কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

ভালোই খেলছিলেন সৌরভ।
সোমবার সকালে ব্রেকিং নিউজ তাকে নিয়েই। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি হচ্ছেন বেহালার ছেলে। তখন শুধুই সময়ের অপেক্ষা। বোর্ডের সবার পছন্দ বাংলার সৌরভ গাঙ্গুলি। এরপরেই হঠাত টুক করে মাঠে নেমে পড়লেন অভিজিত। সৌরভ যেন দুম করেই চলে গেলেন নন স্ট্রাইকার এন্ডে। বল পেটাতে শুরু করলেন অভিজিত।
ব্রেকিং নিউজ- নোবেল পেলেন বঙ্গসন্তান অভিজিত বন্দ্যোপাধ্যায়। পরে নাম আর পদবীর মধ্যে জুড়ে গেল আরও একটি শব্দ বিনায়ক। সব মিলিয়ে যা দাঁড়ালো- অভিজিত বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১৯- এর অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী। নোবেল পাচ্ছেন অভিজিতবাবুর স্ত্রী এস্থার ডুফলো এবং আরেক অর্থনীতিবিদ মাইকেল ক্র্যামার।

নোবেল পুরস্কার বলে কথা। বস নাম হি কাফি হ্যায়। ২০১১ সালে প্রেসিডেনসি কলেজের সার্বিক উন্নতির নজরদারি করতে তৈরি হয়েছিল এক মেন্টর গ্রুপ। তার অন্যতম সদস্য ছিলেন এই অভিজিত বন্দ্যোপাধ্যায়। চলনে বলনে সেই অতি পরিচিত বাঙালি বিদ্বজ্জনের কোনও কেতা নেই। বরং উল্টোটাই। বেশ ফুরফুরে লম্বা চেহারা। মুখে ঝরঝরে বাংলা। এক আমুদে বাঙালি। তখন কিন্তু এই গুণীজনকে নিয়ে কোনও কথাবার্তা শোনা যায়নি বাঙালিদের মুখে। বাস্তবে কেই বা তাঁর খবর রাখতেন? তবে ২০১২ সালে কীর্তিমান বাঙালিদের এক অনুষ্ঠানে দেখা গেছিলো তাঁকে। তিনি অনুরোধ করেছিলেন তাঁর লেখা 'পুওর ইকোনমিক্স' বইটা পড়ে দেখতে। আশ্বস্ত করেছিলেন অর্থনীতির কোনও জটিলতা নেই। অভিজিতবাবুর সেই কথা শুনে ঠিক কজন ওই বইটা পড়ে ফেলেছিলেন?
স্রষ্টাকে চিনতে হলে, খবর রাখতে হয় তাঁর সৃষ্টির। নাকি বাঙালির ভরসা কবিগুরুর সেই বাণীতেই- তোমার সৃষ্টির চেয়ে তুমি যে মহত!

এই তথ্য প্রযুক্তির যুগেও যে হাতেগোনা কিছু মানুষজনই খবরাখবর রাখেন, তার প্রমাণ সোশ্যাল মেডিয়া জুড়ে। হুজুগে বাঙালি তখনও ঠিক করে উঠতে পারেনি, আজ পর্যন্ত যে নোবেলগুলি এসছে তা বাংলার প্রাপ্তি নাকি কলকাতার। ভারত নামের বস্তুটা তো দূর অস্ত! হুগলি নদীর ওপারে কিছুতেই নোবেল যেতে দিতে চান না কলকাতার উদারমনস্করা। যাই হোক, অনেকের হিসেবে এ শহর/রাজ্য ছিনিয়ে এনেছে ছ- ছ'টি নোবেল। কেমন যেন গরমিলের হিসেব- কিতেব!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দিয়ে শুরু বাঙালির নোবেল জয়(১৯১৩)। এরপর দ্বিতীয় নোবেল আসে অমর্ত্য সেনের হাত ধরে(১৯৯৮)। অবিভক্ত বাংলায় জন্ম মহম্মদ ইউনুসের, পান তৃতীয় নোবেল(২০০৬)। তিনি অবশ্য বাংলাদেশের নাগরিক। চতুর্থ নোবেলজয়ী বঙ্গমূল অভিজিত বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়(২০১৯)। তিনি মার্কিন দেশের নাগরিক। স্কুল কলেজ কলকাতায়, পরে দিল্লিতে। কিন্তু অভিজিতবাবুর কর্মকাণ্ডের সবটুকুই সেই মার্কিন মুলুকে। ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি'র ফোর্ড ফাউন্ডেশনের অধ্যক্ষ। ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন 'আবদুল লতিফ জামিল পোভার্টি অ্যাকশন ল্যাব(জে-ল্যাব)'। মোদ্দা কথা, তিন বাংলার বাঙালি আর এক বঙ্গমূলের ব্যক্তিই আজ পর্যন্ত নোবেল পেয়েছেন।
আছেন আরও একজন, মাদার টেরিজা। আলবেনিয়ায় জন্ম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর কর্মযজ্ঞর জন্য বেছে নিয়েছিলেন এই মহানগরীকে। নোবেলপ্রাপ্তির সময় মাদারের পরিচয় ছিল কলকাতার এক মাননীয় নাগরিক।
অভিজিতবাবুর নোবেলপ্রাপ্তি কলকাতার নোবেলপ্রাপ্তি হলে, মাদার টেরিজার নোবেলপ্রাপ্তি কিন্তু আলবেনিয়ার নোবেলপ্রাপ্তি।

কিন্তু প্রশ্ন অন্যখানে, সোমবারের জোড়া সুখবরের পর মেডিয়া হাইপে সৌরভকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেলেন অভিজিতবাবু। কেন?
বিশ্বজয় করেছিলেন সৌরভও। লর্ডসের গ্যালারিতে 'দাদা'র জামা ওড়ানো। প্রাক্তন মহারাজার দেশে গিয়ে জামা ওড়ানো সৌরভকে সেদিন সত্যিই মনে হয়েছিল 'মহারাজ'। তবে সেতো খেলার মাঠে। আর অভিজিতবাবু তো সরস্বতীর বরপুত্র। এই দুজনায় তুলনা চলে নাকি? খেলা, ব্যবসা বানিজ্য, অ্যাডভেঞ্চার সবকিছুই তুচ্ছাতিতুচ্ছ বাঙালির কাছে। বাঙালি শিক্ষা জ্ঞানের পূজারি। প্রাইভেট টিউশনির ধুম ঘরে ঘরে। আরও একটা জিনিসে বাঙালির বংশানুক্রমিক দুর্বলতা- ইংরেজি শিক্ষা। চলনে বলনে কেতায় সবেতেই সাহেবিপনা। আর ঠিক এ জায়গাটিতেও, বেহালার সৌরভের বলে ছক্কা হাঁকিয়ে বসে আছেন আমেরিকার নাগরিক অভিজিত বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। হোক না তিনি আদ্যোপান্ত বাঙালি, থাকেন তো আমেরিকায়। বিদেশিনীর সঙ্গে সংসার। ইংরেজিতে লেখেন, ভাবেন। হয়তো স্বপ্নও দেখেন ইংরেজিতেই। আর সেখানে বেহালার ছেলে সৌরভ। তাই বাঙালির জোড়া জোড়া চোখ তখন শুধুই অভিজিতবাবুর ওপর।

তাঁর ছেলে পুরোদস্তুর ভারতীয়। একথা বারবার মনে করিয়ে দিতে হয়েছে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবেদের মা নির্মলা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। দিল্লির এক নামকরা চ্যানেলের সাক্ষাতকারে নির্মলা দেবী জানিয়েছেন, নাগরিকত্ব বদল করা নিয়ে তেমন কোনও মাথাব্যথা ছিলো না ছেলের। বরং দ্বিধা ছিল। সে যাই থাকুক না কেন, উইকিতেও অভিজিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচয় 'আমেরিকান ইকনোমিস্ট'। কোনও আবেগই তাঁকে ভারতীয় করতে পারবে না। তাঁর গবেষণার জন্য অভিজিতবাবু অন্য আরও দুই নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ
এস্থার ডুফলো, মাইকেল ক্র্যামারের সঙ্গে বেছে নিয়েছিলেন আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকাকে।

অভিজিতবাবুর নোবেলপ্রাপ্তি নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলার স্পর্ধা দেখায়নি বামপন্থী বা অন্য কোনও রাজনৈতিক শিবির। অথচ ভারতের রাজনীতির সঙ্গে যে তাঁর কোনও যোগাযোগ নেই এমনটাও নয়। গত নির্বাচনে দেশের দরিদ্রতমদের মূলস্রোতে নিয়ে আসতে ন্যূনতম আয় যোজনার কথা নিয়ম করে শুনিয়ে গেছিলেন রাহুল গাঁধি। একশোটি দরিদ্র পরিবারের কুড়িটাকে বার্ষিক ছিয়াত্তর হাজার টাকা আয়ের প্রতিশ্রুতি সুনিশ্চিত করার কথা বলা হয়। ওই যোজনার উপদেষ্টা কমিটিতে ছিলেন অভিজিত বন্দ্যোপাধ্যায়।
অন্যদিকে দেশের আজকের আর্থিক মন্দার জন্য বিজেপিকেই দুষেছেন অভিজিতবাবু। নোটবন্দির সিদ্ধান্তেরও কঠোর সমালোচনা করেছিলেন তিনি। বিজেপি বিরোধিতার এই সুর শুনেই সম্ভবত বামপন্থীদের তুখোড় সমালোচনার থেকে রেহাই পেয়ে গেছেন অভিজিতবাবু। তবে রাজনৈতিক মহল যাই বলুক, ভারতে স্বল্প মেয়াদি ক্ষুদ্র পূঁজিনিবেশ নিয়ে আশাবাদী এই নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ। কিন্তু এতে সময় লাগবে বলে তাঁর মত।
ওদিকে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর সঙ্গে কথা বলে কংগ্রেস, বামপন্থীদের বিরাগভাজন হয়েছেন
সৌরভ গাঙ্গুলি। তাঁর বিসিসিআই- এর সভাপতি হওয়ার ঘটনায় অমিত শাহের ছায়া দেখতে পেয়েছে বামপন্থীরা। একই সন্দেহ কংগ্রেস শিবিরেও। যদিও সৌরভ স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন, রাজনীতি নিয়ে একটি কথাও হয়নি অমিত শাহের সঙ্গে।
বাঙালির আবেগ, বাংলার রাজনীতির আবর্ত, দিনশেষে এগিয়ে রাখলো নোবেলজয়ী অভিজিত বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়কেই।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours