সুবীর পাল, এডিটর, দ্য অফনিউজ:

দৃশ্যপট একঃ বন্ধ হওয়া দুর্গাপুর সার কারখানার জীর্ণ আবাসনের শোয়ার ঘরে একটি মাত্র ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। হাফবাস্ট নিটোল মুখের দেবী দুর্গা। বেশ কিছুটা মলিন হয়ে গেছে কালের দশাচক্রে। মধ্যবয়স্কা কনিকা চট্টোপাধায় বিছানায় শুয়ে শুয়ে রোজকার অভ্যাস মতো প্রণাম করলেন ছবিটাকে।
এরপর চোখ গেল স্মার্টফোনটার দিকে। কয়েকদিন আগে বিবাহিতা মেয়ে নিশা সরকার একটা জুতসই নেটপ্যাক মেরে দিয়েছে। নুন আনতে পান্তা ফোরানো সংসারে বেমানান স্মার্টফোনটাও মেয়েরই কিনে দেওয়া। তাতে ফেসবুক পেজ খুলতেই ভেসে উঠল ‘সুইটি নিশা’র অ্যাকাউন্ট। পাশেই সবুজ ডট দেখেই বুঝলেন মেয়ে তাঁর অনলাইনে রয়েছেন। ম্যাসেঞ্জারে আগে থেকেই ম্যাসেজ রয়েছে। মেয়ে লিখেছে, ‘মা তোমার নাতি স্কুল থেকে জেনেছে অম্বুজা কলোনিতে উর্বশী পুজো কমিটির সেভ ড্রাইভ সেফ লাইফ থিমের পুজো করছে। মণ্ডপে হাতির মাথায় হেলমেট পরা মডেল রয়েছে নাকি। নবারুণের পুজো তো সাবেকি আনার স্টাইল এবারও বজায় রাখবে সঙ্গে মেলার অ্যাম্বিয়েন্স তো থাকছেই।’
ম্যাসেজ পড়তে গিয়ে মনটা হুহু করে উঠল। মনে পড়ে গেল আবাসন লাগোয়া অফিসার্স ক্লাবের পুজোর কথা। কারখানা বন্ধ। তা বছর পনেরো এখান থেকে পাততারি গুটিয়েছেন মা দুর্গা। একই অবস্থা দুই হাত দূরের চারশো কোয়ার্টাসের পুজোর ইতিবৃত্ত। স্বামীর চাকরি থাকতে কি মজাই না স্বপরিবারে করতেন তাঁরা। দু’টি পুজো যেন তাঁদেরই। সেকি ব্যস্ততা। কি প্যান্ডেল হবে, নিজেদের আবাসন থেকে চাঁদা আদায়, সর্বপরি পুজোর আয়োজন করতে গিয়ে হিমসিম খাওয়া। নতুন নতুন কেতাদুস্তর পোষাক পড়া। দামি শাড়ি পড়া নিয়ে না-উচ্চারণ করা একটা কমপিটিশন ছিল পাশের বাড়ি বৌদির সঙ্গে। কত বছর দশমীতে সিঁদুর খেলা বন্ধ হয়ে গিয়েছে তাঁদের। ভাবতে ভাবতে চোখের কোন চিকচিক করে উঠল। আজ পুজো প্রাঙ্গনটি ঝিঝি পোকার আড্ডার মক্ষম স্থল। ঝোপজঙ্গলে ভরা সাপের আনাগোনা। কত বছর পুজোর কেনাকাটা হয় না। একটা মাত্র নাতি। তাকেও তো পুজোর উপলক্ষ্যে কিছু দিতে পারেন না তিনি। খাবারই জোটে না স্বামী স্ত্রীর। মেয়ে কাপড় দেয় তাই লজ্জা নিবারণে রক্ষে।
আরে, মেয়ে আবার ম্যাসেজ দিয়েছে যে ম্যাসেঞ্জারে। ‘জানো তোমার জামাই অগস্টে যে নতুন গাড়িটা কিনেছে...বলে কিনা তাতে চেপে কলকাতায় যাবে পুজো দেখতে। প্লিজ মা, জামাইকে বলো না দুর্গাপুর ছেড়ে যেন কলকাতা না যায়। জানোই তো আমি অত ভিড় সহ্য করতে পারি না। ও বলছে তোমাকে বাপিকেও নিয়ে যাবে সঙ্গে।’ কনিকাদেবীও পাল্টা ম্যাসেজ দিলেন, ‘নিশা তোদের অল্প বয়স। তোদের এসবে আমাকে টানিস না রে। নাতির পুজোর ড্রেস কেমন হলো? জামাইকে বলবি পুজোয় সাবধানে যেন গাড়ি চালায়। আর শোন, তুই আর জামাই পুজোর ক’টা দিন ছাইপাঁশ খাস না। কি যে তোদের হয়, ওকেশন মানেই রঙিন বোতল চাই। বুঝি না বাবা।’। সুইটি নিশার ফের ম্যাসেজ, ‘তুমি না মা আদ্দি কালেই রয়ে গেলে। তোমাকে আর বাপিকে পুজোয় একদিন সারা দুর্গাপুর ঘোরাবো আমাদের নতুন গাড়িতে, এটা আমাদের প্ল্যান। তোমার জামাই আমাকে এবার পুজোয় একটা ডায়মন্ড রিং প্রেজেন্ট করেছে।’ ঘুমে কনিকাদেবীর চোখ ছোট হয়ে আসছে। তিনি কোনওক্রমে ম্যাসেজ দিলেন, ‘শোন তোর বাপি ঘুমিয়ে পড়েছে রে। জানিস ওর দিকে তাকালে খারাপ লাগে। পুজোতে আমাদের নিয়ে একসময় কি আনন্দ করতো রে বল তোর বাপি। যাক ভাল থাকিস। দাদুভাইকে পুজোয় নিয়ে আসিস কিন্তু। শুভ রাত্রি।’

দৃশ্যপট দুইঃ স্থান দুর্গাপুর রেলস্টেশনের সামনে সিমেন্টে বাঁধানো বিস্তৃত করিডোর। খোলা আকাশের নিচে মা ভাইয়ের সঙ্গে রোজকার মতো শুয়ে আছে বছর ষোলর সুনিতা বাউরি। চিররুগ্ন বাবা প্রায় অনাহারে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন পাঁচ বছর হল। অন্ধ মা নিত্যদিন ভিক্ষা করেন প্ল্যাটফর্মে। তার ভুমিকা অন্ধের লাঠির মতো। মাস ছয়েক হল স্থানীয় কালিগঞ্জের যুবক নবীন দত্তর সঙ্গে পরিচয় ও যেন প্রেম প্রেম ঘনিষ্টতা। দিনমজুর হলে কি হবে চুলটা হেবি স্পাইক করা। জিন্স পরে কোমরের একদম নিচে। উফ যা লাগে না ওকে। ইস কবে যে আমাদের বিয়ে হবে! পুজোয় একসঙ্গে ঘুরতে পারবো সিঁদুরের টিপ পরে। মা দুর্গার কপালে যেমন টিপ থাকে। সুনীতার মনে এসব ঘুরপাক খাচ্ছে আর শুয়ে থেকেও নজর রয়েছে আকাশের এক চিলতে মেঘের দিকে। আশঙ্কাও হচ্ছে এই রে বৃষ্টিতে না ঘুম বরবাদ করে। বেজে উঠল মোবাইল ফোন। নবীন ছাড়া এই রাতে আর কেই বা করবে?
নবীন-হ্যালো, কি করছো ডার্লিং? পুজোতো এসে গেল। সুনীতা-অন্ধের কিবা দিন কিবা রাত বল, পুজো আমাদের কাছে অর্থহীন গো সোনা। নবীন-ডার্লিং, তুমি সবসময় খ্যাক খ্যাক করে কথা বল। আমার কষ্ট হয় না বুঝি। সুনীতা-হ্যালো হ্যালো, তুমি আমাকে ভুল বুঝছো। মা অন্ধ, ভাই ছোট। আমাদের না আছে ঘর। না আছে ভবিষ্যত। জানি না তুমি আমাকে বিয়ে করবে কিনা? আবার ভাবছি বিয়ে করলে মা ভাইয়ের কি হবে? তাই পুজোর আনন্দ আমাদের করার অধিকার নেই গো। নবীন-সোনা গো তুমি কি আমার উপর ভরসা রাখতে পারো না? আমি তো আছি নাকি? অ্যাই শুনছো, এবার সিটি সেন্টারের চতুরঙ্গর পুজোয় সোমনাথ মন্দিরের আদলে প্যান্ডেল করেছে কাচের টুকরো দিয়ে। মামরা বাজারের পুজোয় দেখা যাবে মৌচাক ও মৌমাছির নানান বৈচিত্র্য ঘরানা। ভাবছি তোমাকে নিয়ে অষ্টমীর রাতে ঘুরবো। স্রেফ তুমি আর আমি। হাত ধরাধরি করে। জানোই তো আমার অবস্থা। বেশি পারবো না। তবে এগরোল খাওয়াবো আমার সোনাটাকে। সুনীতা-তুমি আমার কথা ভেবে এসব বলছো সে তো ঠিক আছে। কিন্তু কি পরে যাবো? না আছে সাজার জিনিস। না কোনও ভাল পরার কাপড়। কিছু মনে করবে না একটা কথা বলবো...আমাকে একটা ভাল চুরিদার ও প্লাজো কিনে দেবে গো। আমার একটাও চুরিদার বা প্লাজো নেই। প্লিজ কিছু মনে করো না। উফ এতো নেটওয়ার্ক প্রবলেম যে কি বলি...হ্যালো হ্যালো হ্যালো। নবীন-কি গো কিছুই যে শুনতে পারছি না। হ্যালো হ্যালো। নবীন ছিন্ন করে দিল মোবাইল সংযোগ। খানিকটা হতাস হল সুনিতা, সে ভাবে তার ভাগ্যটাই বোধ হয় এরকম। যা ধরতে যায় আকঁরে সেটাই কপালে জোটে না। ঘুমন্ত ভাই মায়ের দিকে নজর যায়। আহা রে আমার মাই তো আমার দুর্গা। এই দুর্গাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না। অন্যদিকে নবীন চুরিদার ও প্লাজো কেনার কথা শুনে নেটওয়ার্কের দোহাই দিয়ে ফোন তো কেটে দিল। পুজোতে কচি ডবকা মেয়েটাকে একদিন হলেও ঘোরানোর নাম করে ওঠাতেই হবে পটিয়ে পাটিয়ে। তা না হলে পুজোর মজাটাই ম্যাজম্যাজে ফ্যাকাসে হয়ে যাবে তার। ফন্দি তো একটা আঁটতেই হবে তাকে, এমন একটা ভাব নবীনকে অস্থির করে তুলেছে। অথচ বোগাস চুড়িদার প্লাজো আবার কে কেনে ফালতু?

দৃশ্যপট তিনঃ মহালয়ার দিনে নিজের কোয়াটার্সে ককটেল পার্টি থ্রো করেছিলেন দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানার মস্ত বড় আধিকারিক প্রণব শ্রীবাস্তব। চাকরি সূত্রে বছর পনেরো আগে তাঁর দুর্গাপুর বা ভারতের রুঢ় শহরে আগমন। নিম্নত্রিত ছিলেন সমাজের অনেক বড়সড় হস্তি বা হোমরা চওড়া। ঢালাও রেড ওয়াইন, অ্যান্টিক ব্লু’র ছড়াছড়ি। সঙ্গে চিকেন লেগ ললিপপ, মর্টন প্যাটিস, বার্গার। সবার শেষে হট ডিনার। রাত বারোটা বাজতেই ধীরে ধীরে টলমলে পায়ে সস্ত্রীক অতিথিরা বিদায় নিলেন। রয়ে গেলেন প্রানের বন্ধু ও হরিহর আত্মা আশিস বন্দ্যোপাধায়। আশিসবাবু আবার পেশায় চিত্র সাংবাদিক। মুখোমুখি টেবিলে বসে আরও দু’টি পেগ তৈরি করলেন তাঁরা। এদিকে প্রণববাবুর স্ত্রী রিতাদেবী পেগ টেগ থেকে একটু দুরেই থাকেন। বললেন, ‘কিগো, সন্ধ্যে থেকে তো গিলেই চলেছো। ফের মদ নিয়ে বসলে। এবার রাতের খাবার তো খাও দু’জনে।’ প্রণববাবু স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘এই যে হোম মিনিস্টার, একটু ওয়েট করো। আশিসকে কতদিন পর একা পেলাম। ওঁর সঙ্গে একটা পেগ স্পেসালি এনজয় করি। তারপর তো আমি তোমারই।’ স্বামীর এই কথা শুনে রিতা ড্রয়িংরুম ছেড়ে পাশের বেডরুমে চলে গেলেন জবরজং ড্রেস চেঞ্জ করতে। এদিকে চিয়ারস বলে দুই পেগের একটা আলতো ঠোকা। প্রণব-বল এবার পুজোর প্রি-কভারেজ কেমন করলি? দুর্গাপুরের পুজো কেমন হবে রে? আশিস-জানিস তো ছবি তুলি সঙ্গে অল্পবিস্তর সাংবাদিকতাও সেরে নিই। বেশ কিছু পেপারে ও স্যাটেলাইট চ্যানেলে আমার ছবি গেছে এটা মস্ত বড় পাওনা। ডিপিএলের সংহতির পুজোতো ডাকের জন্য আজও যথেষ্ট ক্রেজি। পাশের আদিবেদী পুজো কমিটি পুরুলিয়ার স্থাপত্য ও লোক সংস্কৃতি তুলে ধরেছে গোটা পুজোর পরিবেশে। মার্কনি পুজোয় আবার নাইজেরিয়ার মাছ উৎসবের টুকরো টুকরো আবহ দেখা মিলবে। আবার অগ্রণী পুজোয় মহাকাল ও পাতালের যেন সার্থক দৃশ্যাবলী আনাচে কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে। এখানকার সবচেয়ে প্রাচীন পুজো তো শ্যামারূপার পুজো। গড়জঙ্গলের এই আটশো বছরের পুজোতে এবারও অগুনতি মানুষের ভিড় হবে আশা করছি। প্রণব-আমার শুধু কারখানা আর ঘর। আর কিছু জানা পরিচিতি চাকরি সূত্রে। তবে এবার তো কারখানা থেকে আমাদের পুজো অনুদান ব্যাপক রে। পঁচিশ হাজার টাকা তো নিশ্চিত। শুনেছি বেসরকারি কারখানাগুলিতে এবার বোনাস নাকি সাত থেকে আট হাজার টাকা। একই শহরে কর্মীদের কত বৈষম্য বল। তোরা কত খবর রাখিস তাই না? আশিস- তা ঠিক বলেছিস। পেশার তাগিদ বুঝলি। আর খবর রাখা! সবার খবর আমরা রাখি কিন্তু আমাদের খবর কে রাখে? সত্যি কথা আর কি বলবো বল? তোকে লুকানোর কিছু নেই। হাজার হলেও তুই আমার ছোটবেলার বন্ধু। মাইনেই ঠিক মত পাই নাতো আবার বোনাস? বাড়ির বাচ্ছাটাকে যে কিছু কিনে দেব তার সাধ্য নেই। এদিকে সবার বোনাস পাওয়ার আনন্দের ছবি, পুজোর বাজারের জমাটি কেনাকাটার ছবি তুলে যাই রুজির টানে। এসব শোনার পর প্রণব চেয়ার ছেড়ে উঠে আশিসকে বলেন-একটু বস। বলেই পাশের ঘরে গিটে একটু পরেই ফিরে এলেন। শুরু হল ফের কথোপকথন। একটা মোটা খাম এগিয়ে দিয়ে প্রণব বললেন-এটা রাখ। চৌখস চিত্র সাংবাদিক বুঝে গেলেন এই খামে রয়েছে বেশ কয়েক হাজার টাকা। কারণ সে তাঁর বন্ধুকে চেনেন। আশিস-এটা কিন্তু তুই ঠিক করছিস না। আমি এই খাম নিতে পারি না। এবার জোর করে প্রণব খামটি লাজুক আশিসের হাতে গুজে দিয়ে বললো-শোন আমাদের বন্ধুত্বের মধ্যে কোন ভ্যানিটি নেই। আমার মেয়ে দামি জামাকাপড় পরবে আর তোর ছেলে নতুন জামা প্যান্ট পাবে না তা কি হয়? তোর ছেলে তো আমার সন্তানসম। আমি তো একদিন আমার মেয়ে ও তোর ছেলেকে নিয়ে পুজোতে বেড়াবো ভাবছি। তুই যে ছবিগুলো তুলেছিস তা আমিও পেপারে দেখেছি। আমার বন্ধু ঠিক ছবিগুলো তুলেছে কিনা দেখেতে হবে না? বলে হো হো করে হেসে ফেললো প্রণব। আর আশিসের হাতে রয়েছে সেই খামটা। একবার আড়চোখে দেখে মনে হল খামের ভেতরটা বেশ ঠাসা। প্রণব শিশুর মতো হেসে উঠলেও আশিসের বুকের মধ্যে একরাস যন্ত্রণার রক্তক্ষরণ শুরু হল শারদীয়ার এই প্রাক মূহুর্তে। ঠিক এই সময়েই রিতাদেবী সামনে এসে বললো-আশিসদা শুধু তোমার ছেলে নয়, তোমরা সবাই আমাদের সঙ্গে পুজোতে বের হবে। তুমি সঙ্গে থাকলে পুজো কমিটির খাতির পাবো আলাদা ভাবে। আশিসের নজর গিয়ে পড়ল রিতার কপালের টিপটার দিকে। দেবী দুর্গার কপালেও থাকে এমনই বড় মার্কা সিঁদুরের লাল টিপ। মা দুর্গাতো মঙ্গলময়ী। রিতাদেবীর নৈতিক সমর্থন ছাড়া প্রনববাবু কি একতরফা আমার মঙ্গল কামনা করতে পারতো?
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours