Varoter orthoniti
চন্দন বন্দ্যোপাধ্যায়, ফ্রীল্যান্স রিপোর্টার, কলকাতা: 

কানাঘুষা চলছিল অনেক আগে থেকেই। আর সেটাই  সত্যি হতে চলেছে। উৎসবের মরশুমেই ভারতীয় রেলকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে নরেন্দ্র মোদি সরকার। প্রাথমিকভাবে ১৫০টি যাত্রিবাহী ট্রেন এবং ৫০টি রেল স্টেশনের দায়িত্বভার বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেল মন্ত্রক। গোটা প্রক্রিয়া সম্পন্ন  করতে রেল বোর্ডের তরফে ৫ সদস্যের একটি  সচিব পর্যায়ের  কমিটি গঠন করা হয়েছে। লখনউ-দিল্লি সেমি-হাই স্পিড ট্রেন তেজস এক্সপ্রেসের হাত ধরে ইতিমধ্যে ভারতীয় রেলে বেসরকারিকরণের দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে। সেই পথ ধরেই এবার ১৫০টি যাত্রিবাহী ট্রেনকে বেসরকারি হাতে তুলে দিতে চায় মোদি সরকার। বেসরকারিকরণের মাধ্যমে চলতি আর্থিক বছরে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে সরকার। শুধুমাত্র সরকারি সংস্থার শেয়ার বিক্রি করে এই বছর ১,০০০,০০০,০০০,০০০ টাকা (১ ট্রিলিয়ন) ঘরে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই লক্ষ্যে এয়ার ইন্ডিয়া ছাড়াও ভারত পেট্রোলিয়াম-সহ চার রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নিকরণের তোড়জোড় শুরু হয়েছে।

ভারত পেট্রোলিয়ামে কেন্দ্রের অংশীদারি আছে ৫৩.৩ শতাংশ। তা পুরোই বিক্রি করে দেওয়া হবে। শিপিং কর্পোরেশন, তেহরি হাইড্রো পাওয়ার, নর্থ ইস্টার্ন ইলেকট্রিক পাওয়ার কর্পোরেশনের পুরো সরকারি শেয়ারই বিক্রি করে দেওয়া হবে। কন্টেনার কর্পোরেশনের ৩০ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করা হবে। এই তালিকায় যুক্ত হতে চলেছে আরও অনেক বড় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা।

বিশেষজ্ঞদের মত, বিপিসিএল বিক্রি হলে ভারতে জ্বালানি বাণিজ্যের কাঠামোই বদলে যাবে। উদারনীতি চালুর সময় থেকেই বিলগ্নিকরণ ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারিকরণের রাস্তা খোলা রাখা  হয়েছে।  একবিংশ শতকের শুরুতে অটল বিহারী বাজপেয়ি জমানা থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারিকরণের পথ প্রশস্ত হয়। বিলগ্নির জন্য সেই সময় পৃথক দপ্তরও খোলা হয়েছিল। আর নরেন্দ্র মোদির আমলে চার রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নিকরণের এই প্রস্তাব ভারত সরকার গ্রহণ করলে দেশের ইতিহাসে এটি সবথেকে বড় বেসরকারিকরণের ঘটনা ঘটতে চলেছে।

কিন্তু প্রশ্ন,  এতে কি সমস্যা মিটবে? কীভাবে? এর  কোনও উত্তর কারো কাছে  নেই। কে না জানে, বেসরকারিকরণ মানেই কাজ হারানোর ভয়। চলতি বছরে বাজেট ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা জিডিপির ৩.৩ শতাংশের মধ্যে বেঁধে ফেলার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে সরকার। কিন্তু মন্দার কারণে রাজস্ব আদায় কম হওয়ায় সরকার সেই লক্ষ্য  পূরণে কতটা সফল হবে, তা নিয়ে জোর সংশয় আছে। যার জেরে পরিকাঠামো ও উন্নয়নমূলক প্রকল্পে খরচের ক্ষমতা কমছে সরকারের।

সরকারি তথ্য পরিসংখ্যান থেকে একদিকে যেমন আসছে হতাশার পূর্বাভাস, অন্যদিকে শিল্প-বাণিজ্য মহল মন্দার হাত থেকে নিস্তার পেতে সরকারের কাছে ধরনা দিচ্ছে ত্রাণ সাহায্যের জন্য।


আর্থিক সঙ্কটের মেঘ কতটা ঘনিয়েছে  পরিসংখ্যান দেখলেই তা স্পষ্ট হয়ে যাবে । পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছর আগস্টে শিল্পোৎপাদন গত বছর আগস্টের তুলনায় ১.১ শতাংশ কম হয়েছে। যা সাত বছরে সবচেয়ে খারাপ। অন্যদিকে, গাড়ি শিল্পের সংগঠন সিয়ামের হিসেব, গত বছর সেপ্টেম্বরের তুলনায় এই সেপ্টেম্বরে ফের কমেছে যাত্রিবাহী গাড়ির বিক্রি। এই নিয়ে টানা ১১ মাস। বাণিজ্যিক গাড়ি বিক্রি কমেছে এক দশকে সর্বাধিক, ৩৯.০৬ শতাংশ। দু’চাকায় ধাক্কা দু’দশকে সর্বোচ্চ, ২৩.২৯ শতাংশ। উদ্বেগ বাড়িয়েছে গত পাঁচ বছরের বিচারে কল-কারখানায় উৎপাদন (ম্যানুফ্যাকচারিং) মুখ থুবড়ে পড়া। লগ্নির ভাটা প্রকট করে সঙ্কোচনের পরিমাণ ১.২ শতাংশ। অথচ কর্মসংস্থান বাড়াতে এই ক্ষেত্রের বৃদ্ধিকেই জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞেরা। আবার চাহিদার খরা আরও স্পষ্ট করে ৯.১ শতাংশ কমেছে দীর্ঘমেয়াদি ভোগ্যপণ্যের উৎপাদনও। সরাসরি কমেছে বিদ্যুৎ, পরিকাঠামো ও নির্মাণ পণ্যের উৎপাদন। বিভিন্ন ক্ষেত্রকে চাঙ্গা করতে সরকার একের পর এক প্রকল্প ঘোষণার পরেও সেই ঝিমিয়ে বৃদ্ধির হার। অথচ  চাহিদা বাড়ন্ত।  রাজকোষের ঘাটতি লক্ষ্যমাত্রায় বেঁধে রেখে সরকারি ব্যয় বিপুল বাড়ানোর রসদও ক্রমে কমে আসছে কেন্দ্রের ভাঁড়ারে। এই পরিস্থিতিতে অর্থনীতিতে প্রাণ ফেরাতে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সুদের হার আরও কমাবে, এমন একটি আশা নিয়েই বসে কেন্দ্র ও শিল্পমহল। কিন্তু এবার মূল্যবৃদ্ধি মাথা চাড়া দিতে শুরু করায়, সেই সুযোগও আর কত দিন মিলবে, উঠছে সেই প্রশ্ন।  সঞ্চয়ী আমানত এবং স্থায়ী আমানতে লাগাতার সুদের হার কমায় মধ্যবিত্তের উপর চাপ বেড়েই চলেছে। গত সেপ্টেম্বরে এদেশের  গ্রাহকদের আত্মবিশ্বাস ৬ বছরের মধ্যে তলানিতে এসে ঠেকেছে বলে জানিয়েছে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংক। কর্মসংস্থান, আয় এবং অনত্যাবশ্যক খরচে মন্দার ধাক্কা গ্রাহকদের আত্মবিশ্বাসে প্রভাব ফেলেছে বলে আরবিআইয়ের সাম্প্রতিকতম প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

গত এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকে আর্থিক বৃদ্ধির হার কমে দাঁড়িয়েছে ৫ শতাংশ। গত ৬ বছরের মধ্যে এই বৃদ্ধির হার সর্বনিম্ন। উৎসবের এই মরশুমেও প্রায় সমস্ত পণ্যেরই চাহিদা তলানিতে। নতুন কাজের সুযোগ তৈরি তো দূর অস্ত্‌, বরং চাহিদায় ভাটার কারণে কারখানা বন্ধ থাকায় কাজ হারাচ্ছেন অনেকে। ‘তীব্র মন্দার মধ্যে দিয়ে চলছে ভারতীয় অর্থনীতি। বিবর্ণ অর্থনীতি, বিপন্ন ভারত’, বলছেন খোদ আইএমএফ-এর কর্ণধার ক্রিস্টালিনা জর্জিভা-ও।
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours