পার্থ বসু, লেখক, হাওড়া:

ছোটবেলায় আমাদের স্কুলপাঠ্যে একটি ইংরাজী কবিতা ছিল।কৃস্টিনা রোসিটা-র লেখা।তার থেকে চার লাইন পড়ে নিয়ে শুরু করব।
 Who has seen the wind?
Neither I nor you.
But when the leaves hang trembling
The wind is passing through.
আসুন।আজ হাওয়া নিয়ে কিছু আলাপ করি।শুধু গাছের পাতা নয়,যখন যে হাওয়া ওঠে তা টের পেতে হলে যাকে এড়িয়ে যাওয়ার যো নেই সেই খবরের কাগজ আর খবরকুড়ানীদের মানে সাংবাদিকদের নিয়ে একটু খোশগল্পে আসি।গভীরে যাব না।ডুবব না।আমার দম নেই।আমি সাংবাদিক নই।তত্ত্বকথায় অধিকার নেই।কিন্তু সংবাদভোক্তা তো বটে।আমিও খবর খাই।গলাধঃকরণ করি।কিছু তথ্যসম্মত গলাবাজি সুতরাং অন্যায্য হবে না মনে হয়।যা কিছু বলছি একজন সংবাদপড়ুয়ার দৃষ্টিকোণে।তার চাহিদার দৃষ্টিকোণে।
সাংবাদিককে খবরকুড়ানী বললাম যে ! কুড়ানী শব্দে কোন লিঙ্গপক্ষপাত নেই।বাংলা ভাষায় ভাইকেও গুণবতী বলতে বাধে না।তবে কেউ কেউ বলতেই পারেন—সাংবাদিক কি খবর কুড়ান কেবল?আর কুড়ালেও তা যতক্ষণ না পাতে মানে পাতায় আসছে তার মূল্য কি?সাংবাদিক স্বাধীনভাবে কলম চালান বা তিনি প্রতিষ্ঠানের বেতনভূক তাতে করে তার খবর সংগ্রহের আদর্শে কিছু ব্যাত্যয় ঘটে?সর্বোপরি কুড়ানী সাংবাদিকের অনেক পরিচয়ের একটিমাত্র।সংঞ্জা নয়। জহুরী যেভাবে জহর চেনে সাংবাদিক খবর চেনেন। রীতিমত গন্ধ পান।চোখে সবাই যে যার মত দেখি।রাজা কানেও দেখেন।সাংবাদিক দেখেন নাকেও।কথাগুলি ষাটের দশকে এক সমীহজাগানো সাংবাদিক স্মরজিৎ সামুইকে নিয়ে কথাশিল্পী খায়রুল বাসারের করা মন্তব্যের ভাবসম্প্রসারণ।স্মরজিৎ কোন সাংবাদিকতার কলেজফেরতা নন।তাঁর শিক্ষাও ছিল গুরুমুখী এবং অনেকটাই অনুশীলনসাপেক্ষ।তবে প্রতিভাও ছিল।
কেউ হয়তো রে রে করে তেড়ে আসবেন।প্রতিভা ব্যাপারটি এত সস্তা নাকি?সাংবাদিকতাও প্রতিভার ফসল? প্রতিভার বরপুত্র কবিদের চটাতে চাইছি না।কবিতা লিখতে পারেন না তাই গদ্য লেখেন সেই কথাকারদেরও ক্ষ্যাপাতে চাই না।তারা রাগলে আমি নাচার।তবে সবিনয়ে দুচারটি প্রাতস্মরণীয় নাম নিচ্ছি।সংবাদপ্রভাকরের ঈশ্বর গুপ্ত যার কবিসত্ত্বাকেও ছাপিয়ে উঠেছিল সাংবাদিকের পরিচয়।বঙ্কিমচন্দ্রের বঙ্গদর্শন।একালের মতি নন্দী।পূর্ণেন্দু পত্রী ও স্বাধীনতা পত্রিকা পর্ব।সুভাষ মুখোপাধ্যায়।নীরেন চক্রবর্তীকেই বা বাদ দিই কেন? তিনি তো সংবাদের ময়ান থেকেও কবিতা বেলতেন।একটি খুব চেনা বিদেশী সাংবাদিকের নাম নিই।ক্রীড়াসাংবাদিক ক্রিকেটের নেভিল কার্ডাস।আমাদের সময়ের মৃদুল দাশগুপ্ত,গৌতম ঘোষদস্তিদার কে নয়?
বরং সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত কবি ও কথাকাররা সময়ের সাথে বাংলা মানভাষায় অঞ্চলভেদে মানুষের মুখের ভাষার অভিক্ষেপগুলি আত্মস্থ করেছেন।নতুন নতুন পরিভাষা তৈরী করেছেন যা ব্যবহারে মান্যতা পেয়ে কালক্রমে অভিধানেও উঠে এসেছে।নতুন নতুন চিত্রকল্প শুধু কবিতায় নয়।সংবাদেও।আবার একটি ইংরাজী সংবাদে পাওয়া শব্দ দিই।সে প্রায় চল্লিশ বছর আগে খবরে
এক সাহেবের বর্ণনা ছিল the egg headed gentleman.ডিমের মত মাথা? ওঃ হো, টাকমাথা পড়ুন বাংলায়।
এই দেখুন দাদাঠাকুরের কথাই বলা হয় নি এখনও।শরৎচন্দ্র পণ্ডিত।জঙ্গীপুরসংবাদের মুদ্রক,প্রকাশক, সম্পাদক,  ফেরিওয়ালা পাশাপাশি গীতিকার,বিদূষক কবি কোনটা ছেড়ে তাঁর কোন ভূমিকার কথা বলব?প্রতিভার বিতর্কটি ধামাচাপা থাক।আরও অনেক কাজের কথা আছে।
সংবাদপত্রের কাজ খবর দেওয়া।এইমাত্র।খবর সংগ্রহের, কেনাবেচার কিছু দেশী ও বিদেশী প্রতিষ্ঠান বহুদিন বাজার দখলে রেখেছিল।একটা সময় অবদি প্রায় সব কাগজই এদের কাছ থেকে ইংরাজীতে খবর কিনে যে যার ভাষায় অনুবাদ করে নিতেন।একটা সময় অবদি খবরের গুরুত্ববিচারে কাগজগুলি প্রভেদ করত।সম্পাদক তা নিয়ে রাজনীতি করতেন না।সম্পাদকের তথা কাগজের রাজনীতি বলার জায়গা ছিল সম্পাদকীয়।এই বিশুদ্ধ কাগুজে ঘরাণা ধীরে ধীরে ভাঙা শুরু হয়।এখন বলা ভালো বিলুপ্ত।এক সুশীলজনের আ্ক্ষেপ শুনুন।এখন কাগজগুলির খবর হল সম্পাদকীয়।
শিলচরে এসে বাংলা দৈনিকে বাংলা তথা কোলকাতার খবর অপ্রধান  শুরুতে এই ব্যাপারটি বাঙালীর বহুদিন লালিত অভ্যাস বা সংস্কারের সাথে মিলছিল না।নাগাল্যান্ডে মোককচং শহরে আরও দশ বছর আগের অভিজ্ঞতায় বাংলা কাগজ মানেই কোলকাতার।এসে পৌঁছত কখনও সপ্তাহের কাগজ একদিনে।দিন বরাবর সাজিয়ে নিয়ে গল্পের মত করে পড়তাম।শিলচরে এসে আমার বাংলা খবরে কোলকাতা সর্বস্বতার আকুলিবিকুলি বদলে গেল।শিলচরের জনজীবনে আর সাংস্কৃতিক কর্মে জড়িয়ে পড়ে ক্রমে বরাকবঙ্গের খবর জানার,খবর রাখার ক্ষুধা জন্ম নিল।বাংলা সাহিত্যের তিন ভূবনের এই তৃতীয় ভুবনে কোলকাতা প্রতিবেশী রাজ্যের।ঢাকা  বিদেশ।এখন কাগজে, ই-মিডিয়ায় তিন ভুবনের খবর রাখি।যতটা পারি।
সংবাদ তাই সাহিত্য একথায় আমার সংশয় নেই।যখন যে হাওয়া ওঠে।আজকের কাগজ যে যার অবস্থানে এক একটি হাওয়ামোরগ।এবং খবরে কুলোর বাতাস দেওয়াও একটি বাজারী বিপণন কৌশল।আমাদের সমাজে শিশুমৃত্যু,টাকার জন্য শিশু অপহরণ এবং খুন,ধর্ষণ,গণধর্ষণ,বধূমৃত্যু এসব খবর কাগজের ভাষায় পাবলিক খায়।একটির খবর একজন ছাপলেই একটা সময় অবদি সব কাগজেই এক ধাঁচার খবর উপর্যুপরি আসতে থাকে।যেন এর আগে এমনটা ঘটে নি।তারপর আর একটা অন্য খবর পালের হাওয়া কেঁড়ে নেয়।আবার সবাই একযোগে ঝাঁপায়।
এতে করে আসল খবরটি চাপা পড়ার আশঙ্কা থাকে।ভয়ের নয়,ভয় ভাঙার খবর গুরুত্ব পায় না।
২০০০ সালে যতদূর মনে পড়ছে শিলচর তথা বরাকে প্রধান দৈনিক পত্র ছিল দুটি।সোনার কাছাড় আর যুগশঙ্খ।দুটি কাগজের সঙ্গেই লেখালেখির সূত্রে সম্পর্ক ছিল।সোনার কাছাড় খবর টুকত।বাসী খবর।এমনকি কোলকাতার কাগজ বর্তমানের একটি হোর্ডিংলালিত বিজ্ঞাপনের বাকবিভূতি।ভগবান ছাড়া কিসব কিসব।সবটাই কিছু দোষের নয়।ভগবানের কথাটায় বর্তমান যা বলে তার পেটেন্ট নেই।বিদ্যা কম বিধায় অনেক নেতাও তো পেটেন্টহীন নীতিবাক্য নিজের বলে নির্দ্বিধায় চালিয়ে দিয়েছেন।জরুরী অবস্থায় সঞ্জয় উবাচ বলে যা চালানো হল স্মরণ করুণ।কথা কম,কাজ বেশী।সোনার কাছাড় নতুন কিছু করে নি।পত্রিকাটি অবশ্য অধুনালুপ্ত।
সেকাল থেকে এই সামান্য সতেরো বছরেই ডিজিটালে উল্লম্ফন কাগজের সজ্জা,সৌষ্ঠভ,, সম্পাদনা,মুদ্রণ সব কিছুতেই যুগান্তর এনেছে।দৈনিক সাময়িক প্রসঙ্গ এই পর্বের সংযোজন।বা তার সুমহান উত্থান এই কালপর্বে।আনন্দের কথা গত এক বছরেরও অধিককাল আমি এতে নিয়মিত কলাম লিখছি।শিলচর আসামেরও একটি প্রান্তিক জেলাশহর।একটি জেলাশহর থেকে যে কোন ভাষার সংবাদপত্র প্রকাশ আমাদের মুগ্ধ করে।প্রসঙ্গত কেরালার মালয়ালা মনোরমা কাগজটির কথা উল্লেখ করছি।মালয়ালাম ভাষার একটি পত্রিকা।এদের মনোরমা ইয়ারবুক ভূভারতে বিখ্যাত।জন্ম ১৮৮৮।প্রথম পর্বে যাত্রা সমাপ্ত ১৯৩৮ য়ে।তারপর ১৯৪৭ থেকে আজ অবধি নিরন্তর প্রকাশ হচ্ছে।হেড অফিস কোট্টায়াম।জেলাশহর।আজ অবদি একটি পাঁচতারার হোটেলও নেই।মালয়ালা মনোরমা প্রচার সংখ্যায় ভারতীয় ভাষার কাগজগুলির মধ্যে তৃতীয়।তেইশ লক্ষেরও বেশী পাঠক।
সংবাদ বিপণনের রাশ এখন আর কোন মহানগরের একচেটিয়া নয়।কৃস্টিনার কবিতার আরও চার লাইন এবার পড়াই।
Who has seen the wind?
Neither you nor I.
But when the trees bow down their heads
The wind is passing by.
হাওয়া এখন মফস্বলের পালে।বিশ্বায়ন এই সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছি।মাথা নোয়াচ্ছে মহানগর।
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours