সুবীর পাল, এডিটর, দ্য অফনিউজ:
সেই আবার চলে এলো ভাইফোঁটা। সাক্ষী শুধুই বিষাদের অশ্রু।
শারদীয়ার পরপরেই তো দিপাবলী। তারপরেই আরও এক উৎসব ভাইফোঁটা। মনে পড়ে যায় অঙ্গনার কথা। আমি তখন স্কুলের পড়ুয়া। নামী স্কুলের সে হয়তো প্রাইমারীর ছাত্রী। দেখতে বেশ সুন্দর। সকালে ক্লাস হবার সুবাদে আমি দুপুরের আগেই স্কুল বাসে বাড়ি ফিরতাম। কিন্তু সেই বাসের পরবর্তী ট্রিপে তার ফিরতে ফিরতে দুপুর দেড়টা। তার বাড়ি খানিকটা দূরে হলেও বাসটা কিছুক্ষণ দাঁড়াতো আমার বাড়ির সামনেই। কিছু স্টুডেন্ট যে সেখানেও নামতো।
অঙ্গনা রোজ বাসের জানলার পাশে বসে থাকতো। একদিন হঠাৎ আমায় দেখে একগাল হেসে টাটা করলো। সেই শুরু।
আমিও তার বাস আসার অপেক্ষায় রোজ দুপুর দেড়টায় বাস স্টপেজের কাছে ঘুরঘুর করতাম এক অমোঘ আকর্ষণে। আর রোজ ও আমার জন্য জানলার কাছে এসে হাসতো। টাটা করে হাত নাড়াতো। একদিন হঠাৎ  বাসের জানলা থেকে মুখ বাড়িয়ে বললো দাদা তুমি ভালো আছো? আমি বললাম হ্যাঁ বোন আমার, আমি ভালো আছি। তুই কেমন আছিস। কথা শেষ হতে না হতেই বাস ছেড়ে দিত। তাই ওইটুকুতেই আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হতো।
দিন যায় এভাবেই। ছুটির দিন বাদে রোজ।একদিন যথারীতি দুর্গাপুজোর স্কুলছুটির আগের  দিন এসে গেল। আমিও ওকে একটা গ্রিটিংস কার্ড ও সঙ্গে লাল একটা গোলাপ দিয়েছিলাম বাসটা থামতেই। কি হাসি মুখেই না ও সেদিন সেগুলো আমার কাছ থেকে নিল একেবারে ছোঁ মেরে।
সেই শেষ তার সঙ্গে কথা বলা। আর কোনওদিনই সে আর জানলার ধারে আসতোই না। আমি খুব দেখবার চেষ্টা করতাম তাকে। স্কুল খুলে গেলে। আসলে সে বাসেই বাড়ি ফিরতো। বুঝতে পারতাম, আমার কাছ থেকে লুকিয়ে থাকতো। আবার রাস্তায় আচমকা দেখা হলেও সে না হাসতো না কথা বলতো। আমিও অনুমান করতাম নিশ্চয় কিছু একটা হয়েছে।নাতো এমন আচরন সেইবা করবে কেন? আমিও আর বুঝতে পারিনি আসলে আমার বোন কেন এমন করছে।
তবে বুঝেছিলাম বেশ কয়েক মাস পর। সেদিন যা বুঝেছিলাম তাতে একটা অভিমান নিজের উপরেই হয়েছিল। তারপর থেকে কত বছর যে আমি আর কারও কাছে ভাইফোঁটা নিই নাই কে জানে?
ভাসা ভাসা শুনেছি আজ অঙ্গনা নামী ইঞ্জিনিয়ার। এও অন্যমুখে শুনেছি সে আজ খুবই প্রতিষ্ঠিত। অসামান্যা সুন্দরীও। কিন্তু আমার বোন কোথায় থাকে তার কিছু বিন্দু বিস্বর্গ আমার আজও অজানা। তবু সে যেখানেই থাকুক সুখে থাকুক। দাদা হিসেবে এই আর্শীবাদ তাকে তো আজও করি। ভাইফোঁটার দিনটা এলে আজও তাকে মনে পড়বেই। ইসসস এবারও ভাইফোঁটার দিনে অঙ্গনাকে যদি পেতাম। কি জানি জানি চিনতে পারবো কিনা আদৌ দেখা হলে। কতদিন দেখিনি তাকে।
সেই যেদিন তার সঙ্গে শেষ কথা। সে বছরও ভাইফোঁটা পেড়িয়ে গিয়েছিল কালের নিয়মেই। তারও মাস খানেক পর। একদিন বাবা অফিস থেকে ফিরেই আমায় ডাকলো। বললো পাশে বসতে। আমিও যথারীতি পাসে বসলাম ভয়ে ভয়ে। অনিচ্ছা সত্বেও। বাবা বললো, তুই অঙ্গনাকে কি বলেছিস? আমি আকাশ থেকে পড়লাম। আমি যে কিছুই বলিনি জানাতে বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো ওরকম কেউ করে রে বোকা?
আসলে বাবার কাছে যা শুনাম তাতে অঙ্গনার বাবা আমার বাবার সঙ্গে দেখা করেন। সেদিন।অফিসে। কারণ তাঁরা ছিলেন সহকর্মী। তারপরেই  অফিস ফেরত বাবা আমায় নিয়ে বসে। বাবা বলে, হ্যাঁ রে তুই অঙ্গনাকে লাল গোলাপ দিয়েছিস। আমি বললাম, হ্যাঁতো দিয়েছি তো। বাবা বললো, জানিস ওর বাবা আমায় বলেছেন, অঙ্গনার মা খুব রেগে গেছেন তুই ওকে গোলাপ দিয়েছিস বলে। অঙ্গনাকে খুব বকাবকি করে ওর মা ওকে বলে দিয়েছেন যাতে তোর সঙ্গে আর কোনও যোগাযোগ না রাখে। এটাই নাকি ওর বাবা আমার বাবাকে বলেছিল। আমিও এবার বুঝে গেলাম অঙ্গনা আমায় দেখে কেন বাসে লুকাতো।
এরপর বাবা আমায় বললো, তুই কি ওকে গ্রিটিংস কার্ড দিয়ে ছিলিস। আমিও তা দেবার কথা স্বীকার করে নিই এক রাশ হিম আতঙ্কে। আসলে নিয়মিত নানা বদমাইসির কারণে বাবার রাম ধোলাই ছিল আমার কাছে বারমাস্যার বিষয়। তাই আড় চোখে দেখছি বাবার বেল্টটা কোথায়। কারণ হেলিকপ্টারের পাখার মতো ঘুরতে ঘুরতে যে ওটা আমার পিঠে পড়তে চলেছে তা আমি অনুমান করেই ফেলেছি। এবার বাবা গুরুগম্ভীর ভাবে জিজ্ঞেস করলো কি লিখেছিলিস ওতে। আমি বলির পাঁঠার মতো কাঁপতে কাঁপতে বললাম  আমি কার্ডে লিখেছিলাম-“আমার মিস্টি বোন অঙ্গনা। আমার নিজের বোন বলতে কেউ নেই। তুই আমার বোন রে। এবারের ভাইফোঁটায় পারলে আমায় ফোঁটা দিস।দাদা হিসেবে বোনকে এই গোলাপটা দিলাম এই প্রস্তাবের গিফট হিসেবে। তুই ভাল থাকিস।” আমার কথা শুনে বাবা চুপ করে বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপর সস্নেহে বললো, পৃথিবীটা বেশ শক্ত রে বেটা। যা বিকেল হয়ে গেছে। খেলতে যায়। সন্ধ্যের আগে চলে আসবি।
আবার ফের আরও একটা ভাইফোঁটার দিন চক্রবাঁকের মতোই এসে গেল। আবার সেই না ফোঁটা নেবার পালা সাঙ্গ হল। নিঃশব্দে। বুকের কানাগলিতে অবুঝ মন আবার খুঁজে বেড়াচ্ছে আমার সেই বোনটাকে, আর বলে ওঠে আমার অবুঝ বিবেক, অঙ্গনা তুই ভালো থাকিস রে…। সেদিন বাবা যে বেল্টের মার দেয়নি সেটাই ছিল আমার বড় পাওনা। তাই খুশি মনেই ক্লাবের মাঠে চলে গিয়েছিলাম ক্রিকেট খেলতে। তবে একটা অজানা অভিমানে আমি আর কারও কাছেই ভাইফোঁটা নিতাম না পরের বছর থেকে। এই বয়সে জীবন বিকেলের প্রান্তে দাঁড়িয়ে বাবার সেই দিনের কথাগুলোর নিগূঢ় অর্থ বুঝতে পারি, “পৃথিবীটা বেশ শক্ত রে বেটা।” জানি এতটাই শক্ত বাবা গো, শুধু একটা মাত্র লাল গোলাপ আমার ভাইফোঁটার গোটা পৃথিবীটাকেই রক্তাক্ত করে দিয়েছে। আজীবণের জন্য। আজও আমি বিদ্ধ সেই গোলাপের তীব্র ছোবলে। অঙ্গনা তুই খুব খুব ভালো থাকিস বোন আমার।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours