ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়, লেখিকা, কলকাতা: 

বারোয়ারি পুজোয় শেষ তুলির টান। রংচঙয়ে ব্যানারে বিজ্ঞাপিত শহরের পুজো। মায়ের চক্ষুদান বাকী। কেনাকাটার আনন্দনিকেতনে আপাততঃ ঝাঁপ। আলোর রোশনাই দেখে লজ্জা পায় চাঁদ। সামলায় নিজের জোছনা কে। গৃহসজ্জায়, ঘরের রঙে, সাজ পোশাকে সর্বত্র এমন ।

টিভির পর্দায় বিউটি ট্রিটমেন্টের হরেক সম্ভার। বিজ্ঞাপনে একেক রকমের রঙের ছটা। না না সে যুগের মত মুখ মোটেও ঢেকে যায় না বিজ্ঞাপনে বরং আরও উদ্ভাসিত হয়। ড্যামেজড সুনামী চুলকে শাইনিং করার চেষ্টা।  হেয়ার কালারে সমৃদ্ধ ললনারা আহ্লাদে আটখানা । মেতে উঠেছে সেই রঙের আনন্দে। জরিবুটির গুণে সমৃদ্ধ তেল দেন কেউ। নারী পুজোর ক'দিন পাবেন মখমলি কেশ। রেশমের মত কোমল হবে আবার পশমের মত বাউন্সি হবে। কেউ আবার এই পুজোয় টাকের ওপর ধান চারার মত চুল গজিয়েই ছাড়বেন বলে প্রতিজ্ঞা বদ্ধ।

শপিং মলে সেল বাড়াতে সেলিব্রিটি দিয়ে পুজোর প্রোমো। সঙ্গে ঢাকের বাদ্যি।

ওদিকে সোনার পুজোয় সোনার সুযোগ সোনার দোকানে। আরেক দিকে মায়ের হাজার হাতের হাজার স্বাদের প্রতিশ্রুতি। দশভুজা কোথাও শতভুজা হয়ে ফিরছেন এই বাংলায়। পাড়ায় পাড়ায় সেরার লড়াই। পুজো টিজারে এ পাড়াকে টপকে ওপাড়া। সেই ফাঁকে সুগন্ধের শেষ কথা নিয়ে সৌরভ হাজির আগরবাতীর গন্ধ নিয়ে।

প্রতিমার সঙ্গে  সেলফি তুলতে ব্যস্ত হবে তামাম টিন দুনিয়া। কি নাম দেব এই নিজস্বীর? এ ভঙ্গীর? গডফি? নাকি কুল ফি?
চ্যানেল সার্ফ করতেই দেখি দাদা দেখায় শক্তিশালী লোহার রড তো দাদু হাতের গুল ফুলিয়ে শক্তি দেখান, তারুণ্যের প্রতিমূর্তি হয়ে। হেসে বলেন, "ঠিক আমার মত'
দিদু পুজোয় ঘর ভরে থৈ থৈ রান্নাবান্না করার প্রতিশ্রুতি দেন। পাটভাঙা গরদ পরে, গা ভরা গয়না পরে হাসিমুখে রন্ধনের বন্ধনে আবদ্ধ থাকবেন পুজোর চারটে দিন। বয়ে গেছে মেয়েদের। এ কদিন কেউ হেঁশেলে ঢুকবেই না । সুন্দরী দিদু যতই তুমি বিজ্ঞাপন দাও।  দিদু দেন প্রতিশ্রুতি ।  তিনি দুহাতে হাজার স্বাদের ঢালাও আয়োজন করেন নাতিপুতির জন্য। সেই রান্নার ঝাঁঝে চোখে জল আসে বাঙালীর। 
না বাপু এমন জিনিষ  খাবই না পুজোর কদিন যাতে চোখে জল আসে।

দোকানে বস্ত্রসম্ভারের বিপুল আয়োজনে আস্থার মাপকাঠি তো হাসপাতালে জীবন ফিরে পাবার বহুমূল্যের প্রতিশ্রুতি। পুজোয় পান নবজীবন। সেখানেও বাই ওয়ান, গেট ওয়ান ফ্রি।
কেউ বলেন শাড়ির সঙ্গে পুজোর ক'দিন আড়ি না করতে। দোকানি বলেন শাড়ির বাজারে মন্দা। মেয়েরা আজকাল শাড়ি পরছেই না। হ্যাঁ তা বটেই। নাইটি তো ন্যাশানাল ড্রেস এখন। মিডিয়ার সামনেও রাত পোশাকে সাবলীল বাঙ্গালী।

চায়ের চুমুকে "আহা'  বলতেই কেউ দেয় গোলা দুধের আশ্বাস। মাতৃ দেবী দুগ্ধ রূপেণ সংস্থিতা।
সর্বত্র পুজোয় থিমের ছোঁয়া। কোথাও থিম আবার কোথাও ডিম। ডিম? আমিষের ছোঁয়া পুজোতে? হ্যাঁ, ডিম উতপাদক সংস্থা বলেছে, ডিম খান ও খাওয়ান। স্পনসর বলে কথা। চুলোয় যাক আমিষ। খোলা প্যান্ডেলে ডিমের খোলা, গাছে ডিম, আলোয় ঝুলছে তোড়ায় বাঁধা ডিম। কারো গাছের পাতার থিম। পরিবেশ বান্ধব। পুরষ্কারের প্রত্যাশী। কারো থিম ছেলেবেলার হারিয়ে যাওয়া নানান খেলনা। ঘুড়ি লাটাই, লাট্টু, লেপ্তি, ঘূর্ণি, চাকি বেলুন, মাটীর পুতুল, লুডো, ক্যারম, ব্যাগাটেলি...ছেলেপুলেরা জানুক তাদের বাপ-ঠাকুর্দারা কি নিয়ে কৈশোর কাটিয়েছেন। এরাঁও অকালপক্ক টিনেজারদের জন্য ভাবনাচিন্তা করেছেন বলে প্রাইজটা পেলেও পেতে পারেন।   
কেউ বলছে সবচেয়ে বড়! কেউ বলছে এবার আসছে সু-বাঁশ । বাঁশের থিম হবে বুঝি। বাঁশ না দিলেই হল। কারোর থিম অমুক পার্ক এ এবার জগাখিচুড়ি। সেটাই চমক। পাবলিক বুঝবে না ঠকবে সেটা পরের ব্যাপার। 

সোনায় মোড়া সপরিবারে মহার্ঘ মা দুগগা হয়েছিল গেলবার। এবার নাকি হীরেয় মোড়া অতি মহার্ঘ সাজে অবতীর্ণ হবেন এ ধরাধামে।
কোথাও বা ই-ওয়েষ্ট দিয়ে গোটা একটা প্যান্ডেল। ক্যাসেট থেকে ফ্লপিডিস্ক, হার্ডডিস্ক থেকে সিডিরম, এডাপটর থেকে চার্জার, পেনড্রাইভ থেকে মাউস, মাদার বোর্ড থেকে মনিটর সব সাঁটানো আছে এক আকাশের নীচে। "দূষণ রোখো, পুজো দেখো" থিম তাদের। 
কেউ এবার পুজো প্যান্ডেলটাকে মহাশ্মশান বানিয়েই ছেড়েছেন। শ্লোগান দিচ্ছেন "শ্মশানে জাগিছে ঊমা'  অসুরনিধন যজ্ঞে সামিল হয়েছেন তাঁদের ঊমা। তা ভাল। শত্রুর নিধন কে না চায়? তাদের প্যান্ডেলে আকাশতলে, অনিলে জলে ঝুলবে  মোষের মাথার খুলি। মোষের খুর, মোষের লেজ, মোষের শিং । আর যা দিয়ে মোষ মারা হয়েছে সেই হাঁসুয়া, দা, কুড়ুল, কাঠারিতে ছয়লাপ হবে প্যান্ডেল।  যেদিকে তাকাও সেদিকেই সুরবর্জিত থিম মানে আসুরিক বাতাবরণ। সমাজ মহিষমুক্ত হবার আশায়। মহিষ ভাগাও তবেই মহিষাসুর হটবে। মেরে ঠান্ডা করো।

অলিগলিতে ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা সমাজ সচেতন এনজিও । তারা যে  ঠিক কি উপকারে লাগে কেউ জানেনা। তারা নাকি সমাজ সেবা করেন। এবার শুনছি তাদের থিম নারীমুক্তি। এই পুজোয় বৃদ্ধাবাস থেকে মেয়ে পাচার, অ্যাসিড অ্যাটাক থেকে কন্যা ভ্রূণ হত্যা, ধর্ষণ থেকে পণপ্রথা, নাবালিকার বিয়ে সব রুখে দেবেন বলে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সমাজের কাছে, মেয়েদের কাছে। দেখাই যাক। এনজিওটির মালিক  অবিশ্যি নিজের মা কে বৃদ্ধশ্রমেই গচ্ছিত রেখেছেন। নিজের মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন আঠারোর নীচেই। পণ‌ও দিয়েছেন । তো? তিনি ভাগবতের আপ্তবাক্য পাঠস্থানেই ফেলে রেখে আসেন । নিজের সংসারে তাকে মান্যতা দিতে হবে এমন কথা কি কোথাও লেখা আছে?

অবশেষে এগিয়ে আসে বহু প্রতীক্ষিত মাহেন্দ্রক্ষণ। পাড়ায় পাড়ায় প্রতিযোগিতার লড়াইয়ে কে কাকে টেক্কা দেয় সেটাই দেখার। মহাভারতের যুদ্ধ থিম এ পাড়ায়। সেই দেখে পাশের পাড়ার থিম যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই। তাই মাদার টেরিজা তাদের থিম। তা দেখে পরের পাড়া থিম করেছে ফাদার। ফাদার মানে? গান্ধী?  না, না মোটেও নয়। গান্ধীগিরি অবসোলিট। বাবা মানে ভেষজ থিম। হার্বাল মূর্তি। সবুজ রং, গাছের গন্ধ, ইকো ঢং। হার্বাল গডেস? হার্বাল প্যান্ডেল? মানে ইকোফ্রেন্ডলি থিম? গাছের গন্ধ, দূষণ মুক্ত, প্লাস্টিক শূন্য পরিবেশ বান্ধব? তা দেখে আরেক দল বানালো আর্ট অফ গিভিং থিম। তাদের বাবাশ্রী হলেন আইকন এবং সর্বোপরি স্পনসর। আকাশে বাতাসে মেডিটেশনের সুর। মন শান্ত করার উপায়। হালকা সুর ভাসে।  সেখানে সকলে সংঘবদ্ধ হয়ে লাইন করে সুসংহত হয়ে প্যান্ডেল হপিং করে। এই হল বাবাশ্রীর মহিমা। তাদের সর্বজনীন গুরুদেব কৃপা বৃষ্টি করেন। ডোনেশান বাক্স হাতে উদয় হয় কারোর।  শিউলি বৃষ্টি হয় দাতার মাথায়। সুবাসিত জল ঝর্ণার মত ঝরে পড়ে মাথায়। ঘাসের আগায় শিশির, ডাঙ্গায় ঝরা শিউলি আর জলে ফোটা পদ্ম সবে মিলে প্যান্ডেলে শিল্পের ছোঁয়া। শান্ত মনন আর ধৈর্য্যের বাঁধন...এর নাম্‌ই আর্ট অফ গিভিং কিনা! দান কর এবং প্রাণায়ামে বস প্যান্ডেলে ঢুকে। দানের সঙ্গে হাল্কা মিউজিকে প্রাণায়াম পরিষেবা পাওয়া যাবে। মন্ত্রের সাধন কিম্বা শরীর পাতন। শাস্ত্রে এইমত  কয়।



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours