দেবর্ষি মজুমদার, লেখক, বীরভূম:

'টাইট নাট শেষন' - যিনি সবাইকে 'টাইট' দিতেন, দেশের সেই প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার টিএন সেশন প্রয়াত হলেন রবিবার রাত সাড়ে ৯ টা নাগাদ চেন্নাইতে নিজের বাড়িতে। গত বেশ কয়েক বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন তিনি। মৃত্যুকালে তাঁর তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর।

১৯৫৫ ব্যাচের তামিলনাড়ু ক্যাডারের আইএএস অফিসার ছিলেন সেশন। ১৯৮৯ সালে ক্যাবিনেট সচিবের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। অবসরের পরে ১৯৯০ সালের ১২ ডিসেম্বর থেকে ৯৬ সালের ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন সেশন। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় একাধিক সংস্কার করেছিলেন তিনি। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করে তোলেন। ভোটার পরিচয়পত্র দিয়ে ভোটদান তাঁর আমলেই চালু হয়। ভোট প্রার্থীদের নির্বাচনী আদর্শ আচরণ-বিধিও তাঁরই অবদান।

এম এস গিল, যিনি পরে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হয়েছিলেন, তিনি বলছেন, "মি. শেষনের সব থেকে বড় অবদান এটাই যে তিনি নির্বাচন কমিশনকে 'সেন্টর স্টেজে' নিয়ে এসেছিলেন। তার আগে কেউ তো মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের নামই জানত না। আর প্রত্যেকেই নির্বাচন কমিশনকে হেলাফেলা করে চলতো।"

নির্বাচন কমিশনে একাধিক সংস্কার করেছিলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা প্রাক্তন আএএস অফিসার টি এন সেশনের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেন। টুইটে প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, ‘নির্বাচনী সংস্কার টি এন সেশনের সাহসী পদক্ষেপের জন্যই সম্ভব হয়েছে। তাঁর সিদ্ধান্তের জন্যই ভারতের গণতন্ত্র শক্তিশালী ও অংশগ্রহণমুখী হয়েছে।’

একমাত্র টি এন শেষন বলতে পেরেছিলেন, "আমি স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছিলাম, আমি ভারত সরকারের অংশ নই।"

রাজীব গান্ধী নিহত হওয়ার পরেই সরকারের সঙ্গে কোনও আলোচনা না করেই তিনি লোকসভা নির্বাচন বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

শীর্ষ আমলাদের শাস্তির মুখে পড়তে হয়েছিল তাঁর আমলে ১৯৯২ সালের গোঁড়ার দিক থেকেই ভুল করলেই সরকারি অফিসারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেন তিনি। এদের মধ্যে যেমন কেন্দ্রীয় সরকারের সচিবরা ছিলেন, তেমনই ছিলেন নানা রাজ্যের মুখ্য সচিবরাও।

একবার নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের যুগ্ম সচিব মি. ধর্মরাজনকে কড়া শাস্তি দেওয়াটাই উচিত ছিল। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সেই রাস্তায় না হেঁটে তার চাকরিজীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ নথি - কনফিডেন্সিয়াল রিপোর্টে এই গুরুতর বিষয়টির উল্লেখ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন," ওই আদেশে লিখেছিলেন মি. শেষন।

কনফিডেন্সিয়াল রিপোর্ট একজন সরকারি চাকুরের কাছে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ নথি, যা দিয়ে তাদের পদোন্নতি নির্ভর করে।

১৯৯৩ সালের ২রা অগাস্ট টি এন শেষন একটা ১৭ পাতার নির্দেশ জারি করে। লেখা হয়, যতদিন না নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতাকে সরকার মান্যতা দিচ্ছে, ততদিন দেশে কোনও নির্বাচন হবে না।

"ভারত সরকারের নিজেই এমন কিছু প্রথা সৃষ্টি করেছে, যার ফলে নির্বাচন কমিশন তার নিজের সাংবিধানিক কর্তব্য পালন করতে অসমর্থ হচ্ছে।"

"তাই নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কমিশনের অধীনে যত নির্বাচন হওয়ার কথা, সেই সব ভোট প্রক্রিয়া বন্ধ থাকবে পরবর্তী আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত," ওই আদেশে লিখেছিলেন মি. শেষন।

এই নির্দেশের যে প্রবল বিরোধিতা হবে, তা প্রত্যাশিতই ছিল।

পশ্চিমবঙ্গ থেকে রাজ্যসভার একটি আসনের নির্বাচন হতে দেন নি মি. শেষন, যার ফলে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রণব মুখার্জীর সময়কাল শেষ হয়ে গিয়েছিল আর তাকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু এতটাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে টি এন শেষনকে তিনি 'পাগলা কুকুর' বলে ফেলেন।

প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং বলেছিলেন, "আমরা এতদিন কারখানায় লক আউট জানতাম। মি. শেষনের আমলে তো গণতন্ত্রই লক আউট হয়ে গেল।" তিনি সততার মূর্ত প্রতীক ছিলেন।

রাজনৈতিক দল গুলো তাঁর মৃত্যুতে শোকবার্তায় সোশ্যাল মিডিয়া ভরিয়ে দিচ্ছে।  তবে তাঁদের কাছে কতটা প্রিয় ছিলেন, সবাই জানে। একবার রাষ্ট্রপতি পদ প্রার্থী হয়ে তাকে পরাজিত হওয়ার ইতিহাস কারো অজানা নয়।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours