শেখ ফরিদ, প্রগতিশীল লেখক, বাংলাদেশ:
অধ্যাপক
নীহার কুমার সরকারের, "ছোটদের রাজনীতি "নামে একটি বই পড়ে ছিলাম। আমাকে
বইটি উপহার দিয়েছিলেন কমরেড দৌলতুজ্জামান স্যার। যিনি সরকারী চাকুরী ছেড়ে
দিয়ে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নেন। নিজেদের জমিতে একটি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা
করেন। আমৃত্য সেই স্কুলের হেড টিচার ছিলেন। তিনি স্বপ্ন দেখতেন একটি
সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব। তিনি কায়মনে কামনা করতেন বাংলাদেশে কমিউনিস্ট পার্টি
ক্ষমতা দখল করুক। দখল শব্দটি জন্য বললাম যে, তিনি কখনো বিশ্বাস করতেন না
সমাজতন্ত্র ভোটে প্রতিষ্ঠা সম্ভব। তিনি আপাদমস্তক কমিউনিষ্ট ছিলেন। অর্থ,
সম্পদ, সময় ও শ্রম দিয়ে কমিউনিজমকে সমাজের সামনে তুলে ধরতেন। তিনি মনে
করতেন, কেবল ঢাকার প্রেসক্লাব, তোপখানা বা পল্টনে বসে চেচামেচি করলে এ
দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম হবে না। সমাজতন্ত্রের পাঠ নিয়ে যেতে হবে অজোপারা
গাঁয়ের স্কুল কলেজের ছাত্রদের হাতে, কৃষকের হাতে, শ্রমিককে তো সে পাঠ নিতেই
হবে। তিনি আরো চাইতেন নারীরা সমাজতন্ত্রের পাঠ নিক। বিশেষ করে আমাকে বলতেন
"ফরিদ নারীদের যদি সমাজতন্ত্রের পাঠ দিতে পারো তবে খুব কাজে দেবে। ২০
বছরে এ দেশ পাল্টে যাবে। নারীরা রাজনীতিতে এগিয়ে এলে যে কোন দেশ এগিয়ে
যাবে। শিক্ষায় এবং অর্থনীতিতে।"
আমি
ছোট ছেলে মেয়েদের "ছোটদের রাজনীতি" বইটি পড়তে দিতাম। অনেকেই বইটি পড়ে
ফেরত দেয়ার সময় বলতো ' ভাইয়া', 'দাদা,' 'ভাই', 'কাকা ' বইটা,পড়ে কিছুই
বুঝিনি! কেউ কেউ না পড়েও ফেরত দিতো। আসলে ছোটদের রাজনীতি বইটি বুঝে না
এদেশের মেঝোরাও। কখনো কখনো বড়রাও বুঝে না। সত্য বলতে আমি নিজেও দু তিনবার
না পড়ে বুঝিনি। এমনকি এখনো ছোটদের রাজনীতি বইটি পড়ি। এতে আমার অভিজ্ঞতা
শানিত হয়। কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো কতবার পড়েছি তার হিসাব নেই। আগে বুঝতাম না
এখন বুঝি। কার্লমার্কস্ (ও এঙ্গেলস্) কম বয়সে কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো লিখলেও
তা ছিলো কালজয়ী। পুঁজিগ্রন্থের আলোচনা আজ থাক।
অনেকেই
ছোটদের রাজনীতিতে আসা পছন্দ করেন না। যদিও রাজনৈতিক ছাত্র ও যুব
সংগঠনগুলো ছোটদেরই রিক্রুটম্যান্ট করে থাকে। আগেই তা ছিলো এখনো
আছে।সমাজবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বইগুলো পড়লেই বুঝা যায়, কে কারা কাদের
কখন রাজনীতিতে নিয়ে আসে। আর আমাদের চোখের সামনেই তো ঘটে, কোন শ্রেনীর, কোন
কোন ব্যাক্তিকে কেন রাজনৈতিক দলগুলো রিক্রুট করে থাকে।
অনেকেই
বলে "রাজনীতি ভালো মানুষে করে না। " বিশেষ করে সমাজের নিরীহ ধরনের
মানুষগুলো তাদের সন্তানদের রাজনীতিতে আসতে দিতে অনীহা বোধ করে থাকেন। তবে,
এই নিরীহদের যখন বোঝানো হয়, তার সন্তান নিরাপদ ও রাজনীতিতে এলে তার সন্তানই
লাভবান হবে। তখন সন্তানকে রাজনীতিতে যুক্ত হতে নিষেধ করেনা! এবং অনেকবার
দেখা গেছে এই নিরীহর সন্তান, নিরীহ হয়েও কত না ভয়ংকর হয়ে উঠে। অন্যের সম্পদ
দখল, সন্ত্রাস, খুন, ধর্ষনের সম্পৃক্ত হয়ে যায়। সমাজে রাষ্ট্রে নেতিবাচক
প্রভাব পরে।
কজন ছাত্র ও
তরুন রাজনীতির পাঠ নিয়ে, দেশ প্রেমের পাঠ নিয়ে রাজনীতিতে আসে? কোন রাজনৈতিক
দল, তার ছোট ছোট (তথা কম বয়সি) কর্মীদের দেশ ও বিশ্ব রাজনীতির পাঠ শিক্ষা
দেয়! আজকাল সিংহভাগ ছোটদের পড়তে বলা হয় কেবল চাকরীর জন্য প্রস্তুুতি
নিতে। কজন পিতা-মাতা তার সন্তানকে পড়াচ্ছেন রাজনীতি করার জন্য? আমরা কি
কেউ আমাদের সন্তানকে, ছোট, ভাই বোনদের রাজনীতির পাঠ নিতে কখনো কি কিছু পড়তে
বলেছি? দেশ ও বিশ্বরাজনীতি নিয়ে তাদের সাথে কথা বলেছি? বলিনি। তাহলে তারা
শিখবে কোথা থেকে? যে সকল রাজনীতিক আজ নিজ দেশে ও বিদশে প্রখ্যাত। যারা
কিংবদন্তি হয়ে আছেন তাদের ইতিহাস বলে, হাতে গোনা দু একজন ব্যাতিত তারা
সকলেই বই পড়তেন। কারো কারো তো পারিবারিক গ্রন্থাগারও ছিলো।
অধ্যাপক
ডক্টর শেখ বাতেন বলেছেন; নেতার ছেলে হয়ে নেতাগীরী করা যায়। করছেও। কিন্তু
বুদ্ধিজীবীর সন্তান হয়ে বুদ্ধিজীবী গিরি করা যায় না। ডক্টর বাতেন ঠিক
বলেছেন। তার সাথে একমত হয়ে বলতে হয়; নেতৃত্ব অর্পন করা যায় কিন্তু
পান্ডিত্য? কখনোই অর্পন করা যাবে না। সম্ভবও নয়৷ পান্ডিত্য অর্জন করতে হয়।
ছোটদের
যদি আমরা রাজনীতি করতে না দেই তবে, আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ রাজনীতিক কারা
হবে? কারা দেশের রাজনীতির নেতৃত্ব দেবে? সামরিক শাসকেরা রাজনীতি ও ক্ষমতা
গ্রাস করলে তার পরিণতি কি হয়, আফ্রিকা মহাদেশ ও পাকিস্তানের উদাহারন সামনেই
আছে। আজ পাকিস্তানের টিভিতে শেনা যায়, " হামে বাংলাদেশ বানা দো"। অথচ, ঐ
পাকিস্তানীরাই মনে করতো, আমরা বোকা, বেটে, অকর্ম, অদক্ষ, অযোগ্য! আমাদের
দেশেও বেশ কবছর সামরিক শাসনের অধীনে ছিলো তা না হলে দেশটা অনেক এগিয়ে
যেতো।
আমি এখনো ছোটদের
রাজনীতি বইটি কিনে ছোটদের দিয়ে থাকি। যদিও তারা ৯৫ ভাগই সমাজতান্ত্রিক
রাজনীতিতে আসেনি। নিজেকে যেমন পড়তে হবে,তেমনি ছোটদেরও কেবল চাকুরীর জন্য
নয়, রাজনীতির শেখার জন্যও পড়তে দিতে হবে। অবশ্য বই দিতে গিয়ে আমার বিচিত্র
অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমার আত্মীয় স্বজনদের সন্তানদের বিভিন্ন বই পড়তে দিলে
প্রথমে তারা বলে, বই পড়তে ভালো লাগে না। আর যারা দু চারজন বই পড়তে নেয়।
তাদের অবিভাবকেরাই বই পড়তে নিষেধ কর থাকে। বলে, কোচিং আছে স্কুলের পড়া আছে
"অন্য বই পড়ে সময় নষ্ট" করা যাবে না!
আমরা ছোটদের
বাজেট কি তা শেখাবো না! গনতন্ত্র কি, সমাজতন্ত্র কি, ধর্মনিরপেক্ষতা কি তা
শেখাবো না। ফ্যাসিজম কি, রাজতন্ত্র কি, সেচ্ছাচারীতা কি তা শেখাবো না। বাক
স্বাধীনতা, ব্যাক্তি স্বাধীনতা কি পরমতসহিষ্ণুতা গনতন্ত্রের অন্যতম শর্ত।
সমালোচনা, কলা ও বিজ্ঞান তা শেখাবো না! তাহলে সে সমাজ কেমন হবে? নিশ্চয়ই
বন্ধ্যা। কেবল অর্থনৈতিক ভাবে ধনী হলেই যদি সব হতো, তবে কুয়েত, ব্রুনাই,
কাতার, সৌদী আরবের সব হয়ে যেতো। কেন না রাষ্ট্রগুলোর কোন নাগরিক দরিদ্র নয়।
এবং রাষ্ট্রও খুব ধনী। উল্লেখ্য চারটি দেশের একটিতেও গনতন্ত্র নেই। তাদের
নাগরিকেরা চিন্তা চেতানায়,কত পিছিয়ে তাদের সাথে পাঁচ মিনিট কথা বললেই বুঝা
যায়। দোষ তাদের নয়, কেন না রাষ্ট্র চায়নি তাদের চিন্তা চেতনার বিকাশ
ঘটুক। তারা চায় না, তাদের ভেতর থেকে স্বাধীন চেতনা,নিয়ে কেউ বড় হোক।
শিক্ষাই
কেবল এমন পরবর্তন আনতে পারে, যা আর কোন মাধ্যমে আনা কশ্মীন কালেও সম্ভব
নয়। ছোটদের রাজনীতি শিখতে দিন। তা না হলে একদিন সব থাকবে দেশে রাজনীতিক
থাকবে না। আর দক্ষ কূটনীতিক ও রাজনীতিক না থাকলে কোন দেশ বিশ্ব রাজনীতিতে
এগিয়ে যেতে পারবে না।
দেশ
প্রেম ও রাজনীতির পাঠ দেয়া হয়নি বলেই, কেরনীরাও শত, হাজার কোটি টাকা নিয়ে
নিরাপদে দেশ ছেড়ে পালাতে পারে। হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যাংকলুটের
কেলেঙ্কারির খলনায়কেরা, সীনা উচিয়ে রাজধানীতেই ঘুরে বেড়ায়। অথচ সেই বিদেশ
পলাতক কেরানি এবং ব্যাংক লুটেরাদের জেল হাজতে বন্দী থাকার কথা। রাজনীতির
পাঠ যদি ছোটদের দেয়া হতো, তবে খুনি ধর্ষকেরাও আজকাল আদলত প্রাঙ্গনে,
বাদীকে হুমকী দিতে পারতো না। ছোটদের রাজনীতির পাঠ দেয়া হয়নি বলেই রাজনীতি
এখন ব্যবসায়ী ও অপরাধীদের দখলে। অথচ রাজনীতি করার কথা সভ্য ও সৎ মানুষের।
কিন্তু ছোটদের রাজনীতি পাঠের সুযোগ নেই বলে রাজনীতিতে মগজ ধোলাই করে কখনো
সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতিয়ার বানানো হয়। কখনো বা তার নেতার লাঠিয়াল বাহিনী
হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হয়। ছোটদের তাই রাজনীতি পাঠ অতি জরুরী।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours