Pujoy kurukhetro
কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

লড়াই লড়াই লড়াই চাই।

লড়াই করে বাঁচতে চাই।

গোটা বাংলা রণক্ষেত্র। লেকটাউন বলে উল্টোভাঙাকে বধ করবো। সুরুচি বলে এভারগ্রিনকে। চেতলা বলে নাকতলাকে। ওদিকে আবার মা দুগ্গার লড়াই চলছে তো চলছেই। ওই লড়াই দেখলেই আবার একটা গানের কথা মনে পড়ে যায়। "আমরা করবো জয় নিশ্চয়!"

তা যা বলছিলাম, মা তো ফি বছর অসুরবধ করেই চলেছেন। মাও ছাড়ান দেওয়ার পাত্রী না। আর রসিক অসুর, শিউলি কাশফুলের গন্ধ পেলেই তিড়িক করে এক লাফ। পুনর্জন্ম। সেই ভাঙা রেকর্ডের গান বেজেই চলে অবিরাম। অবিরত।

মাত্র তো কয়েকটা দিন। তবু আমাদের কারসাজিতেই দিনের এক্সটেনশন হয়েছে। দেবীপক্ষের আগাম খবরেই দেবীপূজার উদ্বোধন। ছেলেপুলে নিয়ে মা বাপের বাড়ি ঘুরতে আসা। তার মধ্যেও এই লড়াই। জীবনটাই সংগ্রাম। এই সংগ্রামের পাঠ পড়েই তৃতীয় নয়ন উন্মোচন দেবীর। বিদ্বজ্জনেরা বলেন, ওই তৃতীয় নয়নই জ্ঞানচোখ। তা শুনতাম যে, জ্ঞানীরা নাকি লড়াই ঝগড়া করে না। ক্ষমাসুন্দর হন। এই যে গাঁধিজির এত জয়জয়কার। অহিংসার পূজারি বলেই না ! নেতাজি পাত্তাই পেলেন না। তিনি আবার উল্টো পথে হেঁটেছিলেন। বলেছিলেন, "তোমরা আমাকে রক্ত দাও। আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব।"

নেতাজিরশ সেই রক্তারক্তির কথা একটুও পছন্দ করেনি ভারতবাসী। আর তাই তো মোহনদাস করমচাঁদ গাঁধি হলেন 'জাতির জনক'। বাপুজি। আর মহাত্মার  'লার্জার দ্যান লাইফ' ভাবমূর্তির কাছে গুটিয়ে গেল, শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ের ঘোড়সওয়ার নেতাজির 'দিল্লি চলো'।

তবে সেই গাঁধিজি- নেতাজির লড়াই আজও চলছে। স্বাধীনতার বয়স যতো বাড়ছে ততই অবশ্য ফিকে হয়ে আসছে আদ্যিকালের সেই বীরগাথা। এরইমধ্যে মান্ধাতা আমলের ওই লড়াই উসকে দিলেন আরেকজন। আর এতদিন যা ছিলো দ্বিপাক্ষিক, এখন সেই লড়াই হয়ে দাঁড়ালো ত্রিপাক্ষিক। মধ্যে ঢুকে পড়লেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। বিরামহীন বাঙালির লড়াই।

ওদিকে এবারেও ঘোড়া টগবগিয়ে ছেলেপুলের হাত ধরে হাজির দেবী দুগ্গা। দশপ্রহরণধারিনী। মহিষাসুরমর্দিনী। অসুরবধ করেই স্বরাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্বর্গে। কস্মিনকালেও কোনও নারী আন্দোলন- টান্দোলনের ধারপাশ দিয়ে হাঁটেননি। ময়দানে মেরাপ বেঁধে পিতৃতন্ত্র বিরোধী শিঙাও ফোঁকেননি। মুখের থুতু ছিটিয়ে ঘণ্টাখানেক টিভি'র ডিবেটে ঝগড়াঝাঁটিও করেননি। বরং পিতৃপক্ষ শেষ হওয়ার পরেই শুরু দেবীপক্ষের। পুরুষদের সঙ্গে নিয়েই,  নিজের পৌরুষে মহিমান্বিত হয়েছেন দেবী। সিবিআই বিশেষজ্ঞরা শহরের ভিড় থেকে একজনকে না ধরতে পেরে চম্পট দেন। সেখানে দেবী মহিষের পেট থেকে টেনে বার করেছেন তাঁর টার্গেটকে। দুরন্ত লড়াই দিয়েছেন মহিষাসুরকে।

তবে সত্যি বলতে কী, বড্ড একঘেয়ে হয়ে গিয়েছে এই দেবী দুগ্গা বনাম অসুরের বার্ষিক লড়াই। দুষ্টজনেরা তো সেই কবে থেকেই বলতে শুরু করেছেন, দাল মে কুছ কালা হ্যায়! ঠিক যেন কেন্দ্র রাজ্যের লড়াই। সেই ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি, কেন্দ্রের বিমাতৃসুলভ আচরণের অভিযোগ। আজ সব মুখগুলো কয়েক দফা পাল্টেছে। আমরাও ভাইপো থেকে কাকু, জ্যেঠু এমনকি কেউ কেউ দাদুও হয়েছি। তবে অভিযোগ যেই কে সেই। ভদ্রলোকের এক কথা!

দেবী চন্ডী বনাম অসুরের এই রশি টানাটানির খেলাকে বলা যেতে পারে, রাজ্য রাজ্যপালের লড়াই। বিরোধী শিবিরে থাকার সময় দোস্তি। শাসকের গদিতে বসেই কুস্তি। এই লড়াইগুলোও কোনও দিন শেষ হয় না। চলতে থাকে। চলতেই থাকে।

লড়াই লড়াই লড়াই চাই!

লড়াই বীর বাঙালির সংস্কৃতি। জনপ্রিয় চ্যানেলের রিয়ালিটি শোয়ের লড়াই। ঝকঝকে তকতকে রণাঙ্গন। সেজেগুজে হাজির যোদ্ধারা। মেকআপ টেকআপ করে এসে বসে পড়েন বিচারকরাও। মানবদেহের শব-ব্যবচ্ছেদ বা পোস্টমর্টেম কথা তো শুনেইছেন। নাচগানের পোস্টমর্টেম দেখতে হলে আসন পেতে বসে পড়ুন টিভি'র সামনে। কখনও এ ওর গলা টিপে ধরছে তো কখনও, কোনও পরাজিত সৈন্য নতমস্তক বেরিয়ে যাচ্ছেন রণভূমি থেকে। লড়াই তখনও চলছে। উদ্যাম সে লড়াই। পুজো উপলক্ষে আবার বিশেষ ধরনের লড়াই। লড়িয়ে দেওয়ার সহস্র ফন্দি ফিকির আবিষ্কার করে ফেলেছেন চ্যানেলের উর্বরমস্তিষ্ক কর্তারা।

দেবী লড়েন অসুরের সঙ্গে। আবার দেবীর সঙ্গে দেবীর লড়াই লাগিয়ে দিয়েছেন যত্তসব শিল্পরসিক  সংবাদমাধ্যমের কেষ্টবিষ্টুরা। চতুর্থী, পঞ্চমীর রাত থেকেই প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে হানা বিচারকদের। আদালতের ধাঁচে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গড়া ডিভিশন বেঞ্চ। কেউ মন্ডপের নকশা দেখেন তো, কেউ নিরাপত্তা। আবার কারও সাবজেক্ট থিম। কাঠগড়ায় পূজা প্রোডিউসর, ডিরেক্টর, শিল্পীরা। শুনানি। এটা কেন করলেন, ওটা কেন করেননি?

অবশেষে কলমের এক খোঁচা। 'এ' সঙ্গের ব্যবস্থাপনা সেরা, 'বি'- এর থিম। সংবাদমাধ্যমের মাননীয় বিচারকমণ্ডলী রায় ঘোষণা করেন, কোন দুর্গা সেরা আর কোনটা উচ্ছিষ্ট। জনগনের রায় অপ্রয়োজনীয়। বিচারকের রায় শিরোধার্য করে গুঁতোগুতি করে, প্রতিমাদর্শন কোথাও প্যান্ডেলদর্শন। টিআরপি, সাদাকথায় চ্যানেলের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর লড়াই।

পুরস্কার হাতে পেয়ে 'হিপ হিপ হুররে!'

ছক কষা শুরু আগামী বছরের। কারও টার্গেট জয় ধরে রাখা। অন্যদের জয় ছিনিয়ে আনা। ফের আরেক লড়াইয়ের প্রস্তুতি শুরু। এরই তলে তলে চলতে থাকে অন্য আরেক লড়াই। দেবী দখলের লড়াই। রাজনৈতিক আনুগত্য বদলাতে বাধ্য হন দেবীও। পূর্বকালে ছিল অমুক বাবু, অমুক বাড়ির পুজো। বাবু কালচার বিবি কালচারের শ্মশানযাত্রার ব্যবস্থা পাকাপাকি হতেই, জোর ধরে রাজনৈতিক কালচার। কংগ্রেসের পুজোয় কলকাঠি নাড়ল বামপন্থীরা। সরাসরি না তলাতলি। কমরেডদের ধম্মচর্চায় আলিমুদ্দিনের মানা। এখন তো আবার বাংলাজোড়া ঘাসফুল। লড়াইয়ে নেমে পড়েছে পদ্মশিবির। পুজোর দখলদারির লড়াইয়ের কূটকৌশলের কাছে দেবী দূর্গাও কি ব্যাকফুটে?

কিন্তু হার মানার পাত্র নয় ঘোরকলির রক্ত মাংসের দেবী দূর্গা।

এই দূর্গা দখলদারি বরদাস্ত করেন না। নিউইয়র্কে বসেই সেই ঘোষণা করে দিলেন। ভূস্বর্গ ভারতের। কাশ্মীরের দিকে নজর ঘোরানোও চলবে না।

নবদূর্গা বাক্যবাণে বিঁধে ফেললেন অসুরকে। অসুরের এই নব সংস্করণের নাম ইমরান। তবে দূর্গা তাঁকে ডাকলেন, ইমরান খান নিয়াজি। ১৯৭১এর পাক- ভারত যুদ্ধে ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন পাক লেফটেন্যান্ট জেনারেল একে নিয়াজি। একেবারে আন্তর্জাতিক মঞ্চে তার জাত চিনিয়ে দিলেন অসুরকে। পাক প্রধানমন্ত্রীর কাছে সওয়াল করলেন রাষ্ট্রসঙ্ঘের তালিকায় থাকা জঙ্গিদের পেনশন দেওয়া নিয়ে। কেন সন্ত্রাস দমনে ফেকলু ইসলামাবাদ?

কলির এই দেবীও বঙ্গললনা, নাম বিদিশা মৈত্র। ২০০৮ ব্যাচের আইএএস। ভারতীয় বিদেশমন্ত্রকের ফার্স্ট সেক্রেটরি। শেকড় ইলাহাবাদে। তবে বাসিন্দা দিল্লির ময়ূর বিহারের। আমাদের এই দূর্গার বয়স মাত্র উনচল্লিশ। আজন্ম প্রবাসে থাকলে কী হবে, ঝরঝরে বাংলায় কথা বলেন।। ব্রহ্মা, বিষ্ণুর দৈব অস্ত্রশস্ত্র ছাড়াই দিব্য মাত দিলেন একালের নরাসুরকে।

এ লড়াই এবছর পুজোবাজারের শ্রেষ্ঠ লড়াই।
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours