জীবন রায়, প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ, রাজ্যসভা:
শিরোনামা পড়ে আতকে ওঠার কারন নেই । যে দেশে সামন্তিক এবং ঔপনিবেশিক ভাবজগতের জঠরে পুঁজিবাদ নিজেকে গড়ে তুলতে চায়, সেখানে অন্যান্য দলগুলির মতো কোন সাম্যবাদী দলগুলিকেও এদের পচন থেকে নিজেকে নিরন্তর আত্মরক্ষার সুযোগ নির্মান করে চলতে হয়। অনেকটা এরকম - 'মাথা যখন গরম থাকে, তাতে উকুন বাসা-বাধার সুযোগ পায় না।
এই সুত্রেই বুঝতে হবে, নব্বই দশক উত্তোর সাম্য এবং শ্রমিক আন্দোলনে, ভেতরে ফ্যাসিবাদ বিরোধীতার ভাবগত উপাদন সংকুচিত হওয়াটাকেই , জাতীয় একাত্মতা গড়ে উঠায় নেতৃত্বহীনতার সঙ্কটের কারন হয়ে থাকে, সে কারনটাও মূলতঃ ভাবাদর্শগত অভিযানের নিরন্তরতাকে লংঘিত হওয়া। পঞ্চাশের দশকের আগেকার শ্রেনী বিরত্ব, ষাটের দশক থেকে, নব্বই দশক পর্য্যন্ত তিন তিনটি মতাদর্শগত সংগ্রাম এবং আধাফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস মোকাবিলার বীরগাথা ইত্যাদিকে এক অবসবন্য বিষন্নতার বিচ্ছিন্নতায় ঠেলে দেওয়া হয়েছে। তত্বের বাইরে শারিরীকভাবে যারা টিকে আছেন, তাদেরকেও যখন প্রাগ্ - ঐতিহাসিক মর্য্যাদায় আরকাইভে রেখে দেয় বটে, কিন্তু সাধারনভাবে
------- ইতিহাস থেকে সাম্যকে বিচ্ছিন্ন রাখার প্রকৃয়াটাকেই সাহায্য করে যখন , নবিনত্বের নামে , এই বিচ্ছিন্নতা বোধকে জীবন্ত রাখায় ধারাবাহিকতাহীনতার কারনে, ফ্যাসিবাদী বিরোধী তাত্বিক অবস্থানটিই সংকুচিত করার অবচেতন প্রকৃয়াকে রোধ করার যোগ্যতা নেতাদের হাত থেকে খসে যেতে থাকে। ক্রমে এটা ভুলতে দেওয়া হয়েছে, ভাবাদর্শ এবং আন্তর্জাতীকতাহীন রাজনীতি আজকের দিনে ফ্যাসিবাদকেই সাহায্য করবে।
পরিনামে সাম্যবাদের অভিমুখে গনতন্ত্রের প্রতিচ্ছবিতে যেমনভাবে কাদামাটি জমতে দেওয়া হয়েছে, তেমনভাবে ভাবে এবং কর্মের সেতুবন্ধনে যারা একদিন সাম্যবাদী হওয়ার চেষ্টা করেছে, তারা বিচ্ছিন্ন হয়েছে। আর সাম্যের নামে যারা কাজ করছেন, তাদের অনেকের সাথেই সাম্যের জ্ঞানভিত্তিক অভিমুখে দাড়ীয়ে কথাবার্তাই বলা যাচ্ছে না।
------ তবে, কী সাম্যবাদী রাজনীতিতে ইতিমধ্যে ভাবাদর্শ উবে গেছে? তেমন বলা যাবে না। অভ্যাসে যা চলে আসতে, গতানুগতিকতার পক্ষে যথেষ্ট হলেও, ফ্যাসিবাদী ভাবের সদর দরজা তো দুরের কথা খিরকীর দরজাতে হাতও লাগানো যাবে না।
প্রতিরোধের প্রশ্নে, ভারতীয় সাম্যের অন্য এক অন্তর্নিহীত ভাংগন গুরুতর প্রতিবন্ধকতার কারন হয়েছে। এখানে, সাম্যবাদী ভাবাদর্শগত নেতৃত্বের বিষয়টি ক্রমে 'নিয়ন্ত্রনের' দিকে চলে যাওয়ায়, সাম্যের দখলে শ্রেষ্ট মানুষদের সমাবেশ ঘটা সত্বেও, আজ 'সৃজনীর' দরজা কার্য্যতঃ বন্ধ হয়ে গেছে। এখান থেকেই ফাসীতন্ত্রীরা সাম্যবাদী দুর্বলতার সব থেকে বেশী শুবিধা আদায় করে নিচ্ছে। আবারো বুঝতে হবে, এই 'নিয়ন্ত্রনের' লৌহশৃংখল, পর্য্যায়ক্রমে ব্রাহ্মন্যবাদের পুজরক্ত রোধে ব্যবস্থা নিতে না পারার কারনেই ঘটেছে।
এখান থেকেই সাম্যবাদী আন্দোলনে অবচেতনতা থেকে সচেতন প্রতিরোধের প্রশ্নে
------ ব্রাহ্মন্যবাদের পচন থেকে মুক্তির সংগ্রাম, ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামকে সংগঠিত করার প্রশ্নে অতীব গুরুত্বপূর্ন হয়ে উঠবেই। জার্মানীর ফ্যাসিবাদ, ভারতের তুলনায় এক ভিন্ন পরিস্থিতিতে নির্মীত হয়েছিলো। জার্মানীতে ফ্যাসিবাদকে সংহত করতে, যুদ্ধ নির্ভর শিল্পের বিপুল অগ্রগতি ঘটানোর কারনেই সেখানে বিপুল সংখ্যায় মেহনতির জন্ম হয়েছিলো। ভারতের ফ্যাসিবাদ, ওপনিবেশিক এবং ব্রাহ্মন্যত্বের ভিত্তিতে বিশ্বফ্যাসীবাদের ঔরশে জন্ম নেওয়ার কারনে, এর আকৃ্তি এবং প্রকৃ্তি জ্ঞানহীন-সংস্কৃতিহীন বিভৎসতার অংশ হতে বাধ্য। সেই সময়ে শিল্পপুঁজির অবধারিত বিলোপের সাথে সাথে
----- সাধারনভাবেই সাম্যবাদী আন্দলনের ভেতরেই ফ্যাসিবাদ বিরোধী উপাদানগুলিকে , ব্রাহ্মন্যবাদের পচারক্ত চারদিক থেকে অক্টোপাসের মতো জাপটে ধরবে। সে বিপদটাই দেশের সব থেকে বড় বিপদ বলে মেনেছি।
----- সেখানে প্রতিরোধক হিসেবে কমিউনিষ্ট নৈ্তিকতা যদি পচনের শক্তির উপরে প্রাধান্য বিস্তারে অক্ষম হয়, তখন প্রতিরোধক হিসেবে সাম্যের শক্তি হ্রাসের সাথে সাথে, ক্রমসংকুচিত সামাজিক উদারবাদো ফ্যাসিবাদ বিরোধীতায় ভাব এবং সংঠন উভয় দিকেই অপ্রাসংগিক হতে থাকবে।
----- উল্লেখিত বিচার ধারা যদি মেনে চলা হয়, তবে মানতে হবে - আজ যে ফ্যাসিবাদ এবং সাম্যের মাঝামাঝি বিরাজমান রাজনৈতিক শক্তিগুলি যদি ক্রমে ফ্যাসিস্ত আত্মসমর্পনের দিকে ঝুকে পরে থাকে, তার কারনো মূলতঃ ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামের তাত্বিক দিকটি উপলব্ধি করার মতো আভ্যন্তরীন ডাইনামিজম নেই ।
------ এই সুত্রেই বলে রাখি, ১৯৮৯ সালেও এই অবস্থান এতো শক্তিশালী ছিলো যে, মোরারজী সরকারকে ভেংগে দেওয়া এবং অস্থায়ী বিকল্প হিসেবে চরন সিং সরকারকে সমর্থনের সময়েও তদানিন্তন ভারতীয় জনতা দলের নেতারা সারা দেশে যখন দাংগা লাগায়, দলের আভ্যন্তরনীন ডাইনামিজমে ব্রাহ্মন্যবাদের প্রভাব অনেক কম ছিলো। মনে আছে তখন জামসেদপুরে, এমবুলেন্স বোঝাই স্ত্রী-পুরষকে আগুন লাগিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিলো।
----- বাংলার পার্টী সমর্থন প্রত্যাহারের বিপরীতে কার্য্যতঃ বিদ্রোহ করলেও, দল পরিস্থিতির নিয়ন্তগ্রনে ছিলো। তখন শ্রীচরন সিং নিজেই
একজন ব্রাহ্মন্যবাদী হয়েও, মাঝে মাঝেই, সিপি আই এম এর কেন্দ্রিয় দপ্তরে যেতেন, সাম্প্রদায়ীকতা বিরোধী ভাষনের অভিমুখের অন্বেষনে।
আজকে তো দাংগা হাংগামা, খুন-খারাপীর পেছনকার 'দর্শন'টাকে যখন সামনে নিয়ে আসা হয়েছে, তখন তো যে কোন সাম্যবাদী দলের কাছে পরিস্থিতির মূল্যায়ন খুবই সোজা হয়ে যাওয়ার কথা। বিশেষতঃ যখন নেই নেই করে দেশের প্রতিটি রাজ্যে সাম্যবাদী দল নির্মান হয়েছে এবং সি আই টি ইউ সক্রীয় তখন তো এত ত্যাগী মানুষদের সমাবেশ যেখান, সেখানে তো কোন সমস্যার কারন ছিলো না।
---- সেখানে নিশ্চিত করে বলতে পারি, ব্রাহ্মন্যবাদের পুজরক্ত সাফ করে না ফেলে, পুরো দলের কেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে যত সময় পর্য্যন্ত সৃজনীর সব পথ ভেতর থেকেই উন্মুক্ত করে দেওয়ার ব্যবস্থা না হচ্ছে, তত সময় ফ্যাসিবাদ বিরোধী, ভাবাদর্শগত অবস্থানকে কখনোই দৃঢ় ভিত্তির উপরে দাঁড় করানো যাবে না।
----- দল এবং ট্রেড ইউনিয়ন যদি গভীরে গিয়ে খোজখবর করতে থাকেন, দেখবেন, সংগঠনের ভেতরেই, একটি বিরাট অংশ - ফ্যাসিস্তদের (ক) তিন তালাক (খ) ধর আর দীর্ঘ মেয়াদীভাবে জেলে ঢোকাও আইন (গ) ৩৭০ প্রত্যাহার (ঘ) হিন্দি ভাষাকে একমাত্র ভাষা ইত্যাদির পৃথক দেখছেন এবং সামগ্রিক বিচারে, সংবিধান বিবর্জীত ফ্যাসিবাদী অবস্থানে উত্তরনের অভিমুখ হিসেবে দেখতে ব্যর্থ হবেন।শেষ বিচারে, আদর্শ এবং কমিউনিষ্ট নৈতিকতা - প্রয়োজনে গায়ের জোরে - প্রতিষ্ঠা করতে না পারার কারনেই এমনটি ঘটতে পেরেছে। এই পরিস্থিতির কারনো পূর্বে উল্লেখিত 'সেই পুজরক্ত'।
আমার এক সহকর্মী সাংসদ, আমার দলেরই, যিনি সংসদীয় কাজে নামডাক করেছিলেন এবং নিজেকে শ্রমিকদের কাছের লোক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ করে নিয়েছিলেন। তিনি ভ্রহ্মন্যবাদ সম্পর্কে কোন কথা তুল্লেই, আপত্তি করতেন। আমার ভালো লাগতো। তিনি নিজেকে গোপন করার চেষ্টা করেন নাই। কথাটা তুল্লাম এই কারনেই
----- নিজে ৬০ বছর সময় ধরে কয়েক মিলিয়ন, সংগঠিত শিল্পশ্রমিকদের গা' ঘেষে ঘেষে চলেও যদি, ব্রাহ্মন্যবাদের পুজ রক্তের অক্টোপাশের বন্ধন থেকে এখনো মুক্তি পেলাম্ন না
----- কিন্তু লক্ষ লক্ষ বাবু নেতা মনে করছেন, একটা ঘোষনা এবং কয়েক হাজার মিছিল সংগঠিত করার মধ্য দিয়ে সাম্ব্যবাদী হয়ে গেছেন। অথচ, নিজের দিকে তাকিয়ে দেখেন না
------ আজ যদি ফেডারেলিজিম দলের উপর থেকে নিচে গ্রাস করে থাকে, সি আই টি ইউকে যদি আন্তর্জাতীকতাকে ফ্রেঞ্চাইজে দিয়ে বেচে থাকার পথ
সন্ধান করতে হয়
------- তার কারন কোন বিপ্লবকে আবাহন করে এনে বর্নাশ্রম এবং নারীর অমর্য্যাদার বিনাশ ঘটিয়ে মেহনতিদের নিজেদের মুক্ত করার কথা ভাবানোনই যাচ্ছে না। আসলে সরশের মধ্যেই যখন ভূত থাকে, তখন কিছু করার থাকে না।
এসব কথা বলতে গিয়ে, এটা বলা হচ্ছে না যে ব্রাহ্মন সম্প্রদায় আমাদের জাতির জন্য কিছুই করে নাই।আর আজকাল যখন, উচ্চবর্ণের অভ্রাহ্মনরাও, অধিকতরভাবে ব্রাহ্মন্যবাদী আচার আচরনকে অনুসরন করছেন তখন
------ এটা বোঝানো হচ্ছে না, ব্রাহ্মন সম্প্রদায় দেশের মানুষের জন্য কিছুই করে নাই। ওরাই দেশে শিক্ষা এনেছে প্রথম, যদিও সে শিক্ষায় নিম্নবর্ণ , মুসলিম এবং মেয়েদের প্রবেশ নিষেধ ছিলো। আজকাল, ফ্যাসান হয়ে গেছে দেশ বিভাজনের জন্য মুস্লিমদের দায়ী করা। ক'জন কমিউনিষ্ট বোঝাতে পেরেছেন - পশ্চিম বাংলায় ক'জন ভুমি সংস্কারের আগে মুসলিম, নিম্ন বর্নের লোক স্থান পেয়েছেন। কেন এদেশে এতো বিপুল সংখ্যায় মাদ্রাসা। পূর্বা বাংলাতেও ক'জন স্থান পেয়েছিলো।
------পরিস্থিতির ভয়ঙ্করতা বোঝাতে একটা কাহিনী বলতাম। বাবুদের জন্য যে সবকিছু, সেটা গরিব বর্ণগূলিকে দিয়ে কীভাবে মানিয়ে নেওয়া হয়েছিলো তা বোঝানোর জন্য। গল্পটা এরকমঃ
---- এক জমিদার বাবু, লোকজন ডেকে, তাদের সম্মুখে, তার রায়তকে 'জূতো' পেটাতে পেটাতে, নিজের নতুন জুতো ছিড়ে ফেলতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে গিয়ে, রায়তকে সতর্ক করে ছেড়ে দেন। বেচারী রায়তঃ তো খুব খুশি, বাবুর জূতো ছিড়ে ফেল্লেও, জুতোর দাম নেন নাই।
আবার এটাও ঠিক ব্রাহ্মন্যবাদীদেরই একটা প্রগতিশীল ধারা
----- সতি দাহ এবং বালিকা বিবাহের বিরুদ্ধে, স্ত্রী শিক্ষার পক্ষে, উন্মুক্ত বিদ্যালয়, সমান অধিকারের দাবীতে সংগ্রামের দরজা উন্মুক্ত করেছিলেন।
কিন্তু সাম্য যদি সেখানেই থেমে যায়, তবে তা কিভাবে জাতীয় বিপর্য্যয়কে টেনে আনবে, তার লক্ষন ইতিমধ্যেই স্পষ্ট। খুব ভয় হয় ভাবতে - নিজের দলটার সাথে সাথে সি আই টি ইউটাও
Post A Comment:
0 comments so far,add yours