কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

চারদিকে শুধুই তো ভূত।
ভূতের মধ্যেই বাস।
রোজ, প্রতি মুহূর্তেই তো ভূত চতুর্দশী।
সকালে অনলাইন হওয়ার অপেক্ষা। মেসেজের বান ডাকা শুরু। আজকাল 'গুড মর্নিং'য়ের দৌরাত্ম যেন কিছুটা কম। দেখতে দেখতে বাহাত্তর বছর পার। এতদিনে কি তাহলে সাহেবভূত ঘাড় থেকে খানিকটা নেমেছে? হতে পারে। এখন  সুপ্রভাত, সুসকাল, সকালের শুভেচ্ছা।  যারা এই শুভকামনা পাঠায়, তাদের বেশিভাগের সঙ্গেই সারাদিন রাতে আর একটিও কথা হয় না। তবু এরা নিত্য ফেসবুকের পাতায় নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিয়ে যায়। ঠিক ভূতের মতোই। প্ল্যানচেটের বিদেহী আত্মার মতোই এদের ভুতুড়ে অস্তিত্ব। আমরা ছিলাম। আমরা আছি। আমরা থাকবো।
তো এদেরকে ভূত না বলে আর কিই বা বলি?

আবার কিছু মানুষ এমনও আছে, যাদের সঙ্গে সম্পর্কটা ঠিক ভুতুড়ে না। খানিকটা মানবিক। হাল হকিকত জানতে চায়। ভালো থাকলে খুশি হয়। খারাপ সময়ে সঙ্গ। অনেক কথা, অনেক সাপোর্ট। আঙিনার থেকে ঢুকে পড়ে অন্দরমহলে। তারপর একদিন হঠাতই চুপচাপ। কোনও সাড়াশব্দ মেলে না।
কী ব্যাপার? জানার চেষ্টা করলে কখনও এক- আধ টুকরো জবাব, কখনও নয়। তারপরেই এরা ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়। মোক্ষপ্রাপ্তি হয় বোধহয় 'ফেসবুক(জীবন)চক্র' থেকে। মহাশূন্যের এক স্তর থেকে অন্য স্তরে উন্নীত। শুনেছি সেই বিদেহী আত্মারা আর সাড়া দেয় না সহস্র ডাকাডাকিতেও। বিদেহী আত্মা, সেতো ভূতেরই নামান্তর।

আবার  অনেকে ছায়া থেকে কায়াও হয়। ফেসবুকের পাতায় তাদের ছায়াচিত্র। ঘনিষ্ঠতা বাড়লেই ছায়া থেকে কায়ায় রূপান্তরিত। ফেসবুক থেকে বেরিয়ে নন্দন অথবা অ্যাকাডেমিতে হাজির সশরীরে। নিশ্চিন্ত হতাম। ফেসবুকে তাহলে শুধু ভূতেদের বাস না, দুষ্টরা যেমনটা বদনাম দিয়ে থাকে। সেই কায়াকে ছুঁয়ে দেখতাম। এতো সত্যিই মানবসন্তান। উষ্ণ ত্বক। ছুঁলেই বেশ রিয়্যাক্ট করে তো! একেবারে সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ।

এদের কারও কারও সঙ্গে, সঙ্গসুখ ছাপিয়ে শরীরেও পৌঁছন যায়। আবার শরীর একসময় পুরনো হয়। তখন দুম করে একদিন শরীর ছেড়ে চলেও যায়। ব্রেক আপ! তবে আত্মা তো ! শরীর ছাড়া বেশিদিন থাকতেও পারে না। তাই খুঁজে নেয় অন্য শরীর। সেদিন হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায়, এরা মানুষরূপী আত্মা। অদ্ভুতুড়ে। এক বিশেষ প্রজাতির ভূত। নাকি মামদোর মামদোবাজি?

আবার খটকাও  লাগে। দেখতে শুনতে তো অবিকল মানুষের মতোই। কিন্তু মানুষ হলে এত মানবিকতার আকাল কেন? তখন মনে হতো গীতার সেই বাণী। কৃষ্ণের বিশ্বরূপদর্শন। সবই তো আসলে আত্মা। এক শরীর ছেড়ে অন্য শরীরে আশ্রয় আত্মার স্বভাব।

ভূত চতুর্দশীর রাত। চারদিকে সেকি দুমদাম। কোথাও আলো কোথাও শব্দ। সবেতেই বিস্ফোরণ। দুম দাম। পাখিরা আতঙ্কে অস্থির। গাছ ছেড়ে ওড়াউড়ি শুরু। কাকের কা- কা মাঝরাতে। তারস্বরে কুকুরের চেঁচানি। চলতে থাকে ভূতের দাপাদাপি। ভালো ভূতেরা নীরব। তাদের মনখারাপ। দলে অল্পকিছু খারাপ ভূত ঢুকে পড়েছে। তাদের জন্যই সমগ্র ভূতজাতির দুর্নাম ছড়াচ্ছে।
তবে খারাপ ভূতের পেছনে লাগতে সাহস পায় না সুবোধ ভূতরা। এই ভূতেরা অনেকটা গাঁধিজির তিন বাঁদরের মতো। কেউ চোখে দেখে না। কেউ কানে শোনে না। বাদবাকীরা মুখে বলে না। এদের সঙ্গে ভীষণ মিল খুঁজে পাই পরিবেশবিদদের। সবেতেই না। নদীতে বাঁধ বাঁধা চলবে না। সবুজ ঘাসের ময়দানে জমায়েত চলবে না। না না না।

এই বিকট 'না'-এর চেয়ে অনেক ভালো ভুতুড়ে হাসি। মাঝেসাঝেই শুনি। মধ্যেসধ্যে উল্লাস। নিশুতিরাতে বুক কাঁপানো ডিজে'র ডিগ- ডিগ। পুলিসও সমীহ করে চলে। আধুনিক ভূত বলে কথা। তার ওপর আবার প্রভাবশালী। ধরবে আর ঘাড় মটকাবে। পুলিসের ঘাড়েও তো মাত্র একটাই মাথা। ভয় না পেয়ে উপায় কী? তা সেই সব ভূতের পার্টি লেগেই থাকে। অমাবস্যা পূর্ণিমা মানামানি নেই। আগে থাকতো শ্যাওড়া ডালে। এখন ন'তলা, বারোতলা, চাইকি চব্বিশতলায়। যে ভূত যত উচ্চ মার্গের, বায়বীয় মহাশূন্যে তার জায়গা ততোই উচ্চ স্তরে।
চাদরে মাথা মুখ ঢেকে, কানে বালিশচাপা দিয়ে হনুমান চালিশা জপ করি।  রামনামেও আজ আর তেমন কাজ হয় না দেখেছি। তবে ভূতেদের চেহারায় যত ফারাক থাকুক না কেন, স্বভাবে সব এক। তা সে গলি, পাড়া, মহল্লার ভূত হোক অথবা হাইরাইজের। হল্লাগুল্লা আর মারাত্মক শব্দ এদের ভীষণ প্রিয়।

সকালে উঠে দুরু- দুরু বুক। আয়নার সামনে দাঁড়াই। পরীক্ষা করি আয়নার বুকে ঠিকঠাক ছায়া পড়েছে তো? চিমটি কাটি পেটে। হ্যাঁ যন্ত্রণা হচ্ছে। বারেবারে বুঝে নিতে চাই, ভূত চতুর্দশীতে আমি নিজেই ভূত হয়ে যাইনি তো?


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours