গৌতম দাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার, রাজ্য আবগারি দফতর ও লেখক, কলকাতা:

নরেন্দ্র মোদী কি শেষ পর্যন্ত পারলেন ভারতে পরিবারতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারার সমাপ্তি ঘটাতে! তিনি কি সত্যিই পারবেন ভারতের অর্থনীতিকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে? পারবেন আমদের সপ্নের মাতৃভূমি ভারতবর্ষকে জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসনে বসাতে.....
 অনেক প্রশ্ন, বিতর্ক, বিশ্লষণ চলছে, ভারতের বর্তমান সরকার কি ঠিক পথে চলছে! তবে যতই বিতর্ক হোক না কেন, দ্বিতীয় দফায় আবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন নরেন্দ্র দামোদর মোদী, লোকসভা নির্বাচনে মোদীর নিরঙ্কুশ বিজয় প্রমাণ করে দিয়েছে যে, একজন সাধারণ চা বিক্রেতা থেকে দলের শীর্ষ পদে আরোহণ করে, তারপর ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়া সম্ভব,ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য সব সময়ই পারিবারিক কৌলিণ্যের প্রয়োজন হয় না, রাজপুত্র হতে হয় না! আদপে নিতান্ত এই সাদামাটা গল্পটাই ভারতের আপামর মানুষকে আন্দোলিত করেছে।
সব মানুষই এরকম একটা  সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে ওঠার গল্পই পছন্দ, আর নরেন্দ্র মোদীর এই উত্থান সেরকমই একটা গল্পের জন্ম দিয়েছে।
শৈশব থেকেই দারিদ্রের মধ্যে বড় হওয়া, জীবন ধারণের জন্য চা বিক্রি করা, এই চমকপ্রদ কাহিনীই হয়তো দারিদ্রসীমার নিচে বাস করা কোটি কোটি সাধারণ ভারতবাসীর মন ছুঁয়ে গেছে, তাই হয়তো মোদীকে তাঁরা নিজেদেরই একজন হিসেবে দেখছে।
আর মোদীর এই জনপ্রিয়তা কিন্তু প্রবলভাবে সঙ্কটে ফেলেছে কংগ্রেসকে?
নির্বাচনে পরাজয়ের পরই পদত্যাগ করতে চান রাহুল গান্ধী, হাস্যকর হলেও এটাই সত্যি যে কংগ্রেসকে অত্যন্ত দিশেহারা দেখাচ্ছে।
ভারত জুড়ে নরেন্দ্র মোদীর সমর্থন যতো  বাড়ছে, বিরোধী দলগুলো ততই দিশেহারা হয়ে বিজেপি কে ছেড়ে শুধু নরেন্দ্র মোদীকেই নিশানা করছে, এর ফল হচ্ছে উল্টো, দিন দিন দেশে ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নরেন্দ্র মোদীর জনপ্রিয়তা আরও দ্রুতগতিতে বাড়ছে।
যদিও এই নরেন্দ্র মোদী হয়ে ওঠার লড়াইটা মোটেও সহজ ছিল না, প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, ধনী সম্প্রদায় এবং বিশেষ করে পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াই করে তবেই তিনি ভারতের শীর্ষ রাজনৈতিক পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।
2014 সালের নির্বাচনে তাঁর দলের প্রচারের সময় কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট রাহুল গান্ধীকে তাই কটাক্ষ করে 'শাহজাদা' বা রাজপুত্র বলেও সম্বোধন করেছেন মোদী, সত্যিই তো তাই, পারিবারিক শক্তি ছাড়া আর কি আছে মহামান্য রাহুল গান্ধীর কাছে! কি তার যোগ্যতা! কংগ্রেসে কি তার থেকে আর কোনো যোগ্য নেতৃত্ব নেই! ভারতের স্বাধীনতার পর থেকে নেহেরু-গান্ধী পরিবারের সদস্যরাই তো অধিকাংশ সময় ভারত শাসন করে এসেছে আর অসংখ্য দুর্নীতির অভিযোগ  উঠে এসেছে এই কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে, সত্যি মিথ্যা যদি জনগণের উপর ছেড়ে দেওয়া যায়, বা নির্বাচন কে মান্যতা দিলে দেখা যাবে, ভারতের মানুষ সাস্প্রতিক নির্বাচনে এই প্রশ্নের জবাব দিয়েছে, 'রাজপুত্র' রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের লজ্জাজনক পরাজয় ঘটেছে। শুধু তাই নয় রাহুল গান্ধীর ভভিষ্যতই এখন আশঙ্কার মুখে। রাহুল গান্ধী তাঁর দলের বরাবরের শক্ত ঘাঁটি আমেথির আসনেই বিজেপির প্রার্থী স্মৃতি ইরানির কাছে হেরে বসে আছেন।                                          ভারতবর্ষের পারিবারতান্ত্রিক রাজনীতির ইতিহাস হয়তো  অনেকেরই সঠিক ভাবে জানা নেই, তাই সামান্য আলোচনা করতে একটি তথ্য তুলে ধরলাম :- 
ত্রিবেদি সেন্টার ফর পলিটিকাল ডেটা নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, ভারতের নির্বাচিত সাংসদদের মধ্যে প্রায় 30% ই রাজনীতির সাথে জড়িত পরিবার থেকে এসেছেন, 2004 থেকে 2014 পর্যন্ত নির্বাচনে পরিবারতান্ত্রিক রাজনৈতিক নেতাদের অনুপাত ছিল প্রায় 25%, অর্থাৎ প্রতি চার জনে এক জন, রাজপুত্র রাহুল গান্ধী সহ অন্যান্য রাজনৈতিক প্রভাবশালী পরিবার থেকে উঠে আসা আরো বিশাল সংখ্যক হেভিওয়েট প্রার্থীর পরাজয়ে আজ এই অবশ্যম্ভাবী প্রশ্নটা উঠেছে তাহলে কি ভারতবর্ষের  রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের প্রভাব কমে আসছে বা অবসান হতে যাচ্ছে !!
ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তর প্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সমাজবাদী দলের নেতা আখিলেশ যাদব, এবারের নির্বাচনে বিজেপির জয়রথ থামাতে তাদের চিরশত্রু বহুজন সমাজ পার্টির প্রধান মায়াবতীর সাথে বাধ্য হয়ে জোট বেঁধেছিলেন, তবুও কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি, উত্তর প্রদেশে বিজেপি'র জয়রথ থামানো যায়নি, প্রায় খড়কুটোর মতো উড়ে গেছে আখিলেশ যাদব আর তার জোট!! উত্তর প্রদেশের মোট আশিটি আসনের মধ্যে 62 বাষট্টিটি   আসনেই বিজেপির প্রার্থীরা জয়লাভ করেছেন। অখিলেশ যাদব নিজে জিতলেও তার স্ত্রী ডিম্পল যাদব কনৌজ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে যথারীতি হেরেছেন।
অখিলেশ যাদব ভারতের প্রাক্তন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এবং উত্তর প্রদেশের তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী হেভিওয়েট রাজনীতিবিদ মুলায়াম সিং যাদবের যোগ্য পুত্র! মাত্র
দু বছর আগেই দলের নেতৃত্ব নিয়ে বাবা মুলায়াম সিং যাদবের সাথে আখিলেশ যাদবের দ্বন্দ্ব এতটাই চরমে ওঠে যে বাবা ছেলে পারিবারিক ভাবেও সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যান, কিন্তু হাস্যকর ভাবে এবারের নির্বাচনের আগে ক্ষমতালিপ্সু মুলায়াম সিং যাদব তাঁর ছেলের হয়ে প্রচার চালিয়েছেন, এমনকি একসাথে র‍্যালিও করেছেন, দুর্ভাগ্যের বিষয় এই কৌশলও কিন্তু একেবারে ধোপে টেকেনি!    উত্তর প্রদেশের পর আসি   বিহারে, সেখানেও  লজ্জাজনক ভাবে হেরেছে  রাজনৈতিক প্রতিপত্তিশালী পরিবারের প্রার্থীরা।
প্রাক্তন মন্ত্রী আর এক হেভিওয়েট নেতা লালু প্রসাদ যাদব যখন দূর্নীতির দায়ে দন্ডিত হয়েছিলেন তখন তাঁর ছেলে রাজপুত্র তেজস্বী যাদব রাষ্ট্রীয় জনতা দলের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে তুলে নেয়, যদিও এই তেজস্বী যাদবের প্রথম পছন্দ কিন্তু রাজনীতি ছিল না, বরং পেশাদার ক্রিকেটে তার আগ্রহ বেশি ছিল কিন্তু ক্রিকেট ক্যারিয়ারে নানান প্রভাব খাটিয়েও যখন তেমন সাফল্য পেলেন না তখন তেজস্বী তার বাবার মত সক্রিয় রাজনীতিতেই  যোগ দেন। এই লালুপ্রসাদ যাদবের গল্পটাও কিন্তু অনেকটাই নরেন্দ্র মোদী'র মত লালুপ্রসাদ যাদবের জীবনের শুরুটাও অত্যন্ত সাধারণ ছিল, এই অতি সাধারণ গ্রাম্য দেহাতি জীবনযাপন করার জন্যই তিনি ছিলেন সুবিখ্যাত!
বিহারের অবোধ ভোটাররা সে সময় তাঁকে অন্ধবিশ্বাসে  নিজেদেরই একজন মনে করেছিল আর তাই তিনি এতো জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন কিন্তু তাঁর ছেলে তেজস্বীর ক্ষেত্রে বিষয়টি কিন্তু একেবারেই সেরকম নয় বরং উল্টো, সোনার চামচ মুখে নিয়েই তেজস্বী যাদবের জন্ম! তাই বিহারের ফলাফল, চল্লিশটি আসনের একটিতেও তাদের দল আরজেডি জিততে পারেনি।
অন্যান্য রাজ্যের ক্ষেত্রেও কিন্তু পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির অবস্থাটা এখন প্রায় একই রকম, মধ্য প্রদেশের গোয়ালিয়রের তৎকালীন রাজপরিবার থেকে উঠে আসা জ্যোতিরাদিত্য শিন্দিয়া, তার বাবা ছিলেন কংগ্রেসের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা এবং 'গুনা' আসনটিকে তাদের পরিবারের রাজনৈতিক ঘাঁটি হিসেবে বিবেচনা করা হতো এতোদিন, সেই আসনও খুইয়ে বসে আছেন জ্যোতিরাদিত্য শিন্দিয়া!
রাজস্থানের ঘেলত পরিবার এবং মুম্বাইয়ের দেওরা পরিবারের ক্ষেত্রেও ঘটেছে সেই একই ঘটনা।
দক্ষিণ ভারতে হেরে গেছেন কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী এইচডি কুমারাস্বামীর ছেলে নিখিল কুমারাস্বামী।
প্রাক্তন এবং বর্তমান মন্ত্রীদের ছেলেরা নির্বাচনে হারছেন, এমন ঘটনা আগে  ভারতের রাজনীতিতে সচরাচর খুব একটা দেখা যেত না কিন্তু হালফিলের এই সব ঘটনা থেকে ধারণা করা হচ্ছে যে নরেন্দ্র মোদী হয়তো ভারতবর্ষের রাজনীতিতে এক নতুন ঘরনা নিয়ে এসেছেন!  নরেন্দ্র মোদী ব্যক্তিত্ববান, বাকপটু, নাটুকে, একইসঙ্গে প্রখর জাতীয়তাবাদী এক লড়াকু চেহারা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করার চেষ্টা করছেন, তাই তীব্র অর্থনৈতিক মন্দা সত্তেও আজ নরেন্দ্র মোদীর হাত ধরেই এক উন্নততর ভারতবর্ষ, শক্তিশালী ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখছে মানুষ, বিশেষত দীর্ঘদিন ধরে চলা আসা পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির অবসান ঘটিয়ে, ভারতবর্ষের চিরাচরিত একটি অভিজাত পরিবারতন্ত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক প্রথা ভেঙে একজন সাধারণ মানুষের ভারতের জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী হওয়া আধুনিক ভারতের পটভূমিতে বিরাট পরিবর্তন এনেছে বলে মনে করা হচ্ছে, নেতা মন্ত্রীদের সাথে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক রাজা প্রজার সম্পর্ক থেকে বদলে এখন অনেকটাই আলাদা হয়ত তাই, বলা ভালো খানিকটা লেনদেন ভিত্তিক, আমি তোমাকে ভোট দেবো তুমি আমাকে পরিষেবা দাও, নইলে যাও...


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours