবং যোদ্ধা জাতি, কিন্তু ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র বিচ্ছিন্ন রাজ্যে বিভক্ত হওয়ার কারণে উন্নত যুদ্ধ কৌশলের অধিকারী দিল্লির মুসলমান সম্রাটদের বাহিনীর সাথে বীরের মত লড়েও বারবার তাঁরা হার মানতে বাধ্য হয়েছে, অবশ্য হার মানলেও সুলতানি আমল বা মোঘল আমল কোন সময়ই রাজপুতদের সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত করে রাখা সম্ভব হয়নি, তাই মুসলমান শাসকদের চক্ষুশূল হিসেবেই রাজপুতদের পরিচয় রয়ে গেছে ইতিহাসের পাতায়। এই রানী পদ্মিনীর রোমাঞ্চকর কাহিনীও তেমনই এক অস্থির সময়ের। যে কোন প্রচলিত ঐতিহাসিক ঘটনা কতটা সত্যি আর কতোটা গল্প  তার নিশ্চয়তা দেওয়া কখনই সম্ভব নয়! তবু শোনা যাক সেই রোমাঞ্চকর কাহিনী, সেই রাজা রতন সিং যেমন সৌন্দর্যের পূজারী ছিলেন তেমনই গুনির গুনের কদর করতেও  জানতেন, তার রাজসভায় ঠাঁই পেয়েছিলেন বহু জ্ঞানী-গুনী সভাসদ, তাদেরই একজন ছিলেন বাঁশি-বাদক রাঘব চেতন। এই রাঘব চেতনের বিরুদ্ধেই একবার অভিযোগ পাওয়া গেল তিনি গোপনে তন্ত্র-সাধনা করছেন লোকজনের অনিষ্ঠ করার উদ্দেশ্যে। অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ হলে, রাজা এই রাঘব চেতনকে শাস্তি হিসেবে চুন-কালি মাখিয়ে গাধার পিঠে চাপিয়ে রাজ্য থেকে বের করে দিলেন, আর এখান থেকেই কিন্তু শুরু হয় এক অবিস্মরনীয় চক্রান্তের কাহিনী যা শেষ হয় চিতোরগড়ের প্রথম জওহরের ঘটনা দিয়ে, রানী পদ্মিনীর নের্তৃত্বে রাজপরিবারের সব মহিলা-শিশুর অগ্নিকুন্ডে আত্মহুতির মাধ্যমে। 

বংশীবাদক রাঘব এই চরম অপমান সহজে মেনে তো নেয়ইনি বরং এর নির্মম প্রতিশোধ নেবার জন্য এক ভয়ংকর পরিকল্পনা করে, 'বলা যায় কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে' রওনা দেয় দিল্লীর অভিমুখে, দিল্লীর সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী তখন দলবল সমেত শিকারে এসেছেন, গান বাজনার ভক্ত সুলতানকে রাঘব তার চাতুরি আর মায়াবী বাঁশির সুরে মুগ্ধ করে, কৌশলে আলাউদ্দিনের রাজ-দরবারে যোগ দেওয়ার সুযোগ করে নেয়, আর এটাই ছিল রাঘবের একমাত্র পরিকল্পনা। এরপর সুযোগ মতো সুলতানের কাছে রানী পদ্মিনীর রুপের এমন অতি-বর্ননা করা শুরু করে দিলেন যে সুলতান সুন্দরী পদ্মিনীকে তার হারেমে নিয়ে আসার জন্য পাগল হয়ে ওঠেন। সুলতান আলাউদ্দিন সিদ্ধান্ত নিলেন মেওয়ার অভিযানের, বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে আলাউদ্দিন যাত্রা করলেন মেওয়ারের রাজধানী চিতোরের উদ্দেশ্যে, কিন্তু চিতোরের কাছে এসে সুলতান বুঝতে পারলেন কাজটা খুব একটা সহজ নয়। ছোট্ট পাহাড়ের ওপর অবস্থিত 'চিতোরগড়' এক দূর্ভেদ্য দূর্গ, বাইরে থেকে আক্রমণ করে ধ্বংস করা খুব একটা সহজ কাজ নয়। এরপরই চতুর সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী আশ্রয় নেন অন্যায়  কৌশলের, তিনি রাজা রতন সিং এর কাছে দূত মারফত বার্তা পাঠালেন 'দূর্গ দখল কিংবা রাজ্য-হরনের তার কোন ইচ্ছা নেই, তিনি কেবল তার বোনের মত রানী পদ্মিনীকে এক পলক দেখেই চলে যাবেন'। এই ঘটনায় রতন সিং পড়ে গেলেন মহা সমস্যায়, একদিকে বীর রাজপুতদের আত্মসম্মানের প্রশ্ন, অন্যদিকে সুলতানের শক্তিশালী বিশাল বাহিনীর হুমকি, চিতোরগড় দূর্গ যতোই দূর্ভেদ্য হোক না কেন, সুলতান বাহিনী যদি দীর্ঘ দিন ধরে দূর্গ অবরোধ করে বসে থাকে, তাহলে শেষপর্যন্ত এক সময় না এক সময় তাকে সরাসরি যুদ্ধে যেতেই হবে, আর বিশাল সুলতান বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে তাদের জেতা কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। শেষপর্যন্ত প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও শুধুমাত্র প্রজাদের প্রানরক্ষা করার জন্য রাজা রতন সিং রাজী হয়ে গেলেন সুলতানের প্রস্তাবে। এদিকে রানী পদ্মিনী এই কথা জানতে পেরে, তিনি তখন আবার একটি শর্ত দিয়ে বসলেন যে সরাসরি সুলতানকে দেখা দেওয়া তার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়, সুলতান কেবলমাত্র আয়নায় তার প্রতিচ্ছবি ই দেখতে পারেন। সুলতান আলাউদ্দিন রাণী পদ্মিনীর এই শর্ত ই মেনে নিয়ে, কিছু সঙ্গীসাথী নিয়ে কেল্লায় প্রবেশ করলেন, এবং নিজের কথামতো রানী পদ্মিনীও তার মহলের আয়নায় সুলতানকে দেখা দিলেন, সেই এক ঝলক দেখাই কাল হলো পদ্মিনীর এবং চিতোরগড়ের জন্য!  সুলতান রানী পদ্মিনীর রূপে পাগল হয়ে গেলেন, এবং মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন, যে কোনো ভাবেই হোক এই পদ্মিনীকে তার হারেমে নিয়ে আসবেন! 
এরপর সুলতান আর অন্যান্য অতিথিদের বিদায় জানাতে রীতি অনুযায়ী রাজা রতন সিং যখন সুলতানের সাথে কিছুটা পথ এগিয়ে দিতে এলেন, তখন সুযোগ বুঝে আচমকা রতন সিংকে অন্যায় ভাবে বন্দী করে সুলতান তার শিবিরে নিয়ে গেলেন, এরপর চিতোরগড়ে খবর পাঠালেন পরদিন সকালের মধ্যে রানী পদ্মিনীকে তার শিবিরে পাঠিয়ে দিলে তবেই তিনি রাজা রতন সিংকে মুক্তি দেবেন। চিতোরগড়ের বীর রাজপুতরা পাড়লেন মহা সংকটে, একদিকে তাদের রাজার প্রাণ রক্ষা করতে হবে নাহলে সুলতানের অসম্মানজনক এই প্রস্তাবে রাজী হতে হবে। এই মহা-সংকটে বীরের মত এগিয়ে এলেন রাজা রতন সিং এর দুই কিংবদন্তি বীর সেনাপতি 'বাদল' এবং 'গোরা' ,  তারা একটি অত্যন্ত গোপন পরিকল্পনা করলেন এবং দূত মারফত সুলতানের শিবিরে খবর পাঠালেন যে তারা সুলতানের প্রস্তাবে রাজী আছেন, রানী পদ্মিনীকে পরদিনই সুলতানের শিবিরে পৌছে দেওয়া হবে, শুধু রানী পদ্মিনীর সম্মান রাখতে তার সঙ্গে থাকবে তার দেড়শো সখী। কথা অনুযায়ী পরদিন ভোরে চিতোরগড় থেকে রওনা হল পঞ্চাশ পালকীর এক বিশাল বহর, দেড়শো সখী সমেত রানী পদ্মিনী শেষপর্যন্ত চলেছেন সুলতানের শিবিরে নিজকে সমর্পন করে রাজা রতন সিং এর জীবন রক্ষা করতে! কিন্তু আসলে সেই সব পালকির ভেতর রানী বা সখী কেউই ছিল না, ছিল বীর দুই সেনাপতি গোরা ও বাদলের নের্তৃত্বে বাছাই করা দূর্ধষ সব রাজপূত যোদ্ধা, সুলতান শিবিরে পৌছেই তারা অপ্রস্তুত সুলতান বাহিনীকে কিছু বুঝে ওঠার আগেই আক্রমণ করে, সুলতানের বাহিনী ও তার অধিকাংশ দেহরক্ষীদের হত্যা করে রাজা রতন সিংকে মুক্ত করে ফেলেন গোরা বাদল,  তারপর একটি ঘোড়ায় চড়িয়ে রাজা রতন সিং কে কেল্লার দিকে রওনা করিয়ে দেওয়া হয়, এমনও শোনা যায় মহাবীর গোরা সুলতান আলাউদ্দিন খিলজীকে হত্যা করার সুবর্ণ সুযোগ পেয়েও হাতছাড়া করেন! যখন গোরা অরক্ষিত সুলতানের সামনে পৌছোয়, সে সময় ধূর্ত সুলতান কাপুরুষের মতো তার রক্ষিতাদের নিজের সামনে আড়াল করেন বাঁচার জন্য, বীর রাজপুত যোদ্ধা গোরা মহিলাদের শরীরে আঘাত করতে অস্বীকার করলে, সুলতানের দেহরক্ষীরা অন্যায় ভাবে সেই সুযোগে গোরাকে হত্যা করে, যদিও অন্য সেনাপতি বাদল নিরাপদেই রাজা রতন সিংকে উদ্ধার করে চিতোরগড়ে পৌছে যান।     সুলতান আলাউদ্দিন এরপর চরম ক্রোধে ফেটে পড়লেন, তার বাহিনীকে চিতোরগড় আক্রমণের হুকুম দিলেন, দিনের পর দিন ধরে আক্রমণ করেও দুর্ভেদ্য চিতোরগড় দখল করতে না পেরে, সুলতান বাহিনী শেষপর্যন্ত দূর্গ অবরোধ করে রাখে চারদিক থেকে। রাজপুতরা যতই দূর্ধষ যোদ্ধা আর চিতোরগড় যতোই দূর্ভেদ্য হোক না কেন, দূর্গের ভেতরের খাদ্য বা অন্যান্য রসদের সরবরাহ ফুরিয়ে গেলে তাদের প্রতিরোধও শেষ হয়ে যাবে, এবং একদিন এলো যখন দূর্গের ভেতরের প্রায় সব খাবার ফুরিয়ে এলো, সরাসরি যুদ্ধ করা ছাড়া তাদের হাতে তখন আর কোন পথই খোলা ছিলো না। দিনের পর দিন অবরুদ্ধ থাকার পর রাজা রতন সিং বাধ্য হয়ে সিদ্ধান্ত নেন দুর্গের ফটক খুলে মুখোমুখি যুদ্ধ করার। দীর্ঘদিন অবরুদ্ধ থাকতে থাকতে প্রায় অভুক্ত আর দুর্বল হয়ে যাওয়া রাজপুতদের পক্ষে এরপর সুলতান বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ ছিল শুধুমাত্র সম্মান রক্ষার সম্পূর্ণ এক অসম যুদ্ধ। রানী পদ্মিনী এবং দুর্গের অন্যান্য রাজপুত নারীরাও বুঝতে পেরেছিলেন যে এই যুদ্ধে তাদের পুরুষদের জয়ের সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ, বা যুদ্ধ জয় অসম্ভব।  এই পরিস্থিতিতে আত্মসম্মান রক্ষার জন্য রাজপুত নারীদের মধ্যে ‘জওহর’ নামক আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহননের এক রকম প্রথার প্রচলন ছিল, সুলতান আলাউদ্দিন খিলজীর মুসলিম সৈন্যদের হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার থেকে সম্মানজনক মৃত্যুবরণ করাকেই তারা বেশি সুখকর মনে করেছিলেন, তাই তাঁরা 'জওহর' এর সিদ্ধান্ত নিলেন একসাথে।  তারপর গভীর রাতে দুর্গের ভেতরে জ্বালানো হয় এক বিশাল অগ্নিকুন্ড,  দুর্গের সমস্ত বীরাঙ্গনা রাজপুত নারীরা নিজেদের সুন্দর পোষাকে আর অলঙ্কারে সুসজ্জিত করে ধর্মীয় সঙ্গীত গাইতে গাইতে সতীত্ব আর আত্মসম্মান রক্ষা করতে সেই লেলিহান অগ্নি কুন্ডের দিকে অগ্রসর হলেন, প্রথমে রানী পদ্মিনী ও তারপরে একে একে বাকী রাজপুত নারীরাও অগ্নি কুন্ডে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করলেন। এরপর স্বজনহারা রাজপুত সৈনিকদের বেঁচে থাকার আর কোনো উপলক্ষ্যই থাকলো না। পরদিন সকালে রাজপুত কেশর রঙের গৈরিক যুদ্ধের পোশাকে সুসজ্জিত হয়ে বীরের মতো খিলজী বাহিনীর সাথে অসম্ভব বা বলা যায় অসম লড়াই লড়তে বেরিয়ে যায় রাজপুত সৈন্যদের দল, তারপর যা হবার তাই হলো, অধিকাংশ সৈন্য প্রাণ হারালেন আর জীবিতরা বন্দি হলেন। কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাস, খিলজীর সেনাদল যখন যুদ্ধ জয়ের উল্লাসে মত্ত হয়ে চিতোরগড় দুর্গে প্রবেশ করল, তখন সেখানে শুধু নারীদের দেহাবশেষ আর ভস্মই তারা খূঁজে পেলো! আর যার মোহে এতো জনবল ক্ষয় করলেন আলাউদ্দিন খিলজী, সেই পদ্মিনীকে তার আর কোনোদিন জীবিত অবস্থায় পাওয়া হয় হলো না!

এই রোমাঞ্চকর কাহিনীর সত্যতা নিয়ে সন্দেহের মুল কারন, এই কাহিনীতে যেমন অনেক অসঙ্গতি খুঁজে পাওয়া যায় তেমনি ইতিহাসে পদ্মিনীর এই উপাখ্যানের বর্ণনাও সঠিক ভাবে পাওয়া যায় না। যেমন বিতর্ক আছে জায়সির ভাষ্য অনুযায়ী যে আয়না আলাউদ্দিন নিজেই দিল্লী থেকে বহন করে নিয়ে এসেছিলেন এবং যেটা ব্যাবহার করেই দুরথেকে রানীর প্রতিচ্ছবি দেখেন, দিল্লী থেকে এই আয়না বয়ে আনা ছিল সেই যুগে খুবই কঠিন বা অসম্ভব কাজ, তাই এই ঘটনা বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে কেউ কেউ দাবী করেন, তাছাড়া যে সময়কালের কাহিনী এটা সে সময়ে ভারতবর্ষে আদৌ আয়নারই চলই শুরু হয়নি বলে জানা যায়, আরও অনেক পরে ভারতবর্ষে আয়নার প্রচলন হয়, যদিও একটি প্রচীন আয়না জীর্ণ অবস্থায়  এখনো দেখতে পাওয়া যায় চিতোরগড়ের পদ্মিনীর মহলে। জয়সির ভাষ্য অনুযায়ী জওহরের ঘটনাটাও ভিন্নভাবে এসেছে, তার কাব্যে আলাউদ্দিন খিলজী রতন সিংকে বন্দী করে দিল্লী নিয়ে যায়, এই সুযোগে আবার পাশের রাজ্যের রাজা দেবপাল রানী পদ্মিনীর প্রতি আকৃষ্ট হন, আরও আশ্চর্য ঘটনা বা বর্ণনা যেটা, এরপরই গোরা আর বাদল দিল্লী গিয়ে সুলতানের খপ্পর থেকে রতন সিংকে মুক্ত আনেন, তারপর ফিরে এসে রতন সিং আবার সেই দেবপালের রাজ্যে হানা দেন এবং দেবপালকে হত্যা করে নিজেও যুদ্ধে নিহত হন, এবং এই সংবাদ শোনার পরই নাকি রানী পদ্মিনী জওহরের পথ বেছে নেন! এই কাহিনীও বেশ সেন্দহজনক বিশেষত গোরা আর বাদলের পক্ষে দিল্লী হানা দিয়ে রতন সিংকে উদ্ধার করা অনেকটা অবাস্তব গল্পের মতো, রাজপুতদের সেই শক্তি বা ক্ষমতা কোনোটাই ছিল না যা দিয়ে দিল্লিতে গিয়ে লড়াই করে বা কৌশলে সুলতান বাহিনীকে পরাস্ত করে বা তাদের চোখে ধুলো দিয়ে এই ঘটনা ঘটানো সম্ভব! তাই দিল্লির শক্তিশালী সুলতানের হাত থেকে রতন সিং এর উদ্ধার পর্বও প্রায় অসম্ভব আর বেশ নাটকীয়, যুক্তিসম্মতও নয়! আবার অনেকেই মনে করেন রক্ষনশীল রাজপূত রাজপরিবার কখনোই নিজের ঘরের মহিলাকে বাইরের লোক, তাও আবার মুসলমান সুলতানকে দেখাতে রাজি হবে এটাও সম্ভব ছিলো না!

এই কাহিনীর সত্যতা আজ আর নতুন করে প্রমাণ করা সম্ভব নয়।  সুলতান আলাউদ্দিন খিলজীর দরবারের ইতিহাসবিদ আমির খসরুর লেখা থেকেও শুধু এই টুকুই জানা যায় যে আলাউদ্দিন খিলজী বীর রাজপুত রাজা রতন সিং কে হারিয়ে চিতোরগড় দূর্গ দখল করেছিলেন, কিন্তু তার লেখায় রানী পদ্মিনীর কোন উল্লেখ নেই। আবার আকবরের বিখ্যাত সভাসদ আবুল ফজল এবং প্রখ্যাত মধ্যযুগীয় ঐতিহাসিক ফিরশতার লেখায় পদ্মিনীর জীবনের কাহিনী পাওয়া গেলেও তা কিঞ্চিত পরিবর্তিত রুপে পাওয়া যায়। পদ্মাবতির বা পদ্মিনীর এই কাহিনী প্রথম লিখিত আকারে প্রকাশ হয়  বিখ্যাত মধ্যযুগীয় কবি মালিক মুহম্মদ জায়সির লেখা পদ্মাবৎ কাব্যে, জায়সি ইতিহাসবিদ ছিলেন না, ছিলেন একজন কবি, তাই তার রচনাকে পুরোপুরি ইতিহাস বলে গ্রহন করা যায় না, তাই অনেকেই সন্দেহ পোষন করেন যে রানী পদ্মিনী বলে আদতে হয়তো কেউ ছিল না, পদ্মিনী নেহায়েতই কবির কল্পনা! তবে রাজপূত ইতিহাসে পদ্মিনীর নাম যে একেবারে নেই এটাও পুরোপুরি সঠিক নয়, রাজপূত ইতিহাস গ্রন্থ খুমান খায়সায় এই রানী পদ্মিনীর কাহিনী কিছুটা স্থান পায় রানা প্রতাপের আমলে, 1572 থেকে 1597 এর কোন এক সময় এই ইতিহাস লেখা হয়, অর্থাৎ ওই সময়কালের অনেক পরে, যখন অনেক কাহিনীই বিস্মৃতির কারণে জনশ্রুতিতে পরিণত হয়েছে! অনেকে তাই এমনও মনে করেন পদ্মিনীর পুরো কাহিনীটাই রাজপুতদের বীরগাঁথার কল্পিত এক লোককাহিনী।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours