জীবন রায়, প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ, রাজ্যসভা:
ভারতীয় শ্রমিকদের সংগঠিত অংশ এবং এই সুত্রে মানুষের সাথে কিঞ্চিত বুঝাবুঝি গড়ে ওঠার সুবাদে এবং সেই শিক্ষাগুরুর অপরিসীম কৃপায় বিদায় বেলায় এই দাবীটা রেখে যেতে পারি।
লেনিনবাদী শ্রমিক আন্দোলনের প্রধান অভিমুখ হিসেবে যা বলা হয়েছে, একজন গনএকতার কর্মীকে যে কোন বিষয়ে তাৎক্ষনিক প্রতিকৃয়া দেওয়ার যোগ্যতা থাকতেই হবে ----
------- পড়াশুনার জ্ঞানধর্মীতা যৎকিঞ্চিত হলেও, যে কোন বিষয়ে প্রতিকৃয়ায় অন্ততঃ পাঁচ মিনিট বলে দেওয়ার মতো যোগ্যতা মানুষের কাছ থেকে পেয়ে গিয়েছিলাম। সে সব বিষয় বিজ্ঞানের যে কোন শাখা, কিংবা সমাজ বিজ্ঞান অথবা সাহিত্য হোক খুজে পেয়েছিলাম। সে কালে সমাজটাই যেন ইতিহাস, সাহিত্য কলা ইত্যাদির সব বিষয়ে একটা জাগরনমুখীন ছিলো। সভবতঃ দলের গনভিত্তির উপরে দাড়িয়ে নয়, বরং ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন থেকে দলের গনভিত্তি নির্মানকে সামনে রেখেই জীবনটা কাটিয়ে দেওয়ার সুযোগ পেয়ে গেলাম।এমন সুখ থেকে বড় সুখ হতে পারে বলে কখনো ভাবার সুযোগই হয় নাই।
----- দুর্গাপুরের সে কালের যারা এখনো বেঁচে আছেন কিন্তু কখনো তেমন নেতা হওয়ার কথা ভাবেন নাই, যাতে শ্রমিক গ্রহনযোগ্যতা থেকেও উপরের নেতাদের গ্রহনযোগ্যতা প্রধান বিবেচনা করেছেন - তারা মানবেন --- দুর্গাপুর দেখিয়ে গিয়েছে, কি করে একটা ট্রেড ইউনিয়ন সাম্যবাদী দলের গন- ভিত্তি নির্মান করে দিতে পারেন। সে কালের নেতাদের নেতৃত্বে ইস্পাত ইউনিয়ন নিজেও এটা দেখিয়ে গেছেন ।
----- এই সাম্যবাদী ভিত্তি গঠনের যোগ্যতাটা যে আসে, মুলতঃ সাম্যের সাধারন নিয়মগুলিকে, দলের বাইরে মানুষের ভালোবাসার সামগ্রী করে নিয়ে, লেনিনবাদকেই সাধারন গ্রহযোগ্যতার মধ্যে নিয়ে আসা। এই সুত্রেই
----- বিদ্যামান জ্ঞান-সংস্কৃতি এবং সামাজিক রাজনীতির অভিমুখগুলিকে নিরন্তর নাড়াচাড়া করার সুত্রে, গনশিক্ষার বিস্তার ইত্যাদিতে,
------ মানুষের মধ্যে মার্ক্সবাদকে মানুষের জীবনবোধকে অংগিভুত করে নেওয়ার মধ্য দিয়েই।
তাই ১৯৬৬ এর আন্দোলন সহ বড় বড় আন্দোলনগুলি পরিচালনা কতে গিয়ে, কখনো কোনদিন প্রস্ন করতে শুনি নাই, কোন দল এই আন্দোলননটা চলাচ্ছেন। ১৯৭০ এর আগষ্টে দিলীপ মজুমদার সহ কয়েকজনের মুক্তির দাবীতে এতো বড় কারখানায়, কার্ফিউ ভেদ কর এ ১০ দিনের ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়া, বৈপ্লবিক রুপান্তরকাল ছাড়া ভাবা যেতো না। মানুষের সাত হে একাত্মতাই মুলমন্ত্র যদি না থাকতো, কিছুতেই ৭০ এ যখন আমরা অনেকে বিনাবিচারে আটক হয়ে গেলাম, কিছুতেই ১৯৭৭ এর আগে ছাড়াই পেতাম না।
অনেক পরে বুঝেছি, সত্তোরের প্রথম দিক থেকে, যদি কারখানা গেট কিংবা নগরীতে যখন শ্রমিকদের কিংবা পরিবারের সভাগুলিতে যখনই ভাষন দিতে গেছি, সে সব ভাষন গুলি যে গল্প বা কথা বলা হয়ে যেতো, তার কারন ইতিমধ্যে আমরা আন্তর্জাতীক হচ্ছিলাম।
----- এর অর্থটাও ক্রমে বুঝলাম, নিজ কিংবা নিজকারখানা গেটের স্বার্থ চিন্তার বাইরে গিয়ে, যেমনভাবে আন্দোলন সার্বজনীনতার একটি আধার খুজে পেয়েছে, তেমনভাবেই, শ্রমিক আন্দোলনের সাথে সাথে বক্তা এবং শ্রোতার একাত্মতাতা বেড়েছে। , শ্রোতা নিজের সমস্যাকে সমষ্ঠির মধ্যে যেমন খুজেছে, তেমনভাবেই সে, নিজেও আন্তর্জাতীক হয়েছে।
আশির দশক থেকেই, নেতৃপদের জন্য শ্রমিকদের অধিকার যেমনভাবে সংকুচিত হয়েছে, তেমনভাবেই, স্বাভাবিক কারনেই, সংগঠিত শিল্পে শ্রমিক আন্দোলনে যেমনভাবে সৃজনমুখীনতা সংকুচিত হয়েছে তেমনভাবেই
----- শ্রমিক আন্দোলন থেকে উল্লেখিত জ্ঞান এবং সাংস্কৃতিক ছন্দগুলি কেটে যেতে বাধ্য ছিলো একটা কারনেই। শ্রমিক আন্দোলনকে যখন ক্ষুদা-মুক্তি থেকে ভাবমুক্তিতে উত্তোরন ঘটাতে হয়, সেটা কখনো উপর থেকে 'ইস্কুলে পড়ানোর' মতো যে ঘটে না সেটা ভুক্তিভোগী মাত্রই জানেন।
যেদিন থেকে উপর থেকে নেতা বসানোর 'নিয়ম' চালু হোল সেদিন থেকেই যেন একপ্রান্তে নেতা এবং কর্মী, অন্যপ্রান্তে কর্মী ও সাধারন শ্রমিক কিংবা মানুষের সম্পর্কের মধ্যেই একটা যান্ত্রিকতা, আসতে শুরু করলো।
----- পূর্বে আমরা শ্রমিক থেকে উঠা নেতাদের, শ্রমিকরা বা সাধারন মানুষ প্রথমেই নামে সম্বোধন করতেন, ট্রেড ইউনিয়নের নামে এবং সব শেষে সি পি আই এম। জনসভাগুলিতেও বার বার উল্লেখ করেছি
---- আমার কর্মীরা তার নেতাদের সম্মান জানানোটা, অনেকটা তার সাংগঠনিক আনুগত্যের বাধ্যবাধকতা, সেই বাধ্যবাধকতার মানদন্ডে কোন নেতার মূল্যায়ন চলে না। তার মূল্যায়ন হবে, অন্য ইউনিয়ন কিংবা অন্য দল - বিশেষ করে শত্রু দলের কর্মী সমর্থকরা সম্মান কতটুকু করছেন।
------ ভাবতে একটা গর্ববোধ হয়, যে দলের কর্মীরা যতটুকু ভালোবাসে তার থেকেও, সাধারন মানুশ কিংবা অন্য দলের সমর্থকরা যখন শ্রদ্ধা করে। তখনই মনে হয় এই শ্রদ্ধাটা, কোন ব্যক্তির প্রতি তো নয়, মার্ক্সবাদকে লেনিনবাদি পদ্ধতিকে প্রয়োগের সাফল্যের প্রতি সম্মান।
----- যখন শিশু আকাদমি থেকে নির্ঝর বিদ্যালয়ের প্রধানের দায়ীত্ব নিলাম সঠিকভাবেই দলের নেতা কর্মীরা বল্লেন, ডাক সাইটে ট্রেড ইউনিয়ন-গিরি ব্যতিরেখে যার অন্য গুন নেই, তিনি কী করে ভাবতে পারেন যে তিনি একটা বিদ্যালয় চালিয়ে দেবেন? উচ্চ শিক্ষিত শিক্ষকরাও যে মনে মনে হাসতেন সে ধারনা আমার ছিলো। নিজেদের মধ্যে আলোচনাও হয়তো করতেন, সে ধারনা আমার ছিলো। কিন্তু
------- ইতিমধ্যে, সংস্কৃতি আর ট্রেড ইউনিয়নের সেতুবন্ধন অতিক্রম করে, সারাদেশ পাড়ি দিয়ে, সংসদ হয়ে বাড়ী ফিরে এসেছি, অন্য অনেক পরিহাসের কারনে। আলাদা করে মার্ক্সবাদ কিংবা লেনিনবাদের কোনটারই সবটা জানি না। কিন্তু
----- এই দুই -এর সেতুবন্ধনে, জ্ঞানের অখন্ড রুপটা পাওয়ার কথা সেটা পেয়েছে, তার সাথে মানুষের সেতুবন্ধন করতে যে সাংগঠনিক দায়দায়ীত্বটি পালন করতে হোত, তার সাংগঠনিক রীতিটি জেনেছি। ক্রমে বুঝেছিলাম, এই দুটি জিনিষ যার হাতে থাকে, তার হাতে ধীরে ধীরে বিশ্ব চলে আসে। এখানে এই অখন্ড সত্বা সংক্রান্ত ধারনা, সংগঠন, সাম্যবাদী নৈ্তিকতা এবং সরলতা এই কয়েকটি গুনের সমাবেশ যেখানে ঘটে
------- মার্ক্সবাদ লেলিনবাদ, শ্রমিক-মানুষের ভালোবাসার দৌলতে যেকোন কঠিন কাজে প্রয়োজনীয় সাহচার্য্যটি চলে আসবেই।
প্রাথমিক ভাষনগুলিতে, অনেক সময় নিজের গ্রহন যোগ্যতা বাড়ানোর জন্য মার্ক্স বা লেনিনের নাম নিতে হোত ঠিক। ধীরে ধীরে যেমনভাবে, মানুষ নেতাকে মেনেছেন, তেমনভাবে আবেগের উপর যুক্তির আধিপত্য বিস্তার ঘটেছে।
----- এইভাবে কারখানা গেটের ভাষন, বাক্যালাপে বদল হয়েছে। এই সব কথাবার্তায় কখনো মনে হয় নাই, যেন মানুষ বা শ্রমিকরা যা চায়, তাতে নিজেকে নামিয়ে এনে ভাষনটির অভিমুখকে ঠিক করে নিতে হবে। বরং উলটো পথেই শ্রোতাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার সংগ্রাম করতে হয়েছে। প্রথম প্রথম শ্রোতা সব সময় তার নিজের পাওণাটা শোনার জন্য অপেক্ষা করতেন। নিচের আসু দাবীদাওয়াকে অস্বিকার করে কোন শ্রমিক অনুষ্ঠান চলতো না। আমরাও সব সময় চেষ্টা করতাম, সেগুলিকে বৃহত্তর দীর্ঘকালীন দাবীর সাথে যুক্ত করেই ভাষনটি রাখতে। সেটা বলতাম, 'নিচুটাকে' মধ্যমণি করে নয়, ধীর্বে ধীরে ভাষনের উপর দিকের ঢেউটার সাথে নিচের ঢেউ এর মিশ্রনের চাতুরিতা এবং সৃজনের মিশ্রন ঘটিয়ে।
---- ক্রমে ১৯৬৪ সালে দলের কর্মসূচী চলে আসার পর, শ্রমিকদের সাথে কথা বলার ভাবাদর্শ পরিমন্ডলটা বাড়তে শুরু করলো। সেটা প্রয়োজন হোল, অন্য অনেক ভাবের প্রত্যাঘাতের কারনে। সুবিধাবাদের দুটি প্রধান লাইন ছিলো, একটাকে বলা যাবে কংগ্রেস দল (যাকে এখন বলা যাবে ডুবতে থাকা বিশ্ব উদারবাদ) অন্যটা ছিলো বামের নামে দক্ষিন দিকের উদারবাদ এবং ' ভাংগো' 'জ্বালাও শ্লোগান নিয়ে অতি বামের নৈরাজ্যবাদ।
------ দুর্গাপুরকে বাধ্যতা মুলকভাবে কারখানার অস্ত্বিত্ব এবং শ্রমিক অস্তিত্বকে এক করে লড়তে হোতোই। সে সময়ে, দুর্গাপুর এবং এ্যালয়ের সম্প্রসারনের লড়াইকেই অনেকদিন ঢাল করে লড়তে হোল, ব্যক্তিহত্যাকে আটকাতে । মনে আছে, কোলকাতা কোন কোন বড় নেতার মধ্যেও বুঝি এতো 'জ্বলন্ত' বিপ্লবী আগুন ছিলো যে , কেউ কেউ এই রননীতি মানতেই পারেন নাই। সাধারনতঃ সমুদ্রে যখন বড়বড় ঢেউ দেখাযায়, তখন অনেক সময়েই তলদেশের খবর উপরে থাকে না --- যে ভাটার টান আসলো বলে!
-------- কাজেই যারা মাটিতে কাজ করেন এবং সামাজিক রুপান্তরের বিষয়গুলিকে, শ্লোগানের বাইরে, রক্ত-মাংশের চেহারা দিতে চেয়েছেন, তাদেরকে, সব রকম জঞ্জাল অতিক্রমনকেই নয়, সামাজিকভাবে একেবারে পশ্চাতপদ অংশের কথা থেকে তাদের মনের কথাটা বুঝে নিতে হয়েছে, এক অখন্ড নিরন্তরতায়। এরা সাধারনভাবে যেটা চায়, অনেক সময় ঘাবরে গিয়ে উল্টোটা বলতো। পরে বুদ্ধি খোলার পর পরিস্থিতিতের বদল হলেও, অনেক সময় সত্য এবং চাতুরালির মধ্যে সম্পর্কগুলিকে আলাদা আলাদা করে খুজে নিতে হয়।
কাজেই সংগঠিত শিল্পে, ভাবাদর্শগত অবস্থানটিকে , ঠিক করে নেওয়াটা খুব সোজা কাজ ছিলো না। কারখানাগত সন্তুলনগুলি ঠিক করে নেওয়া গেলেও, সেগুলিকে সামাজিক এবং আঞ্চলিক রাজনীতির সাথে সন্তুলিত রাখা খুব সম্ভব ছিলো না।
যদি খুটিয়ে দেখা যায়, আশির উত্তরকালের নেতাদের যারা, নিচূনির্ভরতা থেকে উচুর দিকে তাকিয়ে নেতা হওয়ার প্রবনতায় বেড়ে উঠেছেন, তাদের অক্ষমতাই ক্রমে, একটা নতুন তত্বের জন্ম দেয়। সেখান থেকেই সেই তত্বকে ঠেলা হয়েছে, যেনঃ 'সংগঠিত শ্রমিকদের স্বার্থপরতার' কারনেই নাকি সমাজের বৈপ্লবিক নেতৃত্ব 'অসংগঠিত'দের হাতে চলে গিয়েছে।
----- অথচ, যারা সত্তোরের দশকের, চরম অশান্তির কালে দুর্গাপুরে যে কিভাবে কারখানার আধুনিকরনের সংগ্রামটিকে, সাধারন গনতন্ত্রের আন্দোলনে বদলে দেওয়া হয়েছিলো, তার চালচিত্রটির সাথে বর্তমান কালে, এ্যালয় বিরাষ্ট্রীয়করন বিরোধী আন্দোলনের চালচিত্রকে মিলিয়ে দেখা যায়, তবেই বোঝা যাবে, নেতাদের শ্রেনীগত অবস্থান এবং আন্তর্জাতীকতার পচন কিভাবে, একটা গনতান্ত্রিক আন্দোনকে এক অতি সংকীর্ন গন্ডীতে বেধেছে। শিল্পাঞ্চলে নব জাগরনের একটা সম্ভাবনাকে ডুবিয়ে ছাড়া হয়েছে।
শেষ কথাটা বুঝতে হলে,আসল কথাটা তো বুঝতেই হোত। এটা তো স্বাভাবিক, উৎপাদন ব্যবস্থা যেভাবে, অদক্ষ থেকে প্রযুক্তির স্তরে উঠতে থাকবে, সেখানে উল্লেখিত সম্পর্কের জটিলতা গুলি বৃদ্ধি পাবেই। একে প্রতিবিপ্লবের হাতে সপে না দিয়ে,
--------- বিপ্লবী রুপান্তরের পথে লক্ষভেদ করাটাই যখন রুপান্তরের নীতি এবং তাকে জড়িয়ে ধরে, নতুন সম্পর্কগুলি নির্মান করবে,---- সে সব কথা বোঝার কথা যাদের ভাবার কাঠামোগত পরিস্থিতি নেই, তারা নিশ্চিতভাবে রুপান্তরকামীতাকে উলটো পথে চালনা করবেন নিশ্চিত। দুর্গাপুর ডুবতে বসেছে এই পথেই। যারা চালাচ্ছেন, তারা বুঝতেই চান না, জনপদ হিসেবে যদি শহরের আত্মমর্য্যাদাকে ক্রমাগত নিম্নমানে নামতে থাকে, তখন শ্রমিক আত্মমর্যাদাবোধের পাতাল যাত্রার সাথে সাথে, শ্রমীকরা, শ্রমিক বিরোধী, স্বাধীনতা বিরোধী মঞ্চে আশ্রয় খুজতে থাকবেন নিশ্চিত। (ক্রমশ)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours