দেবর্ষি মজুমদার, লেখক, বীরভূম:

সচরাচর হিন্দু দেব দেবীর মূর্তি পশ্চিম মুখে অধিষ্ঠিত হয় না। কিন্তু রামপুরহাট সন্নিকট বর্তী পশ্চিম বঙ্গ –ঝাড় খণ্ড সীমান্ত বর্তী দুমকা জেলার বর্ধিষ্ণু গ্রাম মলুটিতে এর ব্যতিক্রম লক্ষ করা যায়। নানকার রাজবাড়ির কালিপুজোর জগৎজোড়া নাম। চারিদিকে শাল মহুলের জঙ্গলের মধ্যে মা তারার দিদি হিসেবে পূজিত মা মৌলিক্ষা। মৌলি অর্থাৎ শিরোভাগ দর্শন পাওয়া যায়, তাই তিনি মা মৌলিক্ষা। জঙ্গলের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে হাঁসুলি হারের মত ছোট্ট পাহাড়ি ঝর্না। তার পশ্চিমে উচ্চ ভূমিতে এই মায়ের মন্দির। ইন্টারনেটে মাউসে ক্লিক করলেই জানা যাবে এই মন্দিরের রক্ষণা বেক্ষণের দায়িত্বে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ। দেখা মিলবে মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার অভূতপূর্ব নিপুন শিল্প কর্ম। 
নানকারের রাজারা কি করে এই অতি প্রাচীন মূর্তির সন্ধান পেল তার ইতি বৃত্ত জানতে, আমাদের একটু পিছনের দিকে তাকাতে হবে। তার আগে আমরা জেনে নিই বর্তমানে এই রাজ পরিবারের কারা কারা এই পুজো চালিয়ে আসছেন। নানকার বংশের রাজ পরিবারের সদস্য তথা মা মৌলিক্ষা মন্দির কমিটির প্রাক্তন সম্পাদক কুমুদ রঞ্জন রায় বলেন, “ বর্তমানে রাজ বাড়ি ৮ শরিকে বিভক্ত। প্রত্যেকের নিজ নিজ বাড়িতে কালী পুজো হয়। সেগুলি হল—ছয় তরফ, রাজার বাড়ি, মধ্যম বাড়ি, শিকি বাড়ি, চৌকি বাড়ি। এছাড়াও শশ্মান কালীর পুজোও এখানে হয়। রাজা রাঘড় চন্দ্র বাড়ির মোষ বলি বন্ধ হয়ে গেছে বহুদিন আগে। তবে ছয় তরফে এখনও মোষ বলি হয়।
প্রথমে আমরা মা মৌলিক্ষার কাছে এয়োজা অর্থাৎ কালীপুজোর অনুমতি নিতে যায়। তখন দিঘির পাড়ে বাজি পোড়ানো হয়। সাধারণতঃ লাভপুরের ভালসা গ্রাম থেকে হাজার চল্লিশেক টাকার বাজি আসে পোড়ানোর জন্য। পুজো শুরু হয় রাত্রি ১১টা নাগাদ। পরের দিন সকলকে মায়ের ভোগ খাওয়ানো হয়। বিকেলে এক সঙ্গে ৮টি কালীকে নাচাতে নাচাতে মা মৌলিক্ষাকে প্রদক্ষিণ করানো হয়। তারপর সব কালীকে একজায়গায় রাখা হয়। প্রত্যেক শরিকের নিজস্ব পুকুরে নিরঞ্জন হয়। মধ্যম বাড়ির কালী বিসর্জন হয় বুড়োর পুকুরে। ছয় তরফের মানিক চাঁদ পুকুরে এবং রাজ বাড়ির দিঘিতে। এই উপলক্ষে ৭ দিন মেলা চলে। গ্রামের লোকেরা যারা বিদেশে কর্মরত তারা ছাড়াও বহু বহিরাগত এই পুজো উপলক্ষে মলুটি গ্রামে আসেন। দুর্গা পুজোয় এখানে কোন জাঁকজমক নেই। যা জৌলুস আছে এই কালী পুজোয়”। মন্দির কমিটির এক সদস্য গৌতম চট্টোপাধ্যায় শোনালেন, আরেক কথা। তিনি জানান, মা মৌলিক্ষার মন্দিরে প্রায় পাঁচশ বছর আগে বামা খ্যাপা দুই বছর যাবৎ মায়ের ফুল তোলার কাজ করেছেন।
ইতিহাসের পাতায় যার অবাধ চলাচল তিনি বিশিষ্ট গবেষক এবং মলুটির বাসিন্দা গোপাল দাস মুখোপাধ্যায়। তাঁর কাছ থেকে শোনা গেল মলুটির এই মা মৌলিক্ষা মূর্তি সম্পর্কিত কিছু কথা। আরো অনেক অজানা বৃত্তান্ত। তাঁর কাছ থেকে জানা যায় এই মূর্তি খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর বৌদ্ধ তান্ত্রিক শৈলীর। আগে বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজাদের শাসিত ছিল এই অঞ্চল। তার থেকেই উৎপত্তি মলুটি নামের। তারও আগে মলুটি অঞ্চল ছিল সুবে বাংলার অন্তর্গত। তখন দিল্লীতে সম্রাট শাহজাহান। মলুটি তখন রাজত্ব করতেন  নানকরের তিন রাজ বংশধর- রাজ চন্দ্র, রাম চন্দ্র ও মহাদেব চন্দ্র রায়। অধুনা মল্লারপুরের শাসক কামাল খাঁর অতর্কিত আক্রমণে রাজ চন্দ্র নিহত হওয়ার পর তাঁর বড় ছেলে রাখড় চন্দ্র রায় রাজপরিবারের পুরোহিত  দণ্ডিস্বামীর সঙ্গে মলুটির জঙ্গলে প্রবেশ করেন। সেখানেই তিনি ভগ্নপ্রায় এক প্রাচীন মন্দিরে পাথরের এক মূর্তি আবিষ্কার করেন। তারপর সেখানেই নগর পত্তন করেন। সেই রাজ বাড়ির বংশ ধরেরা আজও পুজো চালিয়ে আসছে। এই জঙ্গলেই একবার সম্রাট শাহজাহান তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে তাঁবু পেতেছিলেন।  সেই সময় নানকর রাজ বংশ ধরের একজন নাকি সম্রাট শাজাহানের হারিয়ে যাওয়া প্রিয় বাজ পাখি ফেরত দিয়ে নজরানা দিয়েছিলেন সম্রাটকে।  বিনিময়ে তিনি এই তালুকের শাসন ভার পাকাপাকি ভাবে পেয়েছিলেন সম্রাটের কাছ থেকে। ‘বাজের বদলে রাজ’ – এই গল্প কাহিনী আজও এতদ অঞ্চলের লোক মুখে ফেরে।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours