মৌসুমী মন্ডল, ফিচার রাইটার, কলকাতা:

“পাক রেখে কড়া কড়া
ভাজিতেছে ছানাবড়া
পড়ে রস, টপ টপ,
মুখের বচন”। 

সূর্যরশ্মি হীন পৃথিবী আর মিষ্টি ব্যাতীত বাঙালী ভাবা বোধহয় এক। বাঙালীর উৎসব, পার্বণ, আবেগ-অনুভূতি, আভিজাত্যে ও ঐতিহ্যের সাথে জড়িয়ে এই মিষ্টি। তবে শোনা যায় নানা কুসংস্কারের কারণে প্রথমের দিকে ছানার তৈরী কোনো খাবার কেউ খেত না। পরবর্তীকালে পর্তুগিজদের আসার ফলে ছানা দিয়ে কীভাবে এত সুন্দর ও সুস্বাদু মিষ্টি করা যায় তা শিখল বাঙালী। এখানেই শেষ নাকি? না। সবে তো শুরু। বাঙালী সবে তো ছানাতে হানা দিয়েছে। সালটা ১৮২৬ হবে। হুগলি জেলার মনোহরা থেকে প্রাণচন্দ্র নাগ নামে এক ব্যাক্তি কোলকাতার বৌবাজারের বুকে খুলে বসেছিলেন একটা ছোট্ট মিষ্টির দোকান। বাঙালীর মিষ্টির অভিধানে ‘কড়াপাক’ নামক শব্দটির সংযোজনই হত না, যদি না এই প্রাণচন্দ্র নাগ-এর সুপুত্র ভীমচন্দ্র নাগ মিষ্টির জগতে পা রাখতেন। কোলকাতা তথা বাঙালী জাতির রসনা বঞ্চিত থাকত অনেক স্বাদের কাহিনী থেকে। বৌবাজারের এই ছোট্ট দোকানে ভীম নাগ সাজিয়ে বসতেন হরেক রকমের মিষ্টি। থাকত মনোহরাও। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে যাওয়ার সময় হোক বা নববর্ষের দিন হোক জানবাজার স্ট্রিট থেকে স্বয়ং রাণি রাসমণি মিষ্টি নিয়ে যেতেন সেখান থেকে। তখন বাঙালীকে সবে ভীম নাগ ‘মন্ডা’ উপহার দিয়েছেন। কোলকাতার মুখ তখনও এত মিষ্টির সাথে পরিচিত হয়ে ওঠেনি। ছানা, চিনির রস, ক্ষীর আর পেস্তা দিয়ে তৈরী হত এই মন্ডা। ছানাকে বাটতে হবে অত্যন্ত মিহি করে, বাটা ছানাকে চিনির রসে ফেলে নাড়তে হবে। রস মরে ঘন হয়ে এলে তাকে কাঠের বারকোশে রেখে পেস্তার কুচি মিশিয়ে আবার বেটে মিশ্রণটাকে মিহি করে নিতে হবে। তবে হবে মন্ডা। যা ছিল অভিজাত শ্রেণীর খাদ্য। ভীম নাগের মিষ্টির অনেক ভক্তের মধ্যে অন্যতম এক ছিলেন ‘বাঙলার বাঘ’। অর্থাৎ কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়।
শোনা যায় লোকমুখে যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়ি ফেরার পথে তিনি দুই সের মন্ডা কিনতেন। এক কেজি নিজেই খেতেন গাড়িতে বাড়ি ফেরার পথে। আর বাকিটুকু পরিবারের মানুষদের জন্য নিয়ে যেতেন। তবে ভীমচন্দ্র নাগ মিষ্টির জগতে শ্রেষ্ট হয়ে ওঠেন লেডিকেনি বানানোর মধ্যে দিয়ে। ১৮৫৬ থেকে ১৮৬২ সালের কথা। ইংরেজ শাসন থেকে মুক্তির জন্য ভারতবর্ষে যখন মহাবিদ্রোহের দামামা বাজছে, যখন গোটা দেশে আগুন জ্বলছে তখন সেই আগুনে ভীম নাগ ঢাললেন মিষ্টির রস। এই সময়ের মধ্যে চার্লস ক্যানিং-এর স্ত্রী লেডি ক্যানিং আসেন ভারত সফরে। তাঁর জন্মদিন উপলক্ষ্যে ভীম নাগ তৈরী করেন এক বিশেষ ভাজা ও রসময় মিষ্টি। যা খেয়ে সাহেব গিন্নির মন ভরে যায়। তাঁর প্রিয় মিষ্টি হয়ে যায় এই মিষ্টি। তাই এই মিষ্টির নাম ভীম নাগ রাখেন ‘লেডি ক্যানিং’। যা লোকমুখে এসে দাঁড়ায় লেডিকেনি হিসেবে। তারপর থেকে অভিজাত শ্রেণীর অনুষ্ঠানে এই লেডিকেনি-কে ছাড়া ভাবা যেত না। জানা যায় এই মিষ্টির জন্য ভীম নাগ অনেক নাম, অর্থ, প্রাচুর্য্য অর্জন করেছিলেন। এভাবেই মিষ্টির অভিধানে ‘ভীম নাগ’ নামটি স্বর্ণাক্ষরে লেখা রইল। ভীম নাগ এভাবেই বেঁচে থাকুক বাঙালীর উৎসবের প্রথম রাতে ও শেষ পাতে।
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours