কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

ধম্মের কল বাতাসে নড়ে।
আর কল নড়ার লক্ষণ চোখে পড়লে, আগেই গা-ঢাকা দেন পি চিদম্বরম, রাজীব কুমারের মতো 'হাই প্রোফাইল'রা। য পলায়তি স জীবতী!
শুক্রবার ধর্মের কল বাতাসে নড়েনি। নড়িয়ে ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের ধর্মাবতার মধুমতী মিত্র। রাজীব কুমারের গ্রেপ্তারের রক্ষাকবচ তুলে নেওয়ার রায় দিলেন তিনি।

ব্যাস, তার পরমুহূর্ত থেকেই শুরু হয়ে গেল টানটান উত্তেজনার চোরপুলিশ খেলা।
কল নড়ার আগে ছিলেন রয়্যাল বেঙ্গল। কল নড়তেই হয়ে গেলেন কেঁচো। কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার। বর্তমানের এডিজি সিআইডি রাজীব কুমার। আইপিএস। তার ওপর মুখ্যমন্ত্রীর স্নেহধন্য।

যাঁর ভয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড হয়ে যেত রাজ্যের হার্ডকোর ক্রিমিনালরা। এখন সেই রাজ্য গোয়েন্দাকর্তা নিজেই ফেরার সিবিআই জুজুর ভয়ে। মোবাইল সুইচড অফ। এমনকি সূত্রের খবরে বলা হচ্ছে, তাঁর দেহরক্ষীও মোবাইল বন্ধ করে রেখেছেন।

শুক্রবার বিকেলেই নোটিশ জারি করে সিবিআই। জেরার জন্য রাজীব কুমারকে সকাল দশটার মধ্যে সিজিও কমপ্লেক্সে সংস্থার দপ্তরে হাজির হতে বলা হয়। ওদিকে জেরার জন্য দিল্লি থেকে উড়ে আসেন সিবিআইয়ের জয়েন্ট ডিরেক্টর সাই মনোহর। কিন্তু গ্রেপ্তার হওয়ার ভয়ে ফের আরও একবার সিবিআইয়ের নোটিশ এড়িয়ে গেলেন প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার। এমনকি কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার সঙ্গে কোনরকম যোগাযোগ করার রাস্তাতেও পা বাড়াননি রাজীব কুমার। তবে সূত্রের খবর, রাজীব কুমার এক মাসের সময় চেয়ে সিবিআইয়ের কাছে মেল পাঠিয়েছেন। কিন্তু সিবিআই এই খবর নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।

এ যেন সাম্প্রতিক ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি।
ঠিক একইরকমভাবে সাতাশ ঘণ্টা লুকিয়ে বেড়িয়েছিলেন কেন্দ্রের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম। উদ্দেশ্য সেই একই। সিবিআইয়ের নোটিশ এড়ানোর কৌশল। শেষ পর্যন্ত পাক্কা ফিল্মি কায়দায় মন্ত্রীর বাংলোর দেওয়াল টপকে চিদাম্বরমকে গ্রেপ্তার করে সিবিআই।

কোথায় আত্মগোপন করে আছেন রাজীব কুমার? এমুহূর্তের লাখ টাকার প্রশ্ন। চৌত্রিশ পার্ক স্ট্রিটে আইপিএস কোয়ার্টারে তিনি নেই। নেই দপ্তরেও। হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন সিবিআই কর্তারা। তবে সূত্রের খবর বলছে, রাজীব কুমার পার্ক স্ট্রিটে তাঁর কোয়ার্টারে না থাকলেও, আশপাশেই কোথাও ঘাপটি মেরে আছেন। ফের আরেকবার জমে উঠেছে সিবিআই- হাই প্রোফাইলের চোরপুলিশ খেলা।

শুক্রবার দিনটা অশুভ হয়ে দেখা দিয়েছিলো রাজীব কুমারের কাছে। ওই দিনই গ্রেপ্তারের হাত থেকে বাঁচতে, তাঁর রক্ষাকবচ তুলে নেয় কলকাতা হাইকোর্ট। বিচারপতি মধুমতী মৈত্র তাঁর রায়ে স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন, তদন্তের প্রয়োজনে রাজীব কুমারকে নিজের হেফাজতে চাইতেই পারে সিবিআই। একটুও দেরি না করে ময়দানে নেমে পড়েছিলো কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দল। ছুটেছিলেন রাজীব কুমারের পার্ক স্ট্রিটের ঠিকানায়।
সাদা পুলিশে গিজগিজ।
কেন? এঁরা রাজীব কুমারের রক্ষাকর্তা। কিন্তু এবার তাঁদের কর্তাকে রক্ষা করবেন কোন ভেলকিবাজিতে? আগেরবার তো না হয় এই পুলিশরাই বীরবিক্রমে সিবিআই অফিসারদের ঘাড় ধরে থানায় নিয়ে গেছিলেন। সেবারও রাজীব কুমারের খোঁজ করতে গিয়ে, রাজ্য পুলিশের প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়েছিলেন সিবিআই অফিসাররা। এমনকি রাজীবরক্ষায় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছিলেন রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান। খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা চট্টোপাধ্যায়।

এবার কি ছবিটা পাল্টেছে? এখনও কিন্তু রাজ্য গোয়েন্দার এডিজি'কে রক্ষা করতে কেউ রাস্তায় নামেনি। তবে পুলিশে ছয়লাপ রাজীব কুমারের বাসভবন ঘিরে। পার্ক স্ট্রিট ছাড়াও সিবিআই পৌঁছে যায় ভবানী ভবনে। কোত্থাও নেই রাজীব কুমার। কপুরের মতো যেন উবে গেলেন। এদিকে সূত্রের খবর জানাচ্ছে, রাজীব কুমার কলকাতাতেই দিব্য বহাল তবিয়তে আছেন। আর সেই সঙ্গে সমানে পরামর্শ করে চলেছেন আইনজীবীদের সঙ্গে।

তবে রাজীব কুমার যেন কোনমতেই চোখে ধুলো দিয়ে কলকাতা থেকে বেরিয়ে যেতে না পারেন, তারজন্য নজরদারি চলছে বিমানবন্দরে। সতর্ক করা হয়েছে অভিবাসন দপ্তরকেও।
ওদিকে বেলা তিনটে বাজতেই বোঝা যায়, রাজীব কুমার সিজিও কমপ্লেক্সে আর আসছেন না। ফের নড়েচড়ে বসেন সিবিআই কর্তারা। পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করতে লাগাতার বৈঠকে বসেন তাঁরা। তবে এবার তাঁরা রাজীব কুমারের জন্য কোন ফাঁদ পাততে চলেছেন, তা আপাতত অজানাই থাকলো।

যেন চিদম্বরমের দেখানো পথেই পা বাড়িয়েছেন রাজীব কুমার। তবে তার পরিণামের কথা প্রাক্তন পুলিশ কমিশনারকে মনে করিয়ে দিয়েছেন বিজেপি'র রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। তিনি বলেন, "একজন আইপিএস অফিসার হিসেবে রাজীব কুমারের উচিত ছিলো সিবিআই তদন্তে সহযোগিতা করা।" রাজীব কুমারকে গ্রেপ্তার করে জেরা করা দরকার বলে দাবি জানিয়েছেন কংগ্রেস সাংসদ অধীর চৌধুরী। তাহলেই সারদা মামলার টাকা আত্মসাত করার নেপথ্যে কোন রাঘব বোয়ালরা ছিলো তা জানা যাবে। 
ওদিকে সিবিআইয়ের দাবি, সারদা কেলেঙ্কারির ফোন কলের লিস্টে বিকৃতি ঘটিয়েছিলেন রাজীব কুমার। চেপে গেছিলেন বহু তথ্য। টাকা লেনদেনের জরুরি নথিপত্র সরানোর অভিযোগও করা হয়েছে। ওই সমস্ত রহস্য উদ্ধার করতেই রাজীব কুমারকে জেরা করার ওপরে জোর দিয়েছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। যে করেই হোক এখন তাঁরা জেরার টেবিলে বসাতে চাইছেন রাজীব কুমারকে। আর একটা দিনও সময় নষ্ট করতে রাজি না সিবিআই।

ওদিকে গ্রেপ্তারের আশঙ্কায় কাঁপছেন রাজীব কুমার। আইন সম্পর্কে অভিজ্ঞদের মত, শনিবার রবিবার এই দু'দিন সিবিআইয়ের নজর এড়িয়ে থাকাটাই আপাতত চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার। সোমবার দিন তাঁর আইনজীবী দ্বারস্থ হতে পারেন শীর্ষ আদালতের। আর্জি জানানো হবে আগাম জামিনের।

ওদিকে সিবিআইকর্তারাও শনিবার দফায় দফায় বৈঠক করেন। নেন আইনি পরামর্শও। একেবারে আটঘাট বেঁধেই রাজীব কুমারের দিকে হাত বাড়ানোর 'অল আউট' প্রস্তুতিতে ফিনিশিং টাচ দিতে ব্যস্ত সিবিআই।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours