গৌতম দাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার, রাজ্য আবগারি দফতর ও লেখক, কলকাতা:

বাঙালী হিসেবে গর্বিত, অর্থনীতিতে এবার নোবেল খেতাব যৌথভাবে পেলেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, এস্থার ডাফলো এবং মাইকেল ক্রেমের।
 আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য তাঁদের পরীক্ষামূলক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।
অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ডাফলো- যাঁরা ঘটনাচক্রে স্বামী-স্ত্রী, তাঁরা যৌথভাবে একটি বই লিখেছেন, যার নাম পুওর ইকোনমিক্স। অভিজিৎ এবং এস্থার ডাফলো ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে পড়ান এবং ক্রেমের হারভার্ড ইউনাভার্সিটির সঙ্গে যুক্ত। 
কেন অর্থনীতিতে নোবেল পেলেন অভিজিৎ বিনায়করা, এককথায় বলতে গেলে বলতে হয়:- "স্কুলে যেসব শিশুরা যাচ্ছে তারা যথেষ্ট শিখছে না কেন, তারা এ বিষয়টিকে ভেঙে নিয়ে দেখতে চেয়েছেন, আর কী দেওয়া হলে এ ব্যাপারে তাদের সাহায্য করা যায়, এক্ষেত্রে একটা জিনিস যেমন পাঠ্যবই  কিন্তু তাঁরা এটাও দেখেছেন শুধু বই দেওয়াই যথেষ্ট নয়, যদি না স্কুলগুলিকে বিনামূল্যে সংস্কারের ব্যবস্থা করা যায়, এই দৃষ্টিভঙ্গির জন্য ফিল্ড এক্সপেরিমেন্টের প্রয়োজন হয়েছে এবং বোঝার প্রয়োজন হয়েছে যে একটি ক্ষুদ্র নীতির উদ্যোগগ্রহণ কার্যকরী হচ্ছে কি না, এবং যদি না হয়, তাহলে কেন তা হচ্ছে না"।
এই সমস্যার বিষয়েই কিছু কথা, যা গ্রামে গঞ্জে আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় চাকরির সুবাদে নিজের মতো করে বোঝার চেষ্টা করেছি সেটাই বিশ্লেষণ করব:-
এই কলকাতা শহরের বাইরে আর এক বিরাট জগৎ আছে, সেখানে চোখ রাখলেই পৌঁছানো যায় গোটা দেশে, সেখানেও মানুষ বাস করে, যেখানে বাচ্চারা ওয়াটার-বটল, টিফিন-বক্স নিয়ে স্কুলবাসে স্কুলে যায় না!                              কলকাতা শহরে বাস করি তবু এই দেশের দারিদ্র্যের সম্পর্কে কোনো ধারণা হবে না, এ হয় নাকি! মধ্যবিত্ত পরিবারে থেকেও দারিদ্র্যের ন্যূনতম স্পর্শটুকু না পাওয়ার কথাও নয়। তখন চাহিদা আর চাহিদা মেটার মধ্যে বিস্তর তফাত ছিলো, ছোট্ট ছোট্ট সামান্য  চাহিদা গুলোও ছিল স্বপ্নের মতো, সুন্দর জীবনের সরলার্থ বিত্তের উপর দাঁড়িয়ে যে বদলে যেতে পারে সে সম্পর্কে কোনো ধারণা ই ছিল না। আজকের যুগে যেমন কোন মানুষের কাছে কোন কাজ বা কোন মানুষ  গুরুত্ব পাবে তা মূলত নির্ভর করে মানুষটি সমাজে কোন শ্রেণিতে অবস্থান করছে বা তার ধর্মের উপর ভিত্তি করে, তেমনটা ছিল না সেসময়, একজন শিশু বা বালক, কী তার জীবনের লক্ষ্য হবে, তার অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখতে তাকে কি কি তাকে অর্জন করতে হবে আর কি কি তাকে বিসর্জন দিতে হবে, তা বুঝিয়ে দেওয়াই ছিল সমাজের মূল দায়িত্ব, সেটা মা বাবা আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশীরা সবাই মিলে শিখিয়ে দিতো। আজ যখন দেখি এক শ্রেণীর পেছিয়ে পড়া শিশুর কাছে স্কুলে গিয়ে লেখাপড়া করা আর পেট ভরে খাওয়া (মিড ডে মিল) সমগোত্রীয়, তাদের অভিভাবকদের কাছে কি সত্যিই  প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ঠিক ততটা গুরুত্বপূর্ণ, যতটা এ সমাজে কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজনীয়। সমাজের উচ্চবর্ণের মানুষের শিক্ষার হার বা কর্মসংস্থানের হার  প্রমাণ করেছে যে মৌলিক শিক্ষা বা বৃহত্তর উদ্দেশ্য শিক্ষা অর্জন করতে পেছিয়ে পড়া মানুষরা সে ভাবে এগিয়ে আসছে না, শিক্ষা ও উপার্জনের এই দুটি বিষয়ের সহাবস্থান আমাদের সমাজে এখন   বিবর্তিত হচ্ছে, কতটুকুু অত্যাবশ্যক কেবল তার মধ্যেই আবদ্ধ না থাকাই এখন মানবজীবনের পরিবর্তিত জীবনধারা। ক্রমবর্ধমান চাহিদা যা জনসংখ্যার থেকেও দ্রুত হারে বেড়ে চলেছে প্রতিদিন একটু একটু করে। আমাদের দেহ সাড়ে তিন হাতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ কিন্তু তাই বলে ঠিক সেই সাড়ে তিন হাত পরিমাণ গৃহ নির্মাণ করিলে চলে না, স্বাধীন চলাফেরার জন্য আরও একটু বেশী স্থান আবশ্যক, কিন্তু কতোটা!  খাদ্য  সম্বন্ধেও সেই একই  কথা খাটে। যতটুকু কেবলমাত্র পেট ভরাতে অত্যাবশ্যক বা সঠিক স্বাস্থ্য রক্ষা করতে প্রয়োজন তার মধ্যেই কি এক শ্রেণীর মানুষের মন যথেষ্ট পরিমাণে আনন্দিত হতে পারছে?      আসলে পুঁথিগত শিক্ষার সঙ্গে স্বাধীন, সচ্ছ ও সামাজিক শিক্ষা না মেশালে মানুষ ভালো মানুষ হতে পারে না।                                                    ‘জীর্ণ পুরাতন’ ছিঁড়ে মুক্ত হওয়ার একমাত্র হাতিয়ার হিসাবে শিক্ষাই, আমাদের ‘মানসিক পাকযন্ত্রকে পুষ্ট করতে পারে, একমাত্র শিক্ষার হাত ধরেই উন্নততর জীবনে পৌছনো সম্ভব, হ্যাঁ ধর্মের হাত ধরে হাঁটা যেতে পারে কিছুটা  দুর কিন্তু দৌড়ে লক্ষে পৌছনো সম্ভব নয়। শিক্ষার সঠিক মুক্ত আলো পেলে আমাদের কর্তব্য, দায়িত্ব, অধিকারের উচিত অনুচিত  ব্যাকরণ গুলো আর কেউ গুলিয়ে দিতে পারবে না। কিন্তু আধুনিক কালে যা দাঁড়িয়েছে তাতে শিক্ষা বলতে আমরা বুঝলাম, উপার্জনের প্রায়োজনে শিক্ষা, প্রতিষ্ঠিত মানে বিত্তশালী।
“স্বাধীনতা”-র বাহাত্তর বছর পরও শিক্ষার গুণগত মান গ্রামাঞ্চলে দরিদ্র মানুষের কাছে মিড ডে মিলেই ঘুর পাঁক খাচ্ছে! শিক্ষার সার্বজনীনিকরণের উদ্দেশ্যে সর্বশিক্ষা অভিযানের মৌলিক লক্ষ্য সঠিক থাকলেও ফলাফল অভিপ্রায় মতো বা আশাব্যঞ্জক হয় নি, কারণ  এখনও দেশের শিশুশ্রম ঘুচল না, স্কুলছুটের সমস্যা মিটল না। শুধুমাত্র  শিক্ষানীতির প্রণয়নগত ত্রুটি, দুর্বলতা নয়, এই বিপন্ন ভয়াবহ চিত্রটির পিছনে রয়েছে এদেশের অর্থনৈতিক অব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা বা তার নীতিগুলিকে এর থেকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখা এক্ষেত্রে আদৌ সম্ভব নয়। এ রাজ্যের, এদেশের স্কুলছুটেরা কেন স্কুলছুট হয়, তার কারণ কেবল স্কুল প্রাঙ্গণে খুজলেই মিলবে না। স্কুলছুট হওয়ার পর যে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে একজন নাবালক শ্রমে যোগ দেয়, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শেষেও সে ওই একই পরিমাণ পারিশ্রমিক    পাবে, তার বেশী পাবে না বলে সে বুঝতে বা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে বা এই সমাজ তাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। শিক্ষিত প্রাপ্তবয়স্ক বেকার দের দেখে তাদের এই কথাই হয়তো মনে হয়েছে বার বার, ‘আমরা যতই বিএ, এমএ পাস করি, রাশিরাশি বই পড়ি, চাকরিটা কিছুতেই  হাতের মুঠোয় ধরতে পারবো না !  যে শিক্ষান্তে কাজ নাই, সে শিক্ষাকে টেনে হিঁচড়ে তাই বয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনও কারণও নেই, কার্যত সেই জন্যই স্কুলছুট শিশু বা তাদের পরিবার কোনো কারণও খুঁজে পায় না শিক্ষিত হওয়ার, ফলে মানুষ গড়ে তোলার কাজটি আর হয়ে ওঠে না। প্রতিষ্ঠানের শংসাপত্র জোগাড় করার বাসনা বা বিলাসিতার সময় দরিদ্র মানুষের কাছে আর নেই, সংসারের জোয়াল টানার প্রয়োজনের প্রশ্নে শিশুর স্কুলছুট হওয়া একপ্রকার সামাজিক স্বীকৃতি পেয়ে গেছে তাই।
এমনটা যদি তর্কের খাতিরে মেনে নিতে হয়, তাহলে বুঝতে হবে এ দেশ স্বাধীন সভ্য দেশ নয়, তবু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি  এমনটাই চলছে   ভারতবর্ষে, কোথাও  লাগামছাড়া বৈভব আবার কোথাও লাগামছাড়া দারিদ্র্য এই দুইয়ের সহাবস্থান এদেশের  বৈচিত্র্যপূর্ণ ছবি, পরিণতি দুঃসহ বৈষম্যে। তবু আমাদের জাতির অস্তিত্ব রক্ষা করতে কুসংস্কার, জাত-পাত আর ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। শিক্ষার ঘরানা বদলাতে হবে। ভেবে দেখতে হবে, কেমন করে শিক্ষা সমাজের সম্পদ শৃষ্টিতে সহায়ক হবে। পাঠক্রমের পরিবর্তন পরিমার্জন ও পদ্ধতিগত বদল আনতে হবে। শিক্ষান্তে কাজ পাওয়ার মতো প্রাথমিক দক্ষতাটুকু যাতে শিক্ষার্থীর তৈরি হতে পারে, সেদিকে নজর দিতে হবে। নচেত শিক্ষার্থীর মনে টানাপোড়ন তৈরি হবেই, রাষ্ট্রকে সুনিশ্চিত করতে হবে সকলের কর্মসংস্থান।  সংসারের প্রাপ্তবয়স্ক মানুষটির পূর্ণ কর্মসংস্থানের অভাবেই দরিদ্র মানুষ পরিবারের শিশুদের শ্রম বেচার পথ ঠেলে দেয়। শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য জরুরি পরিবেশের প্রায় গোটাটাই শিশুর জীবন থেকে হারিয়ে  যায়, শিশুশ্রম বা স্কুল ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতা বন্ধ না হলে মানবসম্পদ শৃষ্টি হতে পারে না। ফলস্বরূপ দেশের সার্বিক অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়তে বাধ্য, গোটা সমাজের পক্ষে এটা অত্যন্ত  উদ্বেগের বিষয়!


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours