নাজমীন মর্তুজা, লেখক ও গবেষক, অ্যাডিলেড, অস্ট্রেলিয়া:

আরে মিয়া রাখেন তো আপনার নীতিকথা, 
নীতিকথার ভাত আছে নাকি? 

আমরা কমবেশী সকলেই জানি, এই নীতিকথার কোন খাওয়া নাই আমাদের মত গরীব দেশের। 
আসলে এই “নীতিকথা “ এ গুলো কি ? আমরা অনেকেই জানি আবার অনেকেই জানি না। 

নীতিকতা : নীতি কথা বা ফেবল / প্যারাবল , লোক সাহিত্যের অন্তগর্ত হলেও এর উৎপত্তি তুলনায় অনেক উন্নত সমাজে। আমরা জানি যে প্রাচীন সমাজেও কতকগুলো সুনির্দিষ্ট নীতিবোধ থাকে , যা লঙ্ঘন করা অমার্জনীয় অপরাধ বলে পরিগণ্য ।  তবে আজকাল উন্নততর সমাজে অনেক কিছুই সামাজিক বিধানের জটিলতাকে আশ্রয় করে , নীতি বোধের অনুশাসনকে এড়িয়ে যাওয়া যায় । আমরা চলতে ফিরতে কত কিছুই লক্ষ্য করি বাসে উঠলে নীতি কথা লিখে রেখেছে , বাসের গায়ে , যেমন নবীজির শিক্ষা করো না ভিক্ষা , চিডিয়াখানায় গেলে লেখা দেখি , জীবে দয়া করে যেজন সেজন সেবিছে ঈশ্বর । এক অর্থে দেখতে গেলে পশুপাখি সম্পর্কীয় কথা , রূপকথা , ব্রতকথা , সবকিছুর মধ্যেই  প্রবহমান থাকে একটা করে প্রচ্ছন্ন নীতি উপদেশ।

আর এই নীতিকথা গুলো সরাসরি  কোন পর্দার আড়াল নেই । সোজাসুজি নীতি উপদেশটি উপস্থিত করা হয় । নীতিকথার মধ্যে খুব বিখ্যাত হচ্ছে - ঈশপের ফেবলস , হিতোপদেশ , পণ্চতন্ত্র, জাতক এবং বাইবেল, বাইবেলের কিছু কিছু গল্প( প্যারাবল )।

ফেবল্ হচ্ছে সেগুলো যে গুলো পশুপাখির রুপকে মানুষের করণীয় উচিত- অনুচিত গুলো বর্ণিত হয় । আর প্যারাবল গুলো সচরাচর পশুপাখির সম্পর্কবিহীন  এবং এগুলোর মর্ধ্যে সূক্ষ্ম একটু ধর্মসুলভতার স্পর্শ থাকে । জাতক শ্রেনীর গল্পগুলো সে অর্থে অনেকাংশে প্যারাবল এর সমধর্মী।

আমার তো মনে হয় প্রাচীন গ্রীসের ঈশপের নাম শোনেনি এমন লোক সংখ্যা খুব কম , তাঁর নীতি কথা পড়ুক আর না পড়ুক নাম শুনে থাকবেন । তার নীতিকথা গুলো প্রচলিত হয়েছিল আঠাশ শতাব্দী আগে । আমার জানা মতে লোককথার তাত্ত্বিকগণ থিয়োডোর বেনফে কাস্ক্যাঁ প্রমাণ করেছেন যে পঞ্চতন্ত্রের কাহিনীগুলো ঈশপের ফেবলসের চেয়ে বেশী প্রাচীন । যদিও অনেক ইতিহাস পড়ে জেনেছি পঞ্চতন্ত্রের করটক দমনকের গল্প  আরব বণিকদের মাধ্যমে নাকি পশ্চিম দিকে যাত্রা করে । খৃষ্টপূর্ব  আমলেই পহ্লবী ভাষায় কলিলা- ওয়া- দিমনা নামে ঐ গল্পের রুপান্তরিত পাঠ দেখতে পাওয়া গিয়েছিল । এভাবেই শুনেছি ধীরে ধীরে গ্রীস দেশে আমাদের ভারতীয় পঞ্চতন্ত্রের কাহিনী পরিভ্রমণ করতে গিয়ে স্থিত হয় ঈশপের নামে । আজ আমার ছোট মেয়ের স্কুলে গিয়ে এক অভিভাবকের হাতে দেখলাম ঈশপের ফেবলস বই .. একটু আগ্রহ হলো কথা বলার , জিজ্ঞেস করলাম  পড়া শেষ , সে খুব সহাস্যে উত্তর করলো হুম সেই কবেই পড়া শেষ তবুও বার বার পড়ি , এখন পড়ছি ছেলের জন্য , ওকে পড়ে শোনাই , আমি খুব মুগ্ধতা প্রকাশ করলাম , দূর থেকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম ও তোমার ছেলে , সে বললো জ্বি । ছেলেটার দিকে তাকিয়ে ভাবলাম কেবল স্কুলে পা দিয়েছে ,সেন্ডেল ঠিক করে পড়তে শিখেনি , এই বয়সে নীতিকথার বীজমন্ত্র তার মাথায় পোতা হচ্ছে , সে আদর্শবান নীতিবোধে পুষ্ট হবে না তো কে হবে ? তাকে আমার পরিচয় দিয়ে বল্লাম আমি একজন লোক গবেষক , সে অবাক হয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো ... বললাম তুমি কি জাতক পঞ্চতন্ত্রের নাম শুনেছো ? সে তাকিয়েই থাকলো আমার দিকে -নীতিকথার মধ্যে সবচাইতে সম্বৃদ্ধ জাতক , তারকারণ হলো জাতকের গল্পগুলোর মধ্যে “কথাবত্থু” এবং সমাধান দুই ভাগে বিভক্ত। কথাকত্থুর মধ্যে রুপকথা আকারে থাকে , আর সমাধানে রূপক বিমুক্ত । তাই সহজে মৌলিক সত্যটি মানুষের অন্তরে প্রবেশ করে । 
আর “পঞ্চতন্ত্র “ যার মূল উদ্দেশ্যই ছিল লোকশিক্ষা । তাই এর ব্যপ্তির গন্ডিটা ছিল অনেক বড় । পৃথিবীর লোক কথার সর্বশ্রেষ্ঠ সংকলন হলো পঞ্চতন্ত্র । ২০০ খৃষ্টাব্দ পূর্ব থেকে এই পঞ্চতন্ত্র গুলো সংগৃহীত হয়েছিল । 
এ গুলো পাঁচটি তন্ত্রে বিভক্ত । ৫০ টি ভাষায় অনুদৃত হয়েছে জানা মতে । একসময় বলা হতো পণ্চতন্ত্র হলো বিশ্বের  নীতিকথার অন্যতম উৎস।

আমরা এখন নীতি কথা পড়িও না নীতি কথার ধার ধারি না ... এফ বি তে একদিন আঙুল উচিয়ে একটা নীতি কথা পড়তে গেলাম - সেখানে লেখা “ ভাই কিছু মানুষের জন্য যদি কলিজা কাইটা পিরিচে আইনা দেন তবুও বলবে , কম হইছে “ অনেক ক্ষণ হাসলাম এমন নীতি কথার চিরকুট দেখে । নীতিকথার ভাত নাই এই কথা সত্য নয় কিন্তু , কথিত আছে কৃতদাস ঈশপ সম্ভ্রান্ত পুরমহিলাদের গল্প শুনিয়ে জীবিকার্জন করতেন , তারমানে নীতিকথার মূল লক্ষ হিসেবে জনশিক্ষাকেই দেখি ।  আমাদের রাজবাড়ির গৃহশিক্ষক বিষ্ণুশর্মার গল্প( পিলপের নীতিকথা) সম্বন্ধে একই কথা বলা যায়। বাইবেল , সামারিটানের, বীজবাপক, নীতিকথার বই এদেশের বাচ্চাদের জন্য স্কুল লাইব্রেরীগুলোতে সংগ্রহ করে রেখেছেন । আমি ভেবে পাই না এমন উন্নত দেশে কি দরকার এসব পশুচারণজীবি , কৃষিজীবী মধ্যবর্তী স্তরের মানুষের কাহিনী পড়ার ।  কিন্তু এটা সত্যি  যে প্যারাবল গুলি আদিতে  ধর্মানুষঙ্গবিহীন থাকলেও ঘটনার অনিবার্য পরিণতিতে তারা ধর্মাশ্রয়ী হয়ে উঠেছে।

আমাদের দেশে এই সব নীতিকথার রূপক গল্প গুলির নাম হয়ত ভুলতেই বসেছি নিজেরা, পরবর্তী প্রজন্মকে কি গল্প শোনাবো .. মটুপাতলু, ডোরেমন, নীতিকথার গল্পবলা মানে ক্ষেত হয়ে যাবে । কিন্তু একসময় আমরা জানি যে নীতি কথাগুলোর প্রচার  করার দরকার হয়ে পড়েছিল সমাজবিধান গড়ে ওঠার সময় থেকেই সামাজিক নীতিগুলোর প্রচার করা দরকার হয়েছিল। তাই তো ফেবলস, প্যারাবল, কথাবত্থু, সমাধান , হিতোপোদেশ, যে ভাবেই কথাগুলো আসুক না কেন সকল কিছুর আদি উৎস প্রাথমিক  সমাজ বিধানের , সংহতি বিধানের মধ্যে অবলীন । মানুষ যত আদিম ছিল , ততই তার মধ্যে সামাজিক নীতিবোধগুলি দৃঢ়তর সংস্কাররূপে শিকড় গেড়ে রাখতো। তাই উন্নত সমাজে নীতি কথা জাতীয় কাহিনীর প্রয়োজন খুব কম , কেন না সেখানে সামাজিক নীতিবোধজাত অনুশাসনগুলো মানুষের মনে সহজাত সংস্কাররূপেই আজন্মকাল সুপ্রতিষ্ঠিত থাকে । নীতিবোধ যেখানে প্রায় সহজাত বলেই নীতিকথার মাধ্যমে সেগুলো আবার শেখানোর প্রয়োজন ঘটেনি। নীতিকথা লোককথার অন্তর্গত হয়েও সামাজিক ভাবে অনেক বেশী পরিমার্জিত।

আমি আমার ব্যক্তিগত উপলদ্ধি থেকে বলতে পারি  বাংলার রূপকথা পড়ে শিখেছি - বিধিনিষেধ ভঙ্গ করা মানে শাস্তি পাওয়া , সেটা আইনত হোক বা প্রকৃতির কাছেই হোক । বিপর্যয় বিপদ আপদকে ধৈর্যের সাথে মানিয়ে নিলে সুখশান্তি লাভ হয়।
তবে এটাও চরম সত্যি যে বলয় ভেদে নীতিকথার মানদণ্ড বদলে যায় কখনো কখনো।



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours