নাজমীন মর্তুজা, লেখক ও গবেষক, অ্যাডিলেড, অস্ট্রেলিয়া:

দূর দেশে মনের অনুভূতি গুলো যখন উস্কে দেয় লেখার জন্য , তখন কি করে কলম চিবই বলুন...
বসে যাই সব কাজ ফেলে লিখতে। 
অনুভূতির বিষকাটা ।
বাংলাদেশের যে অঞ্চলটাতে, ধানপেষাই কল বসানো সবচেয়ে বেশী, সেখানেই আমার নাড়ী পোতা ! কি করে ধান পিষে চাল তৈরি হয় , কি করে স্থুল চালের শরীরে খাঁচ কেটে ,বাজারে তার আসল পরিচয় লুকিয়ে রাখে মোম পোলিশ  , তারপর চালে  কৃতিম গন্ধ ঢেলে দিয়ে , খদ্দের কে কাছে টানার  জন্য বস্তার উপরে পিরামিড  বানিয়ে রাখা পযর্ন্তই শেষ নয় এই চাল কাহিনী । মানুষের পেটের  ভাত , অসহায় ফকিরের ব্যাগ  ভরা সত্তুর বাড়ির পায়ের ধুলোর সাথে মিশেলকরা ভাদই , সাপাহার , ইরি , কাটারীর  ঘ্রাণ যখন ঝুলে থাকে তার ক্ষুধার্ত  হাতে , তাকে দেখে মনে হয় যেন অনন্তকাল সে ভাত খেয়ে থাকবে , কখনো সে আর মাটির খাদ্য হবে না !  
তার লোভী চোখ বঁড়শির মত বিঁধে থাকে চালে!
  
কিন্তু আমি শুনি ধানের আতর্নাদ ,  অটোমিলের লোহায় পিষ্ট হয়ে কাঁদছে অকাতরে চিনি কাটারী , সোনামুখি কালোজিরা, সেই সাথে দেখেছি  - পেটমোটা সুদ ব্যপারীদের  রসিয়ে রসিয়ে পান চিবোনো আর সীমার বক্ষ। 
এমন শিকারীর ফাঁদে একবার পা পরলে রক্ষা নাই 
, খুব ছোট তখন দেখেছি , এদের পা ধরে পরে আছে ভূমি তলে কত অভাবী মেহনতি হাত বুবুক্ষ চোখ , বেপারীদের নর্দমা ভাব ক্রমেই বেড়ে যায় , চরা সুদের টোপ ফেলে দেয় , আহা রে ক্ষুধার্ত মাছ লুকানো বঁড়শি না দেখেই গপ ! বিঁধে যায় সুদ কাঁটা ঘুরতে থাকে সময়ের আবর্তে । 
শিক্ষা নিয়েছিলাম ,
লোভী হলেও মরণ !
অনাহারী হলেও মরণ! 
কিন্তু  চিন্তা এখনো থেমে আছে  ধান ও ধান পেষাই কলের মাঝখানে ! আমার চোখ জোড়া কেবলি দেখাদেখিতে থেমে আছে , ওরা চাষা ছিল এখন পাক্কা বেপারী, সব কিছু পণ্য বানায় , পণ্য হয়ে ঘুরাচ্ছে বেশ , দোকানির লোভী করতলে , কিন্তু বোকা বেপারী বোঝে না বেচা কেনার জন্য হৃদপিণ্ড ওঠে না দোকানে ! 

মনে পরে একদিন খরচা করেছিলাম প্রেমের সম্বল , খরচা করে কিনেছিলাম দুটি বুকের যাদুধন ! 

রেবেকা বলেছিল  সেদিন , যেদিন দেশের মায়া ছেড়ে বিদেশে আসি , বেশী কাঁদিসনে চোখের জলের মূল্য জানিস ? আঁচলের খুঁটে বেঁধে রাখিস , নাক ফুল ছুঁয়ে স্মৃতি চেপে রাখিস প্রাণে ! একদিন সকাল হবে ঝাঁকে ঝাঁকে ফুল ঝুকে থাকবে তোর অভিবাদনে !
কিন্তু দেশ কে ভুলিস না । 

আসলে কি জানেন তো স্মৃতি বড় বেইমান । যে কোন স্মৃতিই হোক , শৈশব হোক আর প্রেমের ... ছেড়ে গেলেও ভার ছেড়ে যায় না , সারাজীবনের জন্য কাঁধে বসে থাকে , সেই বাংলাদেশ ছেড়ে মহাদেশে চলে এসেছি , তবুও আমাকে ছাড়ে না স্মৃতিরা  , মালা গাঁথি তাই রোজ .. আজকের বর্তমান দিয়ে আমি অতীতের মিশ্রনে দেই ঘুটা । 
এখানে আসার পর কি ভীষণ উৎসুক ছিলাম সবেতেই যেন একটা বিস্ময় । ছোট্ট একটা দেশে বড় হওয়া মানুষ .. ছোট ছোট কালো  -ফর্সা পেট মোটা নাক বোচা , মোটা পাতলা , ময়লা কাপড় পড়া .. দোক্তা বিড়ি ফুঁকা মানুষ , কথায় কথার শা...  লা ..বলে গালি দেয়া মানুষ গুলো , কোন নিয়ম নাই , যে যার মতো বিন্দাস , কি রাস্তায় কি দোকানে কি হোটেলে , কি হাটে ... সব্বার একই রকম আচরণ । 
ধন্যবাদ , বলা মিষ্টি হাসা , এই ব্যপারগুলো আসলে দেখা যায় কম । বিশেষ একটা মহলের চাতাল তক না যাওয়া অবধি । 
কিন্তু এখানে দেখলাম এটিক্যাট ম্যানার জানা ভদ্দর লোক সব , স্যুট -টাই ,স্কাট -শর্ট , পাউরুটি স্যান্ডউইচ ও পারে তো  কাটাচামচে বিঁধিয়ে খায় । অকারণে হাসে । বাসে ট্রামে উঠলে ড্রাইভার হাই বাই বলে , সবাই কেমন বেশী ভালো বেশী বিনয়ী । এসব দেখে তো আমি পুলকিত না হয়ে পারিনি প্রথম প্রথম ।
প্রথম প্রথম যখন কেউ জিজ্ঞেস করতে  আমি কোন দেশে থেকে এসেছি ... বলতাম বাংলাদেশ ... চেনে না , হতাস হয়ে চেনাতে চেষ্টা করতাম , ইন্ডিয়ার পাশেই টাইনি একটা দেশ .. ঐটাই আমার দেশ । হাজার বছরের ঐতিহ্য আছে আমাদের , খাবার , সাহিত্য , পোষাক , আরো কত কি , বিশেষ করে বাংলা ভাষা ... তারপর অনেকেই ভ্রু উপরে তুলে , বলতো বাহ বেশ । তারপরে আরো বলতাম .. ঐ যে ক্রিকেট , আমাদের দেশের ছেলেরা খেলছে , অনেকে যখন চিনতো , মাশরাফি , সাকিবের নাম বলতো , মনে হতো এই তো , আমার ভাইদের চিনেছে । কি যে আনন্দ হতো ওদের চিনতে পারা দেখে ।

আমার জীবনেব উপর দিয়ে কতশত ঘটনা গিয়েছে, অবস্থার কত পরিবর্তন হয়েছে, কত লোকের সঙ্গে আলাপ পরিচয় বন্ধুতা হয়েছে যাদের নাম স্মৃতি মাত্রই রয়ে গিয়েছে। বিদেশে এসে কত যে জীবনমুখী সমস্যার সামনা করেছি , অসুস্থতার সাথে যুদ্ধ করেছি ।
 
মৃত্যু আসুক তাতে কোন ভয় নাই, কেবল ভয় এই যে, যে মহৎ কাৰ্য সমাধা করতে উৎসুক, পাছে মৃত্যুতে সে কাজের কোনও ব্যাঘাত হয়।
আমাদের মনের গহিনে আমাদের আরও একটা ভিন্ন সত্তা আছে, যার আধিপত্য আমাদের চেতনায় অত্যন্ত ভাস্বর এবং যথাসময়ে, স্থান-কাল-পাত্র ভেদে সেই সত্তাই আমাদের চিন্তা-চেতনায়, চলায়-বলায় আমাদের সম্বোহিত করে, উচ্চকিত হয় নীরব উচ্চারণে- নিঃস্তব্ধতার মাঝেও ইথার বিস্তারের মতো আমাদের মনে ভেসে বেড়ায় তার মৌন কম্পন।

জীবনে চলার পথে বাঁকে বাঁকে, ক্ষণে এমন কিছু উপলব্ধি, এমন কিছু অভিজ্ঞতা আমাদের চেতনায় গাঢ় ছাপ রেখে যায়, যা বিস্মৃত হতে চাইলেও হওয়া যায় না, বার বার ফিরে আসে সেই চেনা পথ ধরে- টেনে নিয়ে যায় পেছনে, দূর...। 

এখানে আসার পর অনেক অনেক মানুষের সাথে পরিচয় হচ্ছে পথে ঘাটে , ট্রামে বাসে , মানুষকে চিনছি জানছি , নতুন অভিজ্ঞতা , সব কিছু আলাদা , খাবার ভাষা কালচার। ... তারমধ্যে শুধু মাত্র যে অষ্ট্রেলিয়ান তা নয় , এখানে নানা দেশের মানুষ এসেছে নানান কালচার , তাই এরা বলে মাল্টিকালচার কান্ট্রি, ব্যপারটা উপভোগ করবার মতোই ।
 
আমি টার্গেট করলাম ইন্ডিয়া ,নেপাল ,শ্রীলঙ্কা ,ভূটান বাদে অন্য দেশের মানুষদের সাথে মিশতে ....কিছুদিনের মধ্যে আমার এক বন্ধু জুটে গেল .. ওর নাম জেসমিনা .. নামটা বাঙ্গালী হলেও আসলে সে অজি এখানেই জন্মেছে , ওর দাদা দাদী এ দেশে এসেছিল .. ও থার্ড জেনারেশন , ক্রোশিয়ান বংশের । সে ইউ নি এসে তে ক্যামিষ্ট্রির টিচার  । বেশ ভালো বন্ধুত্ব হলো , ওর সাথে টুকটাক আমি এদিক সেদিক বাসে ট্রামে যেতে শুরু করলাম , কোথায় চিপে জিনিস পত্র কিনতে পারবো , এমনকি বেবীদের জন্য কোথায় সস্তা জিনিস পাবো , সব  সে আমাকে হাতে ধরে শিখাচ্ছিলো । আমরা খুব ঘনিষ্ট হলাম , একে অপরের বাসায় আসা যাওয়া .. ডিনার লাঞ্চ করা শুরু হলো । সে সময়টা বেশ উপভোগ করছি ।
 
একদিন ওকে বললাম জ্যাস চলো পুরোনো বইয়ের দোকানে যাই , ও তক্ষনি বলল চলো যাই .... আমরা বইয়ের দোকানে ধুলো ঝেড়ে ঝেড়ে বই পড়ছি , সে আমাকে এখানকার লেখকদের বই এনে এনে দেখাচ্ছে .... আমরা দুজনে বিভোর হয়ে বই দেখছি । হঠাৎ পেছনে দাঁড়িয়ে একজন অদ্ভুত এক ভাষায় কথা বলে যাচ্ছে , কিছুটা রাগের সাথে হিস হিস টাইপ শব্দ , পেছন ফিরে তাকাতেই দেখি একজন অ্যাবরোজিনাল ( Aboriginal) নেটিভ অষ্ট্রেলিয়ান , তখনো মাননীয়দের সাথে আমার দেখা হয় নি ,আমি প্রথম দেখে , চিড়িয়াখানার জন্তুর মতো বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি , অদ্ভুত টাইপ দেখতে , যেখানে সাদা রূপ হেরিতে হেরিতে আমি মুগ্ধতায় কুটি কুটি , সেখানে এমন কিংভূতমার্কা লোক দেখে ভড়কে যাওয়াই স্বাভাবিক ।
ততক্ষণে জ্যাস এর হাত আমাকে ঠেসে ধরেছে , জাস্ট হুইসপার করে বলছে জাস্ট কোয়াইট .. । 

আমি বুঝে ওঠার আগেই লোকটা সামনের পাইল করা বই গুলো আমার উপরে ছুঁড়ে দিলো , বার বার বলছে ব্লাডি ইন্ডিয়ান !  এবার আর কই যাই , জ্যাস আমার হাত ধরে জাস্ট টানতে টানতে দোকানের বাইরে নিয়ে আসলো । 
আমি হতবিহবল ! কি হলো কেন হলো , কেন আমাকে ইন্ডিয়ান বলল , তখন নানা প্রশ্নের হাতুরি পেটাচ্ছে মস্তিস্কে । ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ । 
জ্যাস কে জিজ্ঞেস করলাম কেন এমন করলো , আমার কনুই দিয়ে রক্ত ঝরছে  , আমার বিকার নেই ,জ্যাস হাঁপাচ্ছে , বলছে রাগ ... আমাদের উপরে , ওদের ভূমি ওদের দেশ আমরা দখল করে নিয়েছি , ওদের কে অবহেলা করা হয় , কনভিক্ট যারা এসেছিল তারা ওদের উপরে অত্যাচার করেছে খুব , আমার ভয় কমতে থাকলো , আমার মায়া হতে শুরু করলো , আমি জ্যাস কে জিজ্ঞেস করলাম , ওরা লোকালয়ে থাকে না কেন , ও বলল আসলে বন্যেরা বনে সুন্দর ... ওরা জঙ্গলেই ভালো , এখানে টিকতে পারে না , দেখলে না কেমন দানব ,  আমরা হাঁটছি আর কথা বলছি । 

আমার মাথায় তখনো একটা চিন্তা ছিল আমাকে কেন এমন করলো , আমার গায়ের বর্ণ শ্যামলা ... সাদা তো মোটেও নয় , বলা যায় ওদের মতো কালো , কেন তাহলে এমন করলো , আমার মাথায় চিন্তার বীজটা বোনা হয়ে গেল । 

তারপর থেকে এদের যখন যেখানে দেখি আমি ভয়ে কাতর হয়ে যাই । 
গুটিশুটি হয়ে সরে যাই । 
একবছর পর হাসপাতালে একজন অ্যাবরজিনাল লোকের সাথে দেখা হলো , আমার ফিজিও থ্যারাপি রুমে, কি সুন্দর ব্যবহার , ইংরেজিও বলছে চমৎকার ,পরে পরিচয় পেলাম উনি ইউ নি এস এর একজন টিচার । 
আমার সাথে বেশ ভাব হলো ... বললাম আচ্ছা আমার সাথে এমন একটা ঘটনা ঘটেছিল , বলতে পারবে কেন ... ও চুপ থেকে বলেছিল ... তোমার গায়ের রঙ আমাদের মতো তবুও তুমি এখানে সম্মানে আছো অথচ এদেশের হয়েও আমরা সব সুবিধা পাই না আদায় করতে হয় , এমন ক্ষোভ থেকে হতে পারে এমন করেছে । 
ওর ব্যখ্যাটা আমার মনের মতো হলো না , বললাম হতে পারে ।
 
সেই টিচার আমার ফোক গবেষণার কাজে এগিয়ে আসবে বলে কথা দিয়েছে । 
নিজেদের দেশ কালচার সম্পদ ঐতিহ্য যখন এমনি করে বিলীন হয়ে যায় , হাতছাড়া হয়ে যায় , তখন মানুষ এমনি করেই হয়ত প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে ওঠে । 
নিমিষেই মনে পরে যায় আমার দেশ , আমাদের ভাষা , আমাদের অধিকার , ৭১ এর যুদ্ধ ... শত শত মানুষের মৃত্যু । আমরা কি করে জ্বলেছি সেই ঘেন্নার অর্নিবাণ শিখা আমাদের হৃদয়ে জ্বলছে অহনিশি , ঠিক এদেরও তেমন হয় তাই হয়ত এরাও এমনি করে খ্যাপাটে হয়ে যায় , ধাওয়া করে , ইচ্ছে মতো অনিয়ম করে , এটাই ওদের প্রতিবাদের ভাষা ।
আমি শ্রদ্ধা করি তাদের , এখন আর ভয় পাই না , কথা বলি, সামনে পেলেই ।
অত্যাচারী যত শিক্ষিত সভ্য এটিকেট ম্যানার জানা হোক না কেন যত লেহাজি হোক না কেন তারা অত্যাচারী , এটাই তাদের পরিচয়।

(ছবি: লেখকের বন্ধু জাসমিনার সঙ্গে ও অ্যাবরিজিনাল বন্ধুর নিদ্যাল এর পাশে)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours