নাজমীন মর্তুজা, লেখক ও গবেষক, অ্যাডিলেড, অস্ট্রেলিয়া:

দিনের আলো ফিকে হয়ে এলে , আমাদের বাড়ির আবহটাই বদলে যায় আজকাল, গল্পের দুনিয়াই চলে যাই ....
আমার কন্যারা ( রায়া -রুহা ) দুজনের ভীষণ রকমের একটা জড়ালো অভ্যাস আছে , যেটা না করলে হবে না , তা হলো বেড টাইম স্টোরি শোনার । আমার ঝুলিতে যত গল্প ছিল প্রায় ভাণ্ডার খালি করে ফেলছি ।  অনেক গল্প যা আমার জানার মধ্যে আছে , সে গুলোর আসলে কিসসা থেকে পড়া , অনেক শব্দের অর্থ ওরা বোঝে না , বোঝাতে গেলে থামতে হয় , এতে করে গল্পের মজাটা ধরে রাখা মুশকিল হয়ে পড়ে। আর ওরা এতই প্রশ্ন করে যে আমার মাঝে মাঝে গল্প বলার মুডই উবে যায় । পান্তা বুড়ি , বেতাল , রাক্ষস -খোক্কস .. ডাইনি বুড়ি , এক বিঘত মানুষ , এই সব গল্পের বেশীর ভাগ তারা হজম করে ফেলছে । আর হঠাৎ করে যদি এক গল্প রিপিট হয় , তবেই হলো - দুজনে একসাথে চিৎকার দিয়ে উঠবে , নতুন বলো এটা শুনছি । আমার দশা আরব্য রজনীর রাণীদের মতো , গল্প বলে রাজাকে জাগিয়ে রাখলে যেমন জান রক্ষা , তেমনি এদের গল্প বলে ঘুম পাড়ানো , নতুবা জেগে থাকবে , আর আমার ঘুমের বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে । রোজ আমার ভাবনা থাকে আজ কোন গল্প শোনাবো , ওদেরকে , এমনি ভাবনাতেও এক ধরণের মানসিক চাপ থাকে ।  আমি আলাওলের পদ্মাবতী পড়ছিলাম কি যেন কাজে তখন হঠাৎ মনে হলো এখান থেকেই তো ওদেরকে গল্প শোনানো যায়  বা অন্য পালা গুলো থেকে , তারপর থেকে শুরু হলো .. লাইলী মজনু ,  থেকে শুরু করে , ময়মনসিংহ গীতিকার  কাহিনী গুলো , গতকাল থেকে আমি পুঁথি এবং পালা , এবং ময়মনসিংহ গীতিকা গুলো শোনাচ্ছি , এতে করে দেখলাম ওরা অনেক কিছু শিখছে , বিশেষ করে আমাদের আতিথেয়তা , খাবার , বিয়ে উৎসব, পূজা পার্বণ , রিচুয়াল , বাংলা শব্দ ,শিখতে সুবিধা হচ্ছে , আমারও আর গল্প বানিয়ে বলতে হচ্ছে না , আমি যখন দোভাষী পুঁথি গুলো  সুর করে পড়ি ওরা খুব মজা পায় , কিছু দিন আগে আমার রচিত একটা বইয়ে , হেলিম বয়াতির - বিষাদজারি ‘ ওদের কে লাইন লাইন করে গেয়ে গেয়ে শুনিয়েছিলাম , ওরা বেশ মজা নিয়ে শোনে! কষ্ট হয় আমার ,কিন্তু যখন দেখি ওরা চরিত্রগুলোর নাম বলে অন্য সময়ে আমার সামনে কোথাও তুলনা করে , উল্লেখ করে আমি খুব মুগ্ধ হই । কবে যেন একটা মুভি দেখছিল দু বোন মিলে , একটা ভিলেনের অমানবিক আচরণে দু বোন বলে উঠলো ... ওহ , একদম সিমার ! আমি তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবলাম , তবে তো ভালই হয় , এই মিথের গল্প দিয়েই ওদের কে শেখানো যাবে অনেক কিছু । আমার ছোট মেয়ে রুহা খুব ছেলে বাবু পছন্দ করে , ছোট একটা বাবু কে রাস্তায় দেখে বলে , মা লুক একদম আলী আজগরের মতো দেখতে ! পুরো গল্পের প্লট ওদের মনে মস্তিষ্কে বহন করে চলে ওরা । 
এখন শুনছে ‘ মলুয়া’  বেশ মজা নিয়েই শুনছিল .. কবে বিয়ে হবে বিনোদের, বিয়ের পর কি হবে .. তার পর কি, এই নিয়ে কত চিন্তা ।  একপর্যায়ে আসলো রান্না এবং খাবারের বর্ণনা । এবার তাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো সেসব খাবারের সাথে , কিছু ইউ টিউবে আর কিছু নিজে বানিয়ে , আর কিছু মুখে বর্ণনা করে ।  কিছু কিছু রান্না করে , যদিও খেতে পারে না , কিন্তু বই তে আছে আগ্রহের শেষ নাই । মুসকিল হলো প্রশ্ন আর প্রশ্ন বাপরে বাপ , আমার প্রায় মগজ ভেজে  পারে তো খায় ! । তবে পালা গুলো ছন্দে থাকাতে সুর করে পড়তে গেলে একটা সুন্দর আবহ তৈরী হয় । আর যখন পুঁথি পাঠের আদলে পড়ি সত্যি আমি নিজেও স্মৃতি কাতর হয়ে পড়ি । ছোটবেলায়  বৈঠকঘরের বারান্দায় কুপি বাতির আলোতে , সোনাভান, গাজীকালু চম্পাবতী, মহুয়া, মলুয়া,  লোর চন্দ্রানী, রূপবানের পুঁথি পাঠ আসরের কথা মনে পড়ে যায় , এই সব পালা, কিসসা, পুঁথি গুলোতে বাংলার আদিরূপ  - যেমন খাবার দাবার , রাজা- প্রজার জীবন ,  মানসিকতা , বীরত্ব ,সতীত্ব , পশুপ্রেম, ন্যায়- অন্যায় , অপরাধ, আইন , বিশ্বাসঘাতকা।  প্রেমভাব এসব সুন্দর ভাবে বিশ্লেষন করে দেয়াতে  শিশুর কোমল মনে এক ধরনের সুখঅনুভূতির সাথে , তাদের মানবিক দিকটাও উন্নত হয় । সেই সাথে বিশেষ করে আমার বাচ্চাদের ব্যপারে বলতে পারি , বাংলার ঐতিহ্য  এবং সামাজিক রূপরেখার  একটা ছবি তাদের মানসপটে সহজেই ফ্রেমে আটকে যায় ।  রায়া রুহা এখন মলুয়া পালা শুনছে ..  ভীষণ উৎসাহ নিয়ে ... মা এর পর কি হবে এর পর কি হবে কত চিন্তা ! আজ ছিল  সেই  ময়মনসিংহ গীতিকায়। অতিথি আপ্যায়নের একটা চিত্র কল্পনা । সাথে ছিল রান্নার প্রস্তুতি ও খাবারের বর্ণনা , অসাধারণ সব খাবারের পদ , মিষ্টান্ন , অতিথি আপ্যায়ন , আন্তরিকতা , আমার বিশ্বাস যাদের এই পালা পড়া নেই তারা পড়লেও মজা পাবেন । কত নিখুঁত ভাবে  গৃহস্থ্য বাড়ির রান্না ঘর থেকে খাবারের বর্ণনা, অতিথি সেবার চিত্র এতো নিখুঁত করে তুলে এনেছেন । সত্যি পড়লে পুলকিত হতে হয় ময়মনসিংহ গীতিকা গুলো , নিচে কিছু লাইন শেয়ার করছি। 

অতিথি অভ্যর্থনা 

সন্ধ্যাকালে অতিথি আইল ভিন দেশে ঘর ।
পাঁচ পুত্রে ডাক্যা কয় সাধু হীরাধর ।।
লোটা ভইরা শীতল জল দিল খরম পানি।
পাঁচ ভাইয়ের বউয়ে রান্ধে পরম রান্ধুনি।।
মানকচু ভাজা আর অম্বল চালিতার।
মাছের সরুয়া রান্ধে জিরার সম্বার।।
কাইটা লইছে কই মাছ চরচরি খারা।
ভালা কইরে রান্ধে বেনুন দিয়া কালাজিরা।।
একে একে রান্ধে সব বেনুন ছত্রিশ জাতি।
শুকনা মাছ পুইড়া রান্ধে আগল বেসাতি।।
পাঁচ ভাইয়ের সঙ্গে বিনোদ পিড়িত বস্যা খায় ।
এমন ভোজন বিনোদ জন্মে নাই সে খায় ।।
শুকত খাইল বেনুন খাইল আর ভাজা বরা।
পুলি পিঠা , বরা পিঠা , চিত , চন্দ্রপুলি।।
পোয়া চই খাইল কত রসে  ঢলঢলি ।
আচাইয়া চান্দ বিনোদ উঠিল তখন ।।
বার - দুয়ারিয়া ঘরে গিয়া করিল শয়ন।
বাটাভরা সাচি পান লং এলাচ দিয়া ।।
পাঁচ ভাইয়ের বউ দিছে পান সাজাইয়া।
শুহতে দিছে শীতল পাটি উত্তম বিছান।।
বাতাস করতে দিছে আবের পাঙ্খাখান।
এই মতে শুইয়া বিনোদ সুখে নিদ্রা যায় ।।
পরভাতে উঠ্য়া বিনোদ বিদায় যে চায় ।
অসাধারণ বর্ণনা । শুনতে শুনতে রায়া - রুহা ঘুম দ্যাশে না যায় ....
আজকের মতো কিসসা বলাতে নাজ রেহাই পায়।
আবার আসছে দিনের জন্য মা নাজ ভাবতে থাক , কি গল্প শোনাবো কাল , সারাদিন কাজের ফাঁকে গল্প নিয়ে ভাবে শুধু । এই করেই রাজকুমারীদের নিয়ে নাজের জীবন বৈদেশে বড়ই আনন্দে কেটে যায়।

(তথ্যসুত্র  ....লোকসাহিত্যের বই থেকে)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours