দেবযানী ভৌমিক (চক্রবর্তী), সহকারী অধ্যাপক, কৃষ্ণনগর:

রামচন্দ্রের অকাল বোধনই বর্তমানের শরৎকালীন দুর্গোৎসব৷ ক্রমে এই উৎসব বাঙালির সেরা উৎসবে পরিণত৷ শরতের চারটি দিনে শুধু বঙ্গদেশই নয় সমগ্র ভারত তথা পৃথিবী যেন মহামিলনমন্ত্রে জেগে ওঠে৷ এই অনুষ্ঠানের আত্মা হল অসাম্প্রদায়িক মানবাদর্শ৷ হিন্দু ধর্মীয় আচারবিধি পালিত হলেও বিভিন্ন ধর্মের মানুষ এই উৎসবে সামিল হন৷

আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি মহালয়ার ভোরে একদিকে যেমন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের স্তোত্রপাঠ অন্যদিকে মা রান্নাঘরে ব্যস্ত লুচি ভাজতে সুজি বানাতে বা মালপোয়া ভাজতে৷ মহিষাসুরমর্দিনী শেষ হলেই আমাদের বেরোতে হবে গঙ্গাস্নানে৷ বাবা তর্পণ করেন ৷ কাজেই বাবা সপরিবার যেতেন গঙ্গায়৷ স্নান সেরে পুজো দিয়ে কতক্ষণে মালপোয়া খাব আমাদের দু'ভাইবোনের মন থাকত সেই দিকেই৷ পুজো মানে শুধু তো ধর্মীয় উৎসব নয় বা অঞ্জলিতেই সীমাবদ্ধ নয়৷ বরং সবার ছুটি সে সময়৷ কাজেই মা আত্মীয়দের চিঠি লিখে আসতে বলতেন৷ সপ্তমীর মধ্যেই আমাদের বাড়ি ভ'রে যেত৷ বাড়িটা যেন কথা বলত৷ তখন আমাদের আর কে পায়! সারাদিন ছুটোছুটি৷ মা যে একাই সব কাজ সামলাচ্ছেন তা মাথাতেই আসত না৷ আজ সেটা ভেবে কষ্ট হয় খুব৷ যদিও মাই তো সবচেয়ে বেশি হাসিখুশি থাকতেন।

আমার চোখে বড় বিস্ময় সেটাই৷ মায়ের বিয়ের পরে, সেটা ১৯৭৪ সাল, মা গ্র্যাজুয়েট হলেন৷ অসম্ভব ভালো গান করেন৷ অনেক অনুষ্ঠান করতেন৷ অবাক লাগে সেই মানুষটি চাকরিতে যোগ দিলেন না সংসার সন্তানকে সময় দেবেন বলে৷ সময় মানে ২৪ ঘণ্টার এমার্জেন্সি সার্ভিস ৷ পুজোয় সবাইকে বাড়িতে আহ্বান জানিয়ে পরম তৃপ্তিভরে সবাইকে রান্না করে খেতে দিতেন৷ অষ্টমীর অঞ্জলিও দিতে যেতে দেখতাম না মাকে৷ কারণ আমরা অঞ্জলি দিয়ে ফিরলে আমাদের যে  পায়েস লুচি খেতে দিতে হবে৷ তারপর দুপুরে নানান ব্যঞ্জনের সঙ্গে মাংস ভাত৷ দুই হাতে দশ হাতের কাজ করতেন আমার মা৷ তাঁর একটি হাত ভাতটা করছে, অন্য হাত ডাল৷ আরেকটি হাত  মাংসটা সেদ্ধ হল কিনা দেখছে৷ অন্য হাতে ছানার ডালনা৷ আবার আর একটি হাত আমাদের ঘর গোছাচ্ছে৷ কখনও বাবার শার্টে বোতাম লাগাচ্ছে৷ সত্যি তিনি তো নিজেই দশভূজা৷ নাহলে কীকরে সম্ভব এত কিছু!

মার কাছে মাঝে মাঝে বায়না করতাম অঞ্জলি দেবার জন্য৷ মা বলতেন , "তোরা দিলেই তো হবে, আমি মানুষের মধ্যেই ভগবান পাই রে"৷ তখন অতটা বুঝতাম না৷ আজ বুঝি কতটা মনের জোর ও সততা থাকলে এমন কথা বলা যায়৷ আমার জেঠিমা খুব অল্প বয়সে বিধবা হয়েছিলেন৷ তিনি প্রতিবার আমার মাকে আলতা সিঁদুর দিতেন পুজোর সময়৷ জেঠিমা আমার মায়ের নাম করে বলতেন, " কৃষ্ণাকে দিলে আমার খুব শান্তি হয় মনে, ও এত সুন্দর করে গ্রহণ করে, অন্য এয়োদের তো দিতে পারি না৷" কোনওরকম সংস্কার বা কুসংস্কার মার মধ্যে কোনওদিন দেখিনি৷ অদ্ভুত মনের জোর৷ পাড়ার এক ভদ্রলোক বিধবা বিয়ে করেছিলেন৷  দশমীতে সিঁদুরখেলার সময় সেই নববধূ পাড়ার পুজোমণ্ডপে যেতেই বিরাট গোলযোগ৷ অন্য সধবারা তাঁকে দেখেই হৈচৈ শুরু করলেন, কেন এই শুভ মুহূর্তে তিনি বিধবা হয়ে সেখানে গেছেন ---এই নিয়ে৷ আমার মা অত শান্ত মানুষ হলেও ঐদিন জোরালো প্রতিবাদ করলেন ৷ বললেন , "ওও তো এখন সধবা, ওর তো স্বামী রয়েছেন, ওঁর কপালে তো তিনি সিঁদুর পরিয়ে দিয়েছেন, তাহলে তাঁকে এখনও এভাবে বলার কী আছে!" তারপর নিজেই তাঁকে সিঁদুর মাখিয়ে দিলেন, তিনিও মাকে সিঁদুর পরিয়ে প্রণাম করলেন৷ এরপর থেকে তিনি আমার মায়ের সঙ্গেই পুজোমণ্ডপে গিয়ে সিঁদুর পরাতেন দেবীকে৷ তারপর সবাই মিলে সিঁদুর খেলায় মাততেন৷

আজও দেবীবরণ ও সিঁদুরখেলার পরম্পরা দেখি৷ তবে আমার দেবীবরণ তো ঘরেই সারা হয়ে যায়৷


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours