প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:

(থরে থরে সাজিয়ে আছে, নীল, কালো কালি... 
হস্তাক্ষর,  আজও চিহ্নের গভীরে শ্বাস..  গোপন উপত্যকায় সারিবদ্ধ অক্ষরমালা....) 

সময়ের নিরিখে সাঁকোটা দোলা দিয়ে যায়। আলোকিত পথ নির্মাণে অক্ষরের সারিবদ্ধ আলাপ, ১৮৭৪ থেকে ১৮৮২। 

একবার এক পত্রিকায় পড়েছিলাম, মনের ভিতরে গড়েছি একটা বৃহৎ গর্ত। সে এক সর্বগ্রাসী অসুখ। যার আকার বাড়তে বাড়তে আকাশ ছুঁয়েছে বহুকাল - এমন করেই ৮৪ সালে কাদম্বরী দেবী  অমৃতলোকে যাবার যাত্রা আয়োজন করেছিলেন।  এমন শোকে বিদ্ধ হয়েছিল কবি শোক। যে প্রশ্নচিহ্ন রেখে গেছে জীবনের খামে  আজও চিঠি হয়ে বয়ে আছে স্রোত। নামেই তো বৌঠান, সে যে ভালোবাসার ঘরে আগুন রাঙা সম্পর্কের স্বরলিপি, একমাত্র বন্ধু তাঁর।। 

বেঁচে থাকতে কোনোদিন সুখ পায়নি বৌঠান৷ কেবল গনগনে দাগ রয়ে গেছে, প্রেক্ষাগৃহে। কবিতার খাতায় নাম ছিল "মালতি পুঁথি "। এই পুঁথিতেই তাই  ম্যাগনেলিয়ার গন্ধ। ঐ যে ম্যাকবেথ ছুঁয়ে আছে রহস্যলোকের দেবী.. "হেকেটি", এই তো কবির একমাত্র সুজন সখী, হৃদয়ের "হেকেটি ঠাকরুন"। এ যে সত্য অনুভব, ধ্রুব, নিত্য। 
কিন্তু মাল্যদানে যে অন্য এক মুখ ভেসে এলো। এ যে নির্দেশের অবিবেকী আচ্ছাদন। মনের তার খুলে ভালোবাসার প্রিয় সখী পর হয়ে গেছে, ক্ষণিকের। তাই তো তৈলচিত্রে আঁকা কথায় সুর সংযোজনী.. 
"তুমি কি কেবলই ছবি, শুধু পটে আঁকা "।আনমনা মনে সেই পুঁথিতেই তো কাটাকুটি আঁকা শুরু।। 

রবিঠাকুরের তো প্রাথমিকে চিন, জাপানের লিখনশৈলীর সাথে দক্ষতা আসার সুযোগই  আসে নি৷ আসলে পরিচিতি তো ছিলো না৷ তবে যে, ১৯০২ - এ জাপানি শিল্প ইতিহাসবিদ ও নন্দন তাত্ত্বিক ওকাকুরা কাকুজো ভারতবর্ষে এসেছিলেন, সেই থেকেই পরিচিতি, বন্ধুত্ব ও ঘনিষ্ঠতা। শান্তিনিকেতনের একাত্মতার ভরা সমুদ্র তখন নিজেকে আরো পরিপূর্ণ করতে চায়৷ সংযোজনী ছুঁয়ে দিলেন বৌদ্ধ জাপানি গবেষক হোরি শিতোকু, সাথে সম্বৃদ্ধির ভূমিতে আর সাত মাস অতিক্রান্ত। ১৯০৩, পাশাপাশি অবস্থান করছে বিনিময়ে রীতি ও পদ্ধতি। ১৯০৫ এ, রবিঠাকুরের সাথে কাটিয়েছিলেন শিল্পী কাৎসুতা শ্যোকিন ও জুজুৎসু সানো জিননাসু।

১৯০২ এর ১৭ ই জুন, হোরি শিতোকু লিখেছেন, " ররবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাকে কালি দিয়েছেন। " তা দেখেই প্রমথ চৌধুরী একটি "নমুনা" কলম উপহার পাঠিয়েছিলেন৷ অন্ত তেজের ভ্রমে বার বার ঝড়েরবেগে মনে হয়েছিল বিভুঁই যাত্রা পাঠ। কিন্তু অযাচিত হয় ১৯১৩, খ্যাতির আহ্বানে যাত্রা। তাই বলে কি ব্রাত্য থাকবে আরোহীবিহীন আমন্ত্রণ!!  সঙ্গী হলেন মুকুলচন্দ্র, সোহাগী পিয়ার্সন ও অ্যাণ্ড্রুজ। জাপান মানেই রবি কবির কাছে ইয়োকোহামার সান নো তানি, ধনী ব্যবসায়ী ও শিল্পবেত্তার হারা সাবকেই - এর অপূর্ব বাগান বাড়ি। 

চিত্র যদি শিল্প নির্মিত অবয়বী ভ্রুণতারা হয়, তবে যে অক্ষরচিত্রে এ এক শ্যোদো ক্যালিগ্রাফি।  রবীন্দ্র ফ্রেমে তখন সোহাগী "এডমিরাল ট্যোগো " আঁকার স্পৃহা৷ অক্ষরচিত্রে পুরোদস্তুর উৎসাহ শিল্পী। জাপানি তুলিতে আঁকা কালি সংযোগে রবি পেল্লায় ক্যালিগ্রাফি। ১৯১৬ - ১৯ এর ভিতরে মোট পাঁচবার ভ্রমণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।  মনে পড়ে যায়, 
"হে মহা টাইকন - / বিশ্বের অন্তরে তব স্থান।  তব চিত্রপটে / বিশ্বের প্রাণের কথা রটে। " টোকিওয় তাইকানের সেই বাড়ির বর্ণনায় রবীন্দ্রনাথের ঐশ্বর্য বর্ণনা.. মানব জীবনের জীবনযাত্রা এক কলাবিদ্যা।দেওয়ালের কোণে কোণে কোথাও অনাদর নেই, অনাবশ্যকতা নেই। পূর্ণতা তো নয়, যেন রিক্ততাতেই পূর্ণতা বেশী। চোখ তো মিছিমিছি আঘাত নয়, শব্দ রিক্ত অনুভব। 

রবীন্দ্রভবন জুড়ে আজও নস্টালজিক মতো দাঁড়িয়ে মোটা, সরু তুলি।  ভিক্তোরিয়া ওকাম্পো  লেখার ভুল চাপা দিতে কবিকে উৎসাহিত করতেই, পাণ্ডুলিপি চিত্রের উৎকর্ষতা ব্যাখ্যা করেন৷ পূর্ব এশিয়ায় রাক্কান " ক্যালিগ্রাফির চল দেখা যায়। ১৯১৬ সালে জাপানের "ওসাকা আসাহি শিনবুন" সংবাদপত্রে কর্ণধার রুহেই কে লিখে তুলে দিলেন " নমো বুদ্ধায়"। আবার আরাই কামপোকে ১৩০ x  ৩১.৫ সেমি এক কাগজে রবীন্দ্রনাথ লিখে দিয়েছিলেন " শাক্যমুনি"। এটি জাপানি "তাতেগাকি " শৈলীতে লেখা৷ আবার  কিজিমাকে লেখা ক্যালিগ্রাফিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন " স্বধর্ম্মে নিধনং শ্রেয়ঃ ", আর কিজিমার নাম " তাতেগাকি" শৈলিতে লিখেছিলেন। জাপানের কাগজে ওওকুরা কুনিহিকোর বাড়িতে থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথ লিখে ফেলেছিলেন "যুক্ত করহে সবার সঙ্গে/ মুক্ত করহে বন্ধ "।

রবীন্দ্রনাথ ১৯২৪ সালে তুলি দিয়ে লিখে ফেলেন, " খাঁচার মধ্যে অচিন পাখি / কমনে আসে যায় / দেখা পেলে মনোবেড়ি / দিতাম তারি পায়।।"কাওয়াই - এর তথ্য অনুযায়ী "অসতো মা সদগময় " লেখাটি কবি দিয়েছিলেন, অকালপ্রয়াত জাপানি শিল্পী শিমোমুরা কানজান - কে। লেখাটির মাপ ৯০ × ৪০.৫ সে.মি।। এমন করে আসে " বিপদে মোরে রক্ষা করো / এ নহে মোর প্রার্থনা।। " 

জীবনের শেষ চিঠিতে মুখে মুখে বলে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।  শুনে শুনেই বলে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।  কিন্তু নিয়মের খাতা ধরেই তো নির্বিকল্প হয় কলম৷ পূত্রবধূ প্রতিমাকে লেখা শেষ চিঠিতে কাঁপা কাঁপা শিল্পকলায় লেখা শব্দ, যেন শূন্যতায় সাক্ষর৷ আমৃত্যু শিল্পীর টান যে এমন অমোঘ নিয়মে বাঁধতে নেই, নামাক্ষর রচনা - তবু "ওঁ সত্যং জ্ঞানং অনন্তং ব্রহ্ম"।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

1 comments so far,Add yours

  1. অনবদ্য লেখনী শৈলী। মুগ্ধ হলাম তোমার লেখায় সুধী। এই ভাবেই লিখতে থাকো প্রতি মূহুর্ত।।

    ReplyDelete