দেবযানী ভৌমিক (চক্রবর্তী), সহকারি অধ্যাপক, কৃষ্ণনগর:

দেবীপক্ষের সূচনা ৷ উৎসবপ্রিয় জাতির সবচেয়ে   বড় উৎসব৷ কত উন্মাদনা, উৎসাহ, পারস্পরিক সৌহার্দ্য বিনিময়৷ মহালয়া যেন সেই   উৎসবেরই শুভ মহরত৷ মহালয়া থেকেই দিন গোণা শুরু৷ বছরের চারটি দিন ঘিরে  যে অনাবিল আনন্দে মুখরিত হয়ে ওঠেন সকলে, তাকে পুঁজি করেই তো বছরের বাকি দিনগুলি যাপন৷  শারদোৎসব কথাটি দুর্গাপুজোর থেকেও জ্যান্ত হয়ে ওঠে আমাদের অনুভবে৷ তাই তো হিন্দু ধর্মের  রীতিনীতি মেনে পূজার্চনা হলেও এ উৎসবের আত্মা হল অসাম্প্রদায়িক মানবাদর্শ৷

সমস্যাটা হল মহালয়ার দিন বন্ধুদের শুভ বলাটা নাকি সাঙ্ঘাতিক বেআক্কেলে  কাণ্ড,--- তাই নিয়ে৷ হ্যাঁ, ফেসবুক তথা হোয়াট্স আপের পাতা জুড়ে দেখা যাচ্ছে কিছু মানুষ উঠে পড়ে লেগেছেন যাতে কেউ 'শুভ মহালয়া' না বলেন সেটি বোঝাতে৷  তাঁদের যুক্তি মহালয়া আসলে পূর্বপুরুষদের তিল জল দানের দিন৷ অর্থাৎ পূর্বপুরুষদের স্মৃতিতর্পণ৷ কাজেই স্মরণের দিন কেন শুভ হবে? তাঁদের এখানেই খটকা যে ঐদিনটা শুভ কেন !  কিন্তু  ছোট থেকেই শুভ মহালয়া কথাটায় অভ্যস্ত মানুষজন এই হঠাৎ আবির্ভূত হওয়া বক্তব্যে কিছুটা অবাক তথা হতাশও৷ কিছু প্রাচীন প্রাজ্ঞজনের সঙ্গে কথা বলে কিছুটা আশ্বস্ত হলাম যে শুভ মহালয়া বলায় কোনও ভুল নেই৷

মহাভারত উদ্ধৃত করে একটি কাহিনি সামাজিক মাধ্যম কাঁপাচ্ছে৷ সেটি হল--- কর্ণের আত্মা যখন স্বর্গে গেল, তখন তাঁকে সোনা দানা খেতে দেওয়া হল৷ এতে তো মহা সমস্যায় পড়লেন কর্ণ৷ যমরাজকে শুধোলেন...তাঁর জন্য খাদ্য পানীয়ের ব্যবস্থা কি হবে না? জানতে পারলেন,  ---না, তাঁকে এসবই খেতে হবে৷ কারণ তিনি পূর্বপুরুষকে জল দান করেন নি, তাই অর্জিত পুণ্যবলে তাঁর পানীয় বা খাদ্য লাভের অধিকার নেই৷ উপায় কি? যমরাজ বিধান দিলেন মর্ত্যে গিয়ে যদি তিনি পূর্বপুরুষকে জল দান করে আসেন তাহলেই তিনি এর অধিকারী হবেন৷ অগত্যা কর্ণ তাই করলেন৷ সূর্য যেদিন কন্যা রাশিতে প্রবেশ করেন সেদিন থেকে যেদিন বৃশ্চিকে প্রবেশ করেন এই এক পক্ষকালেই এহেন ঘটনা অনুষ্ঠিত হল৷ তাই তর্পণের দিন পূর্বপুরুষকে স্মরণ বা তিল জল দান করাই রীতি হয়ে গেল৷ সেক্ষেত্রে দিনটি নাকি মহাশোকের, তাই ঐদিন কোনওভাবেই শুভ মহালয়া বলা যাবে না৷

এই কাহিনিটি মহাভারতের ঠিক কোথায় আছে তার কোনও উল্লেখ অবশ্য সেখানে নেই৷ মহাভারত হাতড়ে কোথাও তার সন্ধানও মিলল না৷ আমরা যদি ধরেও নি গল্পটি মহাভারতে রয়েছে, তাও সেখানে একটা বক্তব্য মাথায় আসে৷সেটি হল কর্ণের তো কোনও পিতৃ পরিচয় ছিল না৷ মায়ের বিবাহের আগের সন্তান হওয়ায় মা তাঁকে ত্যাগ করেছিলেন লোকলজ্জার ভয়ে৷  সমাজে পিতৃ পরিচয়হীন সন্তানের কোনও স্থান নেই৷ মা ধারণ করলেও মায়ের পরিচয় সন্তানের জন্য যথেষ্ট  নয়৷ কাজেই বাধ্য হয়েই কুন্তী তাঁকে ত্যাগ করেছিলেন৷ আজন্ম লাঞ্ছিত কর্ণ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শুরুর আগের দিন জানলেন তাঁর প্রকৃত পিতৃ পরিচয় ৷ তারপর তো তিনি যুদ্ধক্ষেত্রেই মারা গেলেন ৷ কাজেই পূর্বপুরুষকে জল দেবেন কী করে ! অথচ স্বর্গে গিয়েও তাঁর নিস্তার নেই৷ এও তো পুরুষতন্ত্রেরই চোখরাঙানি বলে মনে হয় আমাদের৷ মা নন, বাবারই প্রাধান্য সেখানেও৷

কর্ণের কাহিনি মোতাবেক পরবর্তীতে সাধারণ মানুষও পূর্বপুরষকে জলদান বা তর্পণ শুরু করলেন ৷ এবারে আমাদের প্রশ্ন তাতে দুঃখের কী আছে? স্বয়ং নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী বললেন "দিনটি কোনওভাবেই দুঃখের বা শোক পালনের দিন নয়, এটা সত্যি যে এই দিন পিতৃপক্ষের শেষ, তেমনই দেবীপক্ষেরও তো শুরু, সময় তো ওভারল্যাপিং সবসময়ই, এতক্ষণ পিতৃপক্ষ তারপর দেবীপক্ষ তাতো নয়,এছাড়া পূর্বপুরুষের উদ্দেশে তর্পণ তার মধ্যে তো একটা ইতিবাচকতা আছে, তর্পণ মানে তৃপ্ত করা বা সন্তুষ্টিবিধান করা, তাহলে পূর্বপুরুষকে তৃপ্ত করে তাঁদের আশীর্বাদ প্রার্থনা করার দিনটি সবসময়ই শুভ৷" তিনি আরো বললেন "বাড়িতে বিয়ে বা কোনও মঙ্গলানুষ্ঠানের আগে তো নান্দীমুখ করা হয়, সেটাও তো শ্রাদ্ধই, তাহলে কি তাঁর বিয়ের দিনটা দুঃখের দিন?"

কাজেই নৃসিংহপ্রসাদবাবুর কথাকে মাথায় রেখে আমরা অবশ্যই বলব 'শুভ মহালয়া'৷ মহাভারতের কাহিনি যতই টানা হোক, এতে কোনও মহাভারত অশুদ্ধ হবে না৷


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

1 comments so far,Add yours

  1. বছরে একবার পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে জল দানে অশ্রু ঝরে -সেটা সুখ মিশ্রিত অশ্রু|তাই এই দিনটিকে 'শুভ' বলতে আমার অসুবিধে নেই|

    ReplyDelete