কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:
ভারতের 'মোস্ট ওয়ান্টেড' দাউদ ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য গ্রেপ্তার পরোয়ানা জারির জন্য আর্জি জানিয়েছিল সিবিআই। সেই ঘটনার দৃষ্টান্ত টেনে, আলিপুর আদালতে কলকাতার প্রাক্তন পুলিস কমিশনার রাজীব কুমারের বিরুদ্ধেও ওই একই আর্জি জানালেন সিবিআই আইনজীবীরা।
ওই দিনই তাঁরা রাজীব কুমারকে 'পলাতক' বলেও মন্তব্য করেন।
রাজীব কুমারের আইনজীবী অবশ্য বলেন, "এক থেকে পঁচিশ তারিখ পর্যন্ত, তাঁর মক্কেল হাজির থাকবেন না বলে আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল সিবিআইকে।"

"মাত্র একজনকে ধরতেই এই অবস্থা?"
সিবিআই জয়েন্ট ডিরেক্টর পঙ্কজ শর্মাকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন এক সাংবাদিক। বুধবার সকালের ঘটনা।
"বহুত সারি বাঁতে হ্যায়।" একটুকরো হাসি ছুঁড়ে, জবাব দিয়েছিলেন সিবিআই কর্তা।
কী সেই 'বহুত সারি' কথা? ওই 'অনেক কথা'র জন্যই কি পাঁচবছর পরেও সারদা রহস্য আজও রহস্য থেকে গেল? সিবিআইয়ের সক্রিয়তা নিয়েও বারবার সন্দেহ প্রকাশ করেছেন রাজ্যের শাসকদল বিরোধী শিবির।
এবারেও সেই একই সন্দেহের সুর ফের শোনা গেল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিল্লিযাত্রার খবর কানে আসতেই। "কোনও সরকারি কাজ-টাজ নয়। মুখ্যমন্ত্রী দরবার করতে গেছেন নিজের আর ভাইপোর হয়ে।" দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পাশাপাশি, মুখ্যমন্ত্রী দেখা করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর সঙ্গেও।
ওদিকে বৃহস্পতিবার রাজীব কুমার নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করতেই মুখ্যমন্ত্রী বলেন, "ওই ব্যাপারে আলোচনা করতে তিনি দিল্লি আসেননি।" পরে অবশ্য তিনি গোটা ব্যাপারটাকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বলে মন্তব্য করেন।

ওদিকে ইতিহাস তৈরি করলেন রাজীব কুমার।
কপুরের মতোই যেন উবে গেলেন সিআইডি এডিজি। হন্যে হয়ে তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছে সিবিআই। গত শুক্রবার কলকাতা হাইকোর্ট রাজীব কুমারের গ্রেপ্তারি বাঁচানোর রক্ষাকবচ ওঠায়। পরমুহূর্তেই সক্রিয় হয়ে ওঠেন সিবিআই কর্তারা। তারপর থেকে কদিন কাটতে চললেও, আজও অধরা কলকাতা গোয়েন্দার ঝানু কর্তা রাজীব কুমার।

পুলিশ ছুঁলে আঠারো ঘা। গোয়েন্দা ছুঁলে কত ঘা?
এই প্রশ্নটির উত্তর জানেন একমাত্র রাজীব কুমার। সেই ভয়েই সম্ভবত আন্ডারগ্রাউন্ড হয়ে গেছেন তিনি। আর ঠিক তখনই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বৈঠকে বসলেন নরেন্দ্র  মোদি, অমিত শাহর সঙ্গে। দ্বিতীয়বার মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর একাধিকবার দিল্লির ডাক পেলেও হাজির হননি মমতা। মোদি মমতা শেষবার মুখোমুখি হয়েছিলেন ষোলো মাস আগে। আর বৈঠকে বসেছিলেন আড়াই বছর আগে। পরের দিন মুখ্যমন্ত্রী দেখা করেন অমিত শাহর সঙ্গে। দ্বিতীয় এনডিএ সরকার ক্ষমতায় আসার পর, এই প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করলেন মুখ্যমন্ত্রী।
মুখ্যমন্ত্রী কি তাহলে দিল্লির ওপর শেষ পর্যন্ত নরম হওয়ার রাস্তায় হাঁটলেন?
বিরোধীরা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন, রাজীব কুমারের পরিত্রাণের বন্দোবস্ত করতেই মুখ্যমন্ত্রীর দিল্লিতে ছুটে যাওয়া। কারণ কান টানলেই মাথা আসবে।

এদিকে বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই টানটান নাটক কলকাতা জুড়ে। সকালেই আলিপুর আদালতে পৌঁছে যান সিবিআই আইনজীবীরা। অন্যদিকে দুপুর দুটো দশ নাগাদ আলিপুর আইপিএস মেসে হানা দেন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার চার আধিকারিক। মিনিট পঁচিশ পর তাঁরা খালি হাতেই বিদায় নেন। সাংবাদিকদের কৌতুহল জবাবে এক আধিকারিক বলেন, "লেট আস ডু আওয়ার ওয়ার্ক।"
ওদিকে প্রায় একই সময়ে চৌত্রিশ পার্ক স্ট্রিটে কার্যত পুলিসের চোখে ধুলো দিয়ে ঢুকে পড়ে সিবিআইয়ের আরেকটি দল। আবাসনের বেশকিছু মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা বলে তাঁরা রাজীব কুমারের হাল- হকিকতের খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা চালান। সূত্রের খবর রাজীব কুমারকে সিজিও কমপ্লেক্সে হাজির হওয়ার জন্য তাঁর  আবাসনে ফের নোটিশ ধরান সিবিআই আধিকারিকরা।
রাজীব কুমার ওই আবাসনেই গা-ঢাকা দিয়ে আছেন, এমন সন্দেহ জোরদার হয়েছিল গতকালই।
বুধবার বেলা এগারোটা নাগাদ সেখানে এসে পৌঁছন রাজীব কুমারের আপ্ত সহায়ক শুভম বন্দ্যোপাধ্যায়। একবার না, পরপর দুবার। বেশকিছু ফাইল, কাগজপত্র নিয়ে বেরিয়ে যান তিনি। প্রসঙ্গত সিবিআইয়ের চিঠির জবাবে, নবান্নের তরফেও ইঙ্গিতে সেরকমটাই জানানো হয়েছিল। বলা হয়েছিল, রাজীব কুমার ছুটি কাটাচ্ছেন। তবে তিনি কলকাতাতেই আছেন।
এদিকে মেসে হানা দিয়ে ওই তদন্তকারী দল পৌঁছে যান রুবি মোড়ের এক পাঁচতলা হোটেলে। ওই দলে একজন অ্যাডিশনাল সমেত তিনজন এসপি পদমর্যাদার আধিকারিক ছিলেন। আধ ঘণ্টার মধ্যেই হোটেল থেকে বেরিয়ে আসে তদন্তকারী দল।
বাস্তবে বুধবার রাতভর রাজীব কুমারের নাগাল পেতে শহর চষে ফেলেন সিবিআই গোয়েন্দার দল। তল্লাশি জোরদার করতে ইতিমধ্যেই দিল্লি থেকে উড়ে এসেছে সিবিআইয়ের বারো আধিকারিকের এক বিশেষ দল। মোটামুটি চার- পাঁচটি দলে ভাগ হয়ে আধিকারিকরা কলকাতার নানা জায়গায় তল্লাশি চালিয়ে যাচ্ছেন।
ওদিকে সিবিআইয়ের আইনজীবীরা ব্যস্ত আছেন আলিপুর এসিজেএম আদালতে। সেখানে সিবিআইয়ের জামিন অযোগ্য গ্রেপ্তার পরোয়ানাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মামলা লড়ছেন রাজীব কুমারের আইনজীবী। তাঁর দাবি, রাজ্য সরকারের অনুমতি ছাড়া রাজীব কুমারকে গ্রেপ্তার করা যাবে না।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours