জীবন রায়, প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ, রাজ্যসভা:

আজকের দিনে কারা সরকার গড়ছেন,সেটা বোধ হয় গুরুত্বহীন । তার থেক বেশি গুরুত্বের, ইতিহাসের প্রেতাত্মার দৌরাত্মে শীতল হতে থাকা জনতরঙ্গ, উত্তপ্ত হতে থাকাটা শুরু  হয়েছে কী না। মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানা, বিশেষ করে উপনির্বাচনের ফলাফলকে এই  নিরিখেই বিবেচনা করা উচিত হবে।

নির্বাচনী ফলাফল থেকে এটা স্পষ্ট, বিগত এক'শ বছরে বিশ্ব এবং ভারতীয় ইতিহাসের আলোক মালার, কিঞ্চিতাধিক আলো যারা পেয়েছিলেন, তারাই বর্তমানের অন্ধকারের কাল ভেদ করে বেড়িয়ে আসার চেষ্টা করছেন। এই চেষ্টার মধ্যে আরো দু'টো সত্য বেরিয়ে আসছেঃ
প্রথমতঃ নেহেরু-কাল ইতিহাসের যে আলোকে ধরতে পেরেছিলেন, সেই আলোকে শক্তিশালি না করে, একপ্রান্তে নেহেরুকে ব্যবহার এবং অন্যপ্রানে আমেরিকান দাসত্বনীতিতে
শক্তি যোগানো কারনেই, এবং
----- অন্যপ্রান্তে সাম্যবাদীদের 'আলোর পথ' কে পেছনে রেখে, দাতা-গ্রহীতার অর্থনীতিকে মূল্য দেওয়ার কারনেই
আজ অতি-অতীতের প্রেতাত্মা আবার ফিরে আসার সুযোগ পেয়ে গেলো। এই উভয় দুর্বলতাই, বানিজ্যিক পুঁজি্র  এক বিপুল অংশ এবং মধ্যমবর্গের আত্মপরতা - এই প্রেতাত্মাকে
ক্রমে আত্মিক করেছে। আমেরিকা মিলিটারী তন্ত্র স্বাভাবিক
কারনেই এই প্রেতাত্মার সাথে আত্মিক হতে বাধ্য।

পরিস্থিতি অনেকটা সে রকম যখন, ইউরোপের প্রটেষ্টান গীর্জা, ক্যাথলিকদের সাথে লড়াই করে, রেনেঁশার সূচনা করেও পুজিতান্ত্রিক সংকটের সুচনায়, ক্যাথলিক ধর্মযাজকদের থকেও ভয়ংকর হতে শুরু করলো। ইতিহাসের সাথে মিলিয়ে দেখলেই স্পষ্ট হবে --
-----প্রকৃ্তির দ্বান্দ্বিকতা পুস্তকের ভূমিকায় এঙ্গেলস লিখছেনঃ
"যাদের আত্মাহুতি দিতে হয়েছিলো বধ্যভূমিতে এবং ইনঙ্কুইজিসানের ( inquisition) এর অন্ধকারায় এবং এটা লক্ষ করার বিষয়, যে প্রকৃ্তি সম্মন্ধে স্বাধীন গবেষনাকে দন্ড দেবার ব্যাপারে প্রোটেষ্টান্টরা ক্যাথলিকদের  ছাড়িয়ে গিয়েছিলো।"  

লেখাটাকে এগিয়ে দেওয়ার  পূর্বে মহামতি এঙ্গেলসের একটি উধৃতি তুলে ধরা উচিত হবে।   লেখার শিরোনামায় একটি শব্দের ব্যবহারকে পরিস্কার করতেই এটা দরকার।  প্রকৃ্তি বিজ্ঞানের প্রথম তিনটি গতি ( বল বিদ্যা, রসায়ন এবং শরীর বিদ্যা) একাত্ম রুপ,  
-----তার সাথে সমাজবিজ্ঞান (বা মন কিংবা ইতিহাস) এর একাত্মতার সাথে রেনেশাঁর যোগসুত্র, তিনি যেভাবে একাত্ম করে প্রকৃ্তির সন্ধান করেছেন - তার আগে কিংবা পরে, আর কেউ, তেমনটি করেছেন বলে মনে হয় নাই। 

----- আজকাল তো সাম্যবাদীরা হাইয়ার্কির বিচারের বাইরে কিছু শুনতেও চায় না, তবু তাদের পরামর্শ দেবো, এঙ্গেলসের 'প্রকৃ্তির' দ্বান্দিকতা' পুস্তকের সবটা পড়তে যদি কষ্টও হয়, তবে তারা সেই পুস্তকের 'ভূমিকা'টা ভালো করে পড়ুন,অন্তত দশবার। অন্যথায়, ইতিহাস কিংবা দ্বন্দ্ব তত্ব বা জ্ঞান তত্বের মধে ঢুকতেই পারবেন না। আজকের দিনে একে বাদ দিলে, রাজনীতি বা ট্রেড ইউনিয়নে,যাই করুন না কেন - আপনার স্পেস শত্রুর হাতেই ছেড়ে আসতে থাকবেন।

যাইহোক, ইতিহাসের স্থবীরতায়, কিভাবে এবং কোথা থেক প্রথম আঘাত আসে  - তার ব্যখ্যা,  এঙ্গেলস এর লেখা উল্লেখিত ভূমিকায়, আগে ও পরের,কয়েকটি কথায়, স্পষ্ট হবে। সে কথা কয়টি, জ্ঞানের সংকোচনে কিভাবে  ইতিহাসের স্থবীরতার কারন হয়ে উঠে এবং জ্ঞান জগতের নব উত্তোরনের মধ্যেই  যে সেই স্থবীরতা  থেকে মুক্তি ঘটে, তা স্পষ্ট করেছেঃ
----- ভূমিকার  প্রথম দিকে, ইউরোপীয় রেনেশাঁর আগমনকালটিকে চিহ্নিত করতে গিয়ে  লিখছেন
"বাইজেনটিয়ামের পতনকালে যে পুঁথিগুলি রক্ষা পেয়েছিলো এবং রোমের ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রাচীন মুর্তিগুলি উদ্ধার করা
গিয়েছিল - তা থেকে বিস্মিত প্রতীচ্যের সম্মুখে যে একটি নতুন জগৎ প্রকাশ লাভ করেছিলো...।মধ্যযুগের প্রেতগুলি তার (রেনেঁশা) প্রোজ্জ্বল রূপের সামনে শুন্যে মিলিয়ে গেল্ল, ইতালি জেগে উঠলো"
নেহেরু আমলের জনজাগরনকে বিশ্বায়নের নামে  ঢলে পরতে দেওয়ার সাথে যখন  রেনেশার  পতনকালের, পুর্বে বর্ণিত inquisition অন্ধকারার আলোতে যদি দেখা হয়, 
----- তবেই, আজকের ভারতীয়  ধর্মান্ধতা,বানিজ্যিক পুঁজির   এবং আমেরিকানতন্ত্রের  আধিপত্বের, সম্ভাব্য জ্ঞানগত এবং রাজনৈ্তিক বিপদের চালচিত্রটি আগাম  চিহ্নিত করা সম্ভব।

এইভাবে এঙ্গেলস ইনক্যুইজিসান কালপুর্ব এবং পরবর্তী প্রকৃ্তি বিজ্ঞা্নের পরিস্থিতিটি ব্যখ্যা করেছেনঃ

" কিন্তু যা এই যুগকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করেছিল তা ছিল একটি অদ্ভুত সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি্র সম্প্রসারন , যার কেন্দ্রবিন্দুত এই মতের অধিষ্ঠান যে প্রকৃৃ্তি হচ্ছে চুড়ান্তভাবে অপরিবর্তনীয়।, প্রকৃ্তি  যেভাবে সৃষ্টি হয়ে থাকুক না কেন, একবার সৃষ্ট হবার পরে তা ধ্বংস না হওয়া পর্য্যন্ত একইরকম থাকবে।"
একের পর এক লেখায় বোঝানোর চেষ্টা করেছি, বিশ্বে এবং দেশের ইতিহাসে  যা চলছে্‌ তার প্রধান উৎস, রেনেশাঁ ভেঙ্গে যাওয়ার পর, ক্রম কেন্দ্রিভূত পুঁজির তরফ থেকে জ্ঞান জগতকে সৃজনী থেকে বিচ্ছিন্ন করার অতি আগ্রহ থেকে। সোভিয়েত ভেংগে ফেলাও, ভেতর আর বাইরের চাপে, হয়েছে,
প্রধানতঃ মানুষকে বৌদ্ধিক দিক থেকে পংগু করে ফেলার জন্যেই। 
এই সুত্রেই, ভারতে, ধর্মান্ধদের আবির্ভাবকে যদি মধ্যযুগীয় প্রেতাত্মার আবির্ভাব বলা হয়ে থাকে, সেটাও মূলতঃ কেন্দ্রিভুত
বিশ্ব পুঁজির ইচ্ছা হিসেবেই মানতে হবে। মানতে হবে, নিজের অর্থনীতিকে বেঁচে দিয়ে বানিজ্যিক পুঁজির উপর নির্ভর করা
এবং সেই সুত্রে সাম্যবাদীদের ভাবাদর্শগত বিচ্ছিন্নতার পরিনতি। 

বিষয়টিকে আরো স্পষ্ট হচ্ছে, যখন এঙ্গেলস বলছেনঃ

"(তখন) সময়ের সঙ্গে বিকাশমান মানব ইতিহাসের বিপরীত বৈশিষ্ট প্রকৃ্তির ইতিহাসের ওপর আরোপিত হচ্ছিলো, যা নাকি কেবল স্থানভিত্তিক উন্মোচন। প্রকৃ্তির ক্ষেত্রে সমস্ত পরিবর্তন, সমস্ত বিকাশজে অস্বীকার করা হচ্ছিল। প্রকৃ্তি বিজ্ঞান, যা গোরায় ছিলো এত বৈপ্লবিক, হটাৎ দেখলো যে তা দাঁড়িয়ে আছে এজ আগাগোড়া রক্ষনশীল প্রকৃ্তির মুখোমুখি। সেখানে আজো সবকিছু তেমনই আছে যেমনটি ছিল শুরুতে এবং পৃথিবীর আয়ূস্কাল পর্য্যন্ত বা অনন্তকাল ধরে সবকিছু তেমনই থাকবে, যেমন থেকেছে প্রথম থেকে"।

আমেরিকা, তাদের বাজারের সাথে যারা যুক্ত, তাদের যদি একথাটা বিশ্বাস করতে বাধ্য করতে হয়ঃ যেন ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটেছে এবং দাসত্বটাই সত্য, ইতিহাসের মাঝখানের আলোরেখা - জোনাকির আলো বই কিছু নয় তবে
---- কতগুলি ব্যবস্থাকে ভারতকে মানতে বাধ্য করা হচ্ছে বুঝে নিনঃ 
প্রথমতঃ
 চিরন্তন দাসত্ব এবং সেটাই সত্য বলে মানাতে, ইতিহাস এবং প্রকৃতি বিজ্ঞানকে অতি-অতীতে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য
জ্ঞান থেকে সৃজনীর বিচ্ছিন্নতা।
দ্বিতীয়তঃ
একই কারনে, দেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থাকে ভেংগে গুড়িয়ে দেওয়া। আমেরিকার ইচ্ছা অনুযায়ী ভাব জগতকে পূনঃর্গঠিত করা।
তৃ্তীয়তঃ 
বিপরীত মেরুতে একমাত্র সংগঠিত শক্তি হিসেবে,    শ্রমিকদের সার্বজনীন একতা , শ্রেনী রাজনীতি এবং সামাজিক অংশ গ্রহনকে ক্রমাগত অনিশ্চিত করে দেওয়া।
চতুর্থতঃ
এই পথটা ধরেই শ্রমিক দাসত্বজে শুনিশ্চিত করা এবং সেক্ষেত্রে ভারতে ব্রাহ্মন্যবাদের যে ব্যাধী ইতিমধ্যে সামাজিক জীবনে পচন ধরিয়েছে, সেই বর্নাশ্রমকেই, শিল্প সম্পর্কে প্রতিস্থাপন করা।
পঞ্চমতঃ 
সাংস্কৃতিক পচন ঘটানোর কারনেই, চিন্তার আধুনিকতাকে ভেংগে দিয়ে, বন্যাবস্টার সংস্কৃতিকে প্রতিস্থাপন করা। সেই সংস্কৃতি এবং মধ্যযুগীয় ব্যবস্থার মিশ্রন ঘটিঁয়ে - নারীরকে বাজারজাত করতেই, নারীর আত্মমর্য্যাদা বিনাশকে সামাজিকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক করে নেওয়া।

পরিপ্রেক্ষিতটা যখন পরিস্কার হয়ে যায়,
তখনই সাপ্রতিক নির্বাচনী ফলাফলের অভিমুখ,
সম্ভবনা এবং চ্যালেঞ্জগুলিও সামনে আসতে থাকবে।
এই সুত্রেই বলতে হবে, একে যারা 'সরকার নির্মান
কিংবা ভাংগার মধ্যে সিমীত রাখবেন তারা, নিজেদের এবং
যারা কার্য্যতঃ বিরোধী নেতৃ্ত্বহীন অবস্থায়, ধর্মান্ধদের - এঙ্গেলসের
কথায় অতি-অতীতের সব  প্রেতাত্মাদের, ঘাম ছুটীয়ে ছেড়েছে,
তাদের প্রতি চুড়ান্ত অপমান করা হবে।
বুথ সমীক্ষাগুলি মহারাষ্ট্রের প্রায় সবটাই বিজেপি-শিবসেনাকে দিয়েছিলো এবং আমরা সবাই বিশ্বাস করেছিলাম। সেখানে ওদের শুধু  ২২টা আসন হাতছাড়া হয়েছে তাই নয়, বিপুল হারে ভোটের গড় কমেছে। হরিয়ানাকে তো ওয়াক ওভার দেওয়া হয়েছিল, সেখানে ২০০% ভোট কমেছে। ওদের ভরাডুবি হয়েছে,  বিভিন্ন রাজ্যের উপনির্বাচনগুলিতে এবং এমণ কী গুজরাটেও। ওরা জম্মু-কাশ্মীরে এমণ ডোবা ডুবেছে, যে একদিনের মধ্যে রাজ্যপালের চাকরী খোয়াতে হয়েছে। প্রায় সোয়া চারশ' আসনের বিরোধীহীন নির্বাচনে বিজেপি গোটা ৮২ আসণ নিজের কব্জায় নিতে
পেরেছে।
এই সাফল্যে বিরোধী রাজনীতি এবং এমণ কি সাম্যবাদী উদ্যোগের পারদ যদি একেবারে নিম্নমানে থেকে থাকে, তবে সাফল্যটা কার? রাজনীতির-পন্ডিতরা যদি এর জবাবটি খুজে পান, ঠিক ঠাক তবেই  হাজার দুয়ারীর
আসল দরজাটি খুজে পাওয়া যাবে।
ছোট বুদ্ধিতে জবাবটা দিতেই পারি।
 এ দেশে বর্তময়ান কালে, জ্ঞানের  সৃজনমুখীনতার বিপরীতে জ্ঞানহীনতার  জনীতিহীন রাজনীতির যে দৌ্রাত্ম চালানো হচ্ছিলো
----- ভারতীয় সমাজের এখনো যারা ইতিহাস এবং জ্ঞানের প্রবাহে
টিকে আছেন, সাম্প্রতীক নির্বাচনে, অতীতের প্রেতাত্মার বিপরীতে
এক সংঘবদ্ধ চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লালফৌজের হাতে হিটলারের বিশ্বজয় পরিকল্পনার নিধণ, রক্তবাদের বিপরীতে দুনিয়ার মজদুর এক হোক সত্বার সাংস্কৃতিক আবির্ভাব, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন, নেহেরু-সাম্যবাদী দ্বৈরথে সোভিয়েত অর্থনৈতিক সাহায্য, সাম্যবাদী আন্দোলনের একশ'  কুড়ি বছরের সম্মিলিত ভাবপ্রবাহে
------  যারা যারা কিঞ্চিৎ সাতার কাটার সুযোগ পেয়েছেন, তারাই অতীতের প্রেতাত্মা সমুহকে আটকে দিতে প্রথম কাজটা সেরে দিয়েছেন এবং  বলে দিয়েছেন হাজার দুয়ারীর আসল দরজাটা কোন দিকে।
----- সাথে সাথে আরো একটা গুরুত্বপূর্ন সতর্ক বার্তা দিয়ে দিয়েছেন।
গুলি নেকেড়ের বুকে লাগে নাই / পদযুগলেও নয়। প্রেতাত্মাদের দখলে
পুরো সংগসদীয় কাঠামোটা।
----- উল্টো দিকে কেবল জনগণ। একমাত্র জনগণ। এবং ইতিহাসের  গৌ্রব গাঁথা এবং অভিজ্ঞতা। তার সাথে  ফলিত বিজ্ঞান হিসেবে, সর্বোচ্চ স্তরে আরোহনে, মার্ক্সবাদী  দর্শণ এবং প্রয়োগরীতির দর্শন - লেনিনবাদ।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours