গৌতম দাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার, রাজ্য আবগারি দফতর ও লেখক, কলকাতা:

কুমারী পুজো বলতেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে বেলুড় মঠের ছবি, সারি সারি কুমারী পূজিত হচ্ছে দশভুজা দূর্গার সামনে, আর বেলুড়মঠ মানে শুধুই স্বামী বিবেকানন্দ। এই মহামানবের জীবনের একটা চমকপ্রদ কাহিনি, 1898 সাল, বিশ্ব-পরিব্রাজক রূপে খ্যাতিলাভ করে তখন সবে ভারতে ফিরেছেন স্বামী বিবেকানন্দ, সারা ভারতবর্ষের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, আর ঘুরতে ঘুরতেই তিনি  পৌছে যান কাশ্মীরেও, ডাল লেকের একটি হাউসবোটে রাত্রিবাস করছেন, সেখানকার এক মুসলমান মাঝি ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ ও তার সঙ্গের সন্ন্যাসীদের  আতিথেয়তার দায়িত্বে, সেই মাঝির এক ছোট্ট মেয়েটি মাঝে মাঝেই ওই সন্ন্যাসীদের সঙ্গে খেলায় মেতে উঠত। স্বামী বিবেকানন্দ নিজেও ছোট্ট মেয়েটিকে খুব স্নেহ করতেন, এমনই একদিনে কেউ একজন সুন্দর কিছু পাহাড়ি ফুল বিবেকানন্দকে উপহার দিয়ে যান, এরপর  ওই ছোট্ট মেয়েটি প্রতিদিনের মত যখন বিবেকানন্দের কাছে আসে, তখন স্বামীজি সেই ছোট্ট মুসলমান মেয়েটির পায়ে সেই ফুল অর্পণ করে, প্রণাম করেন। তাঁর এই পুষ্প অর্পণ যদিও কোনও পঞ্জিকা বা তিথি মেনে কুমারীপূজা হয়নি তবু এক মুসলমানের কন্যাকে দেবীরূপে পূজা করা অষ্টাদশ শতকে একটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।

ফিরে আসি সাম্প্রতিক কালের ইতিহাস শৃষ্টি করা এক অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনায়, পেশায় ইঞ্জিনিয়ার বাগুইআটির বাসিন্দা তমাল দত্ত, কামারহাটি পুরসভায় চাকরি করেন। 2013 সাল থেকে তার নিজের বাড়িতে দূর্গা পূজা শুরু করেছেন এবং নিয়ম মেনে কুমারী পুজোও করেন। ব্রাহ্মণ কন্যার পাশাপাশি অব্রাহ্মণ কুমারীদেরও পুজো করেন এই তমালবাবু। তাঁর একটা সুন্দর স্বপ্ন ছিল, একবার দেবী দুর্গার সঙ্গে এক অ-হিন্দু কন্যার পূজার্চনা করবেন। কিন্তু সেই ইচ্ছে পূরণে নানান বাঁধা আসছিল, এমন একজনও উদারমনস্ক মুসলিম পরিবারের খোঁজ তিনি পাচ্ছিলেন না, যে সব ধর্মীয় সংস্কারের উর্ধে উঠে নিজের কুমারী মেয়েকে হিন্দুরীতি মেনে একটি পুজোর জন্য পাঠাবেন। বহু অপেক্ষার পর অবশেষে এবছর তমালবাবুর মনের সেই সুপ্ত বাসনা পূরণ করতে এগিয়ে আসেন তাঁরই পরিচিত কামারহাটির বাসিন্দা মহম্মদ ইব্রাহিম, তমালবাবুর এই আন্তরিক ইচ্ছের গুরুত্ব বুঝে তাঁকে আশ্বাস দেন, এবং শেষপর্যন্ত তিনিই মুশকিল আসান করলেন এই বছর। ইব্রাহিমের চার বছরের ভাগনি ছোট্ট মেয়ে ফতেমা, ফতেপুর সিক্রির বাসিন্দা, সেই পরিবারের হাত ধরেই তমালবাবুর বহুদিনের আকাঙ্ক্ষা এবছর পূর্ণতা পেল। এ বছরই তাঁর বাগুইআটির বাড়িতে অষ্টমীতে পূজিতা হলেন চার বছরের মুসলমান কন্যা ফতেমা। মহম্মদ ইব্রাহিমকে আন্তরিক ধন্যবাদ, যিনি ভারতবর্ষের এই মূহুর্তে ঘটে চলা সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা আর চরম ধর্মীয় ভেদাভেদের উর্ধে উঠে প্রমাণ করে দিয়েছেন, ধর্ম এতো সহজে নষ্ট হয়ে যায় না, মৌলবাদীদের চাপ রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বাড়িয়ে দিয়েছেন সম্প্রীতির মজবুত শক্ত হাত, আজ আমার গর্বিত মাথা নতজানু করলাম মহম্মদ ইব্রাহিমের পায়ে। আর তমালবাবুর বক্তব্য ও তুলে ধরলাম:- ‘আমার জীবনের আদর্শ স্বামী বিবেকানন্দ, 1898 সালে তিনিও এক মুসলিম কন্যাকে দেবীজ্ঞানে পূজা করেছিলেন। সেই ঘটনাই আমাকে এভাবে ভাবতে শিখিয়েছে। তাই আমি চেয়েছিলাম, এক মুসলিম কন্যাকে কুমারী রূপে পূজা করতে। এতদিন পর সেই ইচ্ছে পূরণ হচ্ছে, এর চেয়ে বেশি আনন্দের আর কিছু হয় না।’...

আসুন আবার সবাই মিলে বলি 'আমরা শুধুই গর্বিত বাঙালী, আমাদের ধর্ম মনুষ্য ধর্ম '।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours