কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:
ইসরোর চেয়ারম্যান কে শিবন, কেন পুজোআচ্চা করলেন?
মোদিজি কেন এতবার পোশাক বদলাবেন?
জেএনইউ-এর বামপন্থী ছাত্রনেতা ঐশী ঘোষ কেন হাতে তাবিজ ঝোলালেন?
এক প্রশ্ন। দুই প্রশ্ন। তিন প্রশ্ন।
প্রশ্নের পর প্রশ্ন।
সত্যিই তো! গণতান্ত্রিক দেশ ভারত। কে শিবন, নরেন্দ্র মোদি, ঐশী ঘোষের ভোটের দাম যা, আমার আপনারও তা। আমরা তো সব একইরকম। সমান সমান। পেয়ারাও তো গরীবের আপেল, ডাক্তারবাবুরা বলেন। তাহলে আবার আপেল বলে পায়াভারী কেন রে বাপু? দারুণ সব যুক্তি। ইসরোর চেয়ারম্যান সাহেব পুজো করার আগে একবার ওই বিদ্বজ্জনদের জিজ্ঞেস করবেন নাই বা কেন? মোদি, ঐশীরও উচিত ছিল, পোশাক বদলানো বা মাদুলি ঝোলানোর আগে একবার ওই মাননীয়দের সঙ্গে কথা বলে নেওয়া।
সব প্রশ্নের উত্তর জানতে চান বাংলার কিছু বিদ্বজ্জন। পাশাপাশি আছেন আরও বেশ কিছু মানুষজন। কয়েকদিন আগে পর্যন্ত তাঁরা মেতেছিলেন রাণুকে নিয়ে। প্ল্যাটফর্মের হতদরিদ্র সুরেলা রাণুকে নিয়ে ছিলেন, প্রশংসায় পঞ্চমুখ। রাণুর অবস্থা ফিরতেই খিস্তির সুনামি। এখন এঁরা মুখ খুলেছেন চন্দ্রযান নিয়ে। 'বিক্রম'-এর ব্যর্থতার রাজনৈতিক, প্রযুক্তিগত বিশ্লেষন নিয়ে সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকারাও সোচ্চার। আবার অচল 'বিক্রম'- এর সঙ্গে ইসরোচিফের পুজোআচ্চাকে জড়িয়ে নিজেদের সবজান্তা, সেকুলার ভাবমূর্তি তুলে ধরতে সোশ্যাল মেডিয়ার পাতা ভরিয়ে চলেছেন কিছু বুদ্ধিজীবী। আর সেই সঙ্গে সহস্র প্রশ্ন।
এক শ্রেণির মানুষরা সোশ্যাল মেডিয়ায় হাড়জ্বালানি এমনসব মন্তব্য করেন কেন? ফেসবুক- স্যাবিদের বেশিরভাগেরই মত, খিস্তি খেতে ভালবাসেন বলে? এমনটা যে তাঁরা জেনেশুনেই করেন, তাতে সন্দেহ নেই। আর বিদ্বজ্জনদের বেলায় তো একথা একশো এক পার্সেন্ট(!) খাঁটি। কারণ শিল্প সংস্কৃতির বাজারে এমনটা চলতেই থাকে। নিজের বাজারে মন্দার ছোঁয়া লাগলেই হলো। স্বনামধন্যদের তাক করে, উদ্ভট কিছু মন্তব্য ছুঁড়ে দেওয়া। সাধারণ মানুষ যা বলছেন, তার বিপরীত স্রোতে কথা ভাসিয়ে দেওয়া। লক্ষ্য একটাই, সাধারণের নজর কাড়া। বাজার গরম করা। আর এটা তাঁদের পেশারই অঙ্গ। প্রচারের আলোয় প্রত্যাবর্তনের, এও এক বহু পুরনো কৌশল।
মনোবিদদের মতে, কিছু মানুষ আছেন যাঁরা অন্যের কদর বেড়ে উঠতে দেখলেই এক অজানা আতঙ্কে ভুগতে থাকেন। ভুগতে শুরু করেন এক কল্পিত নিরাপত্তাহীনতায়। এমনকি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যায় তাঁদের গোটা অস্তিত্বটাই।
এই হীনমন্যতা থেকেই তাঁরা সবার মনোযোগ কাড়তে চান। নিজেদের অক্ষমতা ঢাকা দিতে আপ্রাণ চেষ্টা চালান, জনপ্রিয় মানুষদের খাটো করে দেখাতে।
আবার যেহেতু এঁরা বুদ্ধিমান, তাই অনেক সময় বাঁকা রাস্তাও নেন। এড়িয়ে যান সরাসরি নিন্দা বা খিস্তি- খাস্তা করার অতি পরিচিত রাস্তা। তার বদলে প্রশ্নের পর প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে থাকেন। এটা কী, ওটা কেন, জাতীয় সব প্রশ্ন। প্রশ্নে জেরবার করে তুলতে পারাতেই এঁদের মোক্ষলাভ।
খেয়াল করে দেখবেন, এরা অধিকাংশই কিন্তু তথাকথিত শিক্ষিত। তবে যেসব বিষয়ে এঁরা যেধরনের মন্তব্য করেন তাতে অনেক সময়েই স্পষ্ট হয়ে ওঠে, ওই বিষয়ের সঙ্গে তাঁদের সামান্যতম যোগাযোগ নেই। আবার যোগাযোগ থাকলেও, দুষ্টেরও তর্ক আছে। আর আছে অসার, যুক্তিহীন কিছু মন্তব্য।
এখনকার হিট ইস্যু ইসরো'র চন্দ্র অভিযান। আর ওই সূত্র ধরেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে কতটা হেয় করা যায় তারই অপচেষ্টা চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ। শুধু মোদির ওপর আক্রমণ হলে নাহয় বোঝা যেত, গোটাটাই রাজনৈতিক। কারণ বাংলার বিদ্বজ্জনরা অধিকাংশই রাজনীতির রংয়ে চোবানো। মহাকরণ, নবান্নের সুরে সুর মিলিয়েই চলা। এই গুণীজনেরা থেমে থাকেন না। গতিশীল। বিবর্তনের রথে চেপে এঁরাও ক্ষমতার অলিন্দে আনাগোনা করেন। আজ এই শিবিরে, তো কাল ওই শিবিরে। লাল থেকে নীল। সুযোগ বুঝে গেরুয়া হয়ে যেতেও সময় লাগবে না। ভীষনরকম চোখের পর্দাওঠানো গতিশীল। এঁদের যাত্রাপথ নাকি প্রগতির দিকে। তাই নিজেদের এঁরা যথার্থই প্রগতিবাদী বলেন।
কিন্তু এই প্রগতিবাদী বিদ্বজ্জনদের নিশানায় যে শুধু মোদি তা নয়। মোদিকে টার্গেট করতে গিয়ে, ইসরোচিফকেও জড়িয়ে ফেলেন অনায়াসে। বাস্তবে কিন্তু মোদি, শিবন, ঐশী অজুহাত মাত্র। তাঁদের গালমন্দ করে, প্রচারের আলো নিজেদের দিকে ঘোরানোই মূল এবং একমাত্র উদ্দেশ্য। আর সাধারণ কূলহীন সমালোচকরা মরীয়া হন, সমাজে যতটা সম্ভব নিজেদের গুরুত্ব প্রমাণের চেষ্টায়। "আমরাও কারও থেকে কম যাই না!"
ক্ষমতার ভরকেন্দ্র থেকে ছিটকে যান অনেক বিদ্বজ্জনরাই। লাভের গুড়প্রাপ্তিটা ঠিক প্রত্যাশা মতো হওয়ার আগেভাগেই। ঠারেঠোরে এঁরা নিজেরাই নিজেদের পরিচয় দেন নিরপেক্ষ, জেহাদি টাইপের কিছু বলে। আর মূলত এঁরাই বাজারে টিকে থাকতে নিয়মিত গরমাগরম মন্তব্য করে থাকেন।
যতো বেপরোয়া মন্তব্য, তত খিস্তি। তত বাজার গরম। আর কিছু মানুষ তৈরিই থাকেন। সঙ্গে সঙ্গেই তেড়েফুঁড়ে লাগেন এই জেহাদি প্রজাতির বিদ্বজ্জনদের শায়েস্তা করতে। শিল্প সংস্কৃতির সঙ্গে যাঁরা জড়িয়ে তাঁরাই জানেনে, নেগেটিভ পাবলিসিটির অবদানও কিন্তু মারাত্মক। সাধারণ মানুষ আমরা যাকে বলি, 'নুইসেন্স ভ্যালু'।
এই সূত্র ধরেই নিজেকে পাবলিকের কাছে তুলে ধরেন অনেকেই। 'চোখে আঙুল দাদা, দিদি'দের ভিড় নেহাত মন্দ নয় সোশ্যাল মেডিয়ায়। এই বিদ্বজ্জনদের বাক্যবাণ সবসময়ই কোনও নেতা, মন্ত্রী, অথবা গুণীজনের দিকে তাক করা।
"শয়তানও মেধাবী," বলেছিলেন আমাদের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি ডক্টর এপিজে আবদুল কালাম। "কিন্তু সততা ও ব্যক্তিত্ব না থাকলে, সে ঘৃণিত!"
কিন্তু কেন এই নচ্ছার ধরনের মানসিকতা? যেখানেই যা কিছু হোক, সবসময়ই বিরূপ মন্তব্য। অনেকেই প্রশ্ন তোলেন গুণীজনদের আক্রমণের সময় নির্বাচন, সীমা- পরিসীমার জ্ঞান নিয়ে। অভিযোগ, রাজনৈতিক আক্রমণ করতে গিয়ে, অনেক সময়েই তা কার্যত হয়ে দাঁড়ায় রাষ্ট্রবিরোধী। ইসরোর চেয়ারম্যানের পূজাপাঠ করা নিয়ে আক্রমণ করতে গিয়ে, প্রশ্নচিহ্নের মুখে ঠেলে দেন দেশের ধর্মনিরপেক্ষতাকে।
এই দুষ্ট মানসিকতা তৈরির দায় নিতে হবে সরকারকেই, এমনটাই মনে করেন নির্দিষ্ট এক বুদ্ধিজীবী মহল। কেন? কারণ ভারতীয়দের জাতীয়তাবাদের বোধ গড়ে তোলার কাজটা কখনও, কোনও শাসক দল করেনি।
বরং সরকারি যন্ত্রের ঘাড়ে চেপে শাসকরা তাঁদের নিজেদের দলের ভাবমূর্তি ছড়ানোর কসরত চালান এমনটাও অভিযোগ উঠেছে সহস্রবার।
সরকারি স্কুল থেকে নিয়ে হাসপাতাল, দুটোই যেন অগতির গতি। খোদ শিক্ষামন্ত্রীর সন্তানরাও কি সরকারি প্রাথমিক স্কুলে পড়ে? আর জেল খাটতে গিয়ে অসুস্থ(!) হয়ে পড়লে, মন্ত্রীরা তবেই সাধারণত সরকারি হাসপাতালের আশ্রয়ে যান। সব দেখেশুনে সতর্ক হয়ে গেছেন জনসাধারণ।
আবার দূরদর্শন থেকে দূরসঞ্চার সেখানেও একইরকম দৈণদশা। সরকারি কারখানা মানেই বেসরকারিকরণের অপেক্ষায়। আর যতটা চলছে তাও ধুকতে ধুকতে। সমালোচনার পাহাড় ডিঙিয়ে। মোটকথা, যা কিছুই সরকারি মালিকানায়, পরিচালনায়, তার কোনটারই গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখতে পারেনি রাষ্ট্রযন্ত্র। এমনকি বারেবারে প্রশ্ন ওঠে খোদ রাষ্ট্রযন্ত্রের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েই। শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রবাদ, জাতীয়তাবাদের সূক্ষ্ম লক্ষণরেখা মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়াতেই বিপত্তি। রাষ্ট্রের বিরোধিতা হয়ে দাঁড়ায় জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা। মুশকিল এখানেই।
অনেকেই হয়ত নিজের অজান্তেই এই ভুল করে বসেন। তবে সোশ্যাল মেডিয়ায় জরুরি কোনও বিষয় নিয়ে মন্তব্য করার আগে, আরও একবার ভেবে দেখবেন প্লিজ, এমনটাই মত অনেকের।
তারপর ঠিক করুন, এনআরসি'র জন্য ঠিক কতটা দুরমুস করবেন মোদি সরকারকে।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours