কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:


কালীপুজোর রাত।
শব্দবাজির রাত।
মানুষের পৈশাচিক উল্লাস।
এরচেয়ে ভূতের দাপটও ভালো।

দুম দাম। কানফাটা শব্দ। পিলে কাঁপানোর জন্য যথেষ্ট।
মহানগরীর পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ সবদিকেই। এমনকি জেলাতেও।
তবে শব্দবাজির দাপট কোথাও কম, কোথাও বেশি। কিন্তু দৌরাত্ম চলছেই।
বাতাসে বারুদের তীব্র গন্ধ। রাস্তার কোথাও হালকা, কোথাও ঘন ধোঁয়ায় ঢাকা।
খবরে জানানো হয়েছিল, পুলিস এবার গতবারের চেয়েও বেশি সজাগ। বাজেয়াপ্ত করেছিল প্রচুর পরিমাণে নিষিদ্ধ শব্দবাজি। কিন্তু তাতে কী এসে গেলো, মাথায় ঢুকলো না!
আলেকজান্ডার আজ আমাদের মধ্যে থাকলে, নিশ্চিত ভাবেই আরও একবার সেই বিখ্যাত ডায়লগ ঝাড়তেন- সত্য সেলুকাস, বড় বিচিত্র এই দেশ!

আজ শহরে এমন অনেক মানুষের ছড়াছড়ি, যারা ইনহেলার টেনে বাঁচেন। উৎসবের রাতে তাঁদের শ্বাসকষ্ট আরও খানিকটা বাড়ে। একটা পাফের বদলে দুটো কী তিনটে, মাঝরাতে আরও একবার ইনহেলারের আরেকটা পাফ নিতে হয়। অনেকের আজ দরকার পড়ে স্টেরয়েড ইনহেলার।
কষ্ট বাড়ে মাইগ্রেনে ভোগা রোগীদের। আর যাঁরা হার্ট পেশেন্ট তাঁর গোটা পরিবারটাই সন্ধ্যা থেকে চাপে পড়ে যায়। নবজাত, শিশুরা মুখ গোঁজে মায়ের বুকে। আঁকড়ে ধরে বাবাকে।
শব্দবাজির ভয়ের চোটে উধাও পাড়ার কালু, ভুলুরাও। কোথায় লুকায় কে জানে। গবেষণা বলছে, বাজির তীব্র আওয়াজে ওদেরও হৃদকম্প হয়। পাখিরা বোধহয় গতিক সুবিধার নয়, পুজোর আগের রাতে বাজি ফাটানোর নমুনা দেখেশুনেই বুঝতে পেরেছিল। তাই গতরাতে বাজির দাপট কম থাকলেও, ওরা ডাকাডাকি করে সাধ্যমতো প্রতিবাদ করে ছিল বৈকি। কিন্তু পুজোর রাতে ওরাও চুপ।
তবু বিরামহীন নেই দুম- দামের। ননস্টপ শব্দবাজি।
খবরের চ্যানেল তখন দারুণ ব্যস্ত, দেবীপূজার লাইভ টেলিকাস্টে। যাবতীয় খুঁটিনাটি, অতীত, বর্তমান বিখ্যাত পুজোর। শব্দবাজির তাণ্ডবের লাইভ টেলিকাস্ট হয় না। কেন? সংবাদ চ্যানেল তো। সংবাদ কোথায়? গণতন্ত্রের প্রহরী বলে তো গলা ফাটান কর্তারা।

পৈশাচিক আনন্দ বোধহয় একেই বলে। অন্যকে যন্ত্রণা দেওয়াতেই আনন্দ।
তবে শহরে সভ্য- ভব্য কিছু লোক আজও আছেন। তাঁরা আনন্দ করেন তুবড়ি, রংমশালের উজ্জ্বল আলোয়। অনেকে আবার হাওয়াই, রকেট বাজি ওড়ান। দুরন্ত গতিতে আকাশে ছুটে যায়। শেষপর্যন্ত আকাশেই বিস্কোরণ। কোনটা আবার আলোকপুঞ্জ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। ফানুসপ্রেমীরা ফানুস উড়িয়ে নিজেরাও কল্পজগতে ভেসে যান। বেশ লাগে। তবে এবারেও তুবড়ির বলি হয়েছে মানুষ।
কিন্তু শব্দবাজির তান্ডব? যত পিলে চকমানো শব্দ, ততই আনন্দ। হেঁপো রোগী আরও হাঁপাক। আরেকটু নাহয় বাড়ুক  হার্ট পেশেন্টের বুকের ধক- ধক ! রে বাবা, একটাই তো রাত দেওয়ালির। একটু নাহয় কষ্ট সহ্যই করলেন। কেন?
ভূত চতুর্দশীর রাত থেকেই কিছু মানুষের ওপর ভূতে ভর করে। তারা সুস্থ মানুষের পিলে চমকিয়ে দাঁত বার করে হাসেন। সুযোগ পেয়েই গা- ঝাড়া দিয়ে বেরিয়ে পড়ে ভেতরের পশু।
ছাগশিশুর অসহায় আর্তনাদে তাঁদের উল্লাস। চোখের সামনে বলি। রক্তে পিচ্ছিল মন্দির প্রাঙ্গণ। বলির মাংস দিয়ে মাঝরাতের ভোজ। যাঁদের সেই সুযোগ থাকে না, তাঁরা সকালে মাংসের দোকানে লাইন লাগান।
উদারবাদীরা বলেন, "ধর্ম আমার, উৎসব সবার।" এই যদি উৎসবের হাল হয়, তাহলে তা সবার না হলেই মঙ্গল।

ওদিকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পুলিসের গাড়ি।
ওয়ার্ক ইজ ওয়ারশিপ!
কালীপুজোর রাতে এবার শব্দবাজির দাপট কমাতে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছিল পুলিস, দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের বীরপুরুষরা। পুজোর আগের থেকেই খবর আসছিল এখান থেকে, ওখান থেকে পুলিস বাজেয়াপ্ত করেছিলো প্রচুর পরিমাণে শব্দবাজি। এত কিছু করেও অবস্থাটা শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়িয়েছিলো তা দেখাই গেলো। বিকেল পাঁচটা বাজতে না বাজতেই শব্দবাজির বজ্রনির্ঘোষ। পিক আওয়ার ছ'টা থেকে এগারোটা। তারপর হুঙ্কারে ভাটার টান। কিন্তু রাত দেড়টা, দুটোতেও ভেসে এসছে শব্দবাজির আওয়াজ।

প্রশাসন থেকে হামেশাই প্রচার চলে, শব্দবাজি দৌরাত্ম হলেই সামনের থানায় খবর দিন। কিন্তু যখন থানার চতুর্দিকেই শব্দবাজির ধুম তখন কে কাকে খবর দেবে? ওঁরা তো শব্দবাজির গন্ধ পান। সেই গন্ধ শুঁকেই  নিষিদ্ধ শব্দবাজি বাজেয়াপ্ত করেন। কিন্তু কী এক রহস্যময় কারণে, পুজোর রাতে ওঁদের কানে শব্দ যায় না। একই হাল দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের। মধ্যে মধ্যে তো সন্দেহ হয় নিজের কানের সুস্থতা নিয়েই। এই শহরেই তো কতো মন্ত্রী, হাই প্রোফাইল, বিদ্বজ্জনের বাস। তাঁদের কারও কানে এই আওয়াজ পৌঁছায় না কেন? তবে নিয়মমাফিক, এবারেও শব্দবাজি ফাটানোর অপরাধীরা পুলিসের হাতে ধরা পড়েছে।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি চলছেই। সাত শব্দশহিদও ব্যর্থ বেপরোয়া বঙ্গসন্তানের শব্দবাজিপ্রেম রুখতে। আদালতের শাসনেও পরিবেশ বদলায়নি। নাকি এর পেছনেও আছে বিরোধীদের চক্রান্ত অথবা শাসকদলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব? নাকি সর্ষের মধ্যেই ভূত?

পরিবেশবিদবাবুরাই বা কী বলেন? এঁদের ভূমিকা পুরনো হিন্দি সিনেমার পুলিসের মতো। ঘটনা মিটে যাওয়ার পর ঘটনাস্থলে গিয়ে তড়পান। দর্শক ততক্ষণে হল ছেড়ে বেরতে শুরু করে।
কিই বা বলেন নব্য বাঙালি, বাংলাপ্রেমীরা? গুটকাখোড়দের জন্যই এই হাল। ফেসবুক পরিবেশেপ্রমীরাই বা কী বলেন? আমাজনের আগুন, পরিবেশ দূষণ নিয়ে তো ফাটিয়ে দিয়েছিলেন।
কে প্রশ্ন তুলবেন, শব্দবাজিপ্রেমীদের দৌরাত্ম নিয়ে? পুলিস, দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদকর্তাদের জবাবদিহি চাওয়া হোক সরকারি প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করতে পারার জন্য।



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours