মৌসুমী পারুই, লেখিকা, ব্যাঙ্গালোর:

যুগ থেকে যুগান্ত পেরিয়ে কবে কবে যেন আমরা আধুনিক হয়ে গেছি । নিজেদের আধুনিক মানুষ বলতে বা ভাবতে আমরা গর্ব বোধ করি । সেই গ্যাস স্টোভ , টেলিভিশন ....থেকে স্মার্ট ফোন এবং সোস্যাল মিডিয়ার যুগে এসে যখন পেছনে ফিরে তাকাই তখন মন বলে যান্ত্রিক অগ্রগতি ছাড়া আসলেই কি আমরা প্রচীনের থেকে খুব বেশি এগোতে পেরেছি ! আর পারলেও কতটুকু!

পেরোতে পেরেছি কি তাঁদের চিন্তাধারা আর তার কর্মময় জীবনে প্রয়োগের মানসিকতা কে তত শুষ্ঠ সুন্দর ভাবে  আমাদের জীবনে? না পারিনি । হয়তো পারবও না সবক্ষেত্রে ।
আমরা তাকেই নিয়ে গেছি আধুনিকতার পরকাষ্ঠে বিকৃতির পথে , কিন্তু তা প্রচীনের মত নির্মল সুন্দর রইল না আর , কারণ প্রাচীন যা কিছু ছিলো তার মধ্যে অনেক কিছু ছিলো তাদের সুসংহত গভীর ভাবনা চিন্তার ফসল । যার রুপ যুগান্ত বা কালান্ত পেরিয়ে বদলে গেলেও জায়গাটা আজও একই আছে যেখান থেকে তার নিবারণের পথ খোঁজা ছিলো । আমরা সেই পথ খুঁজতে গিয়ে অবিবেচক নিষ্ঠুর আর নির্দয় হয়ে উঠেছি।

প্রাচীন কালে মানব জীবন কে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছিল । ব্রক্ষচর্য , গার্হস্থ্য , বানপ্রস্থ আর সন্যাস । কাদের জন্য বা কারা এই ভাগে সীমাবদ্ধ ছিলো ইতিহাসের এত বিস্তৃতি তে না গিয়ে শুধু এটুকুই মন বলে যা ছিলো বা যা করা হয়েছিল হয়তো সেটাই ভালো ছিলো । জায়গা ছেড়ে দেয়াই হয়তো  মঙ্গল বোঝা হওয়ার আগেই। 

পুরোনোর সঙ্গে নতুনের মেলবন্ধন করতে হলে হয় পুরোনোকে নতুনের সম্পূর্ণটুকু গ্রহণ করতে হয় আর না হলে নতুন কে পুরোনোতে আস্হা  শ্রদ্ধা আর বিশ্বাস  রাখতে হয়। 

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা বড় কঠিন হয়ে পড়ে।
এই মানিয়ে নেয়া বা মিলিয়ে নেয়া যখনই সম্ভব হয়না তখনই দূরত্ব বাড়তে থাকে । প্রচীন কালের মানুষ জীবন সত্য হিসেবে এই চরম বোধের উপলব্ধি করেছিলেন বলেই হয়তো তারা জীবনে বানপ্রস্থ আর সন্যাসের মত দুটো ভাগের প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন।

এ ছিলো জায়গা স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিয়ে অধিকার মুক্ত হয়ে অন্যের হাতে সম্পূর্ণটুকু তুলে দিয়ে ঈশ্বর চিন্তায় নিজেদের নিমজ্জিত করে দেয়া । তাতে দুপক্ষেই শান্তি আর স্বস্হি ছিলো হয়তো। না ছিলো নতুনদের পুরাতনকে বোঝা ভাবার অবকাশ আর না ছিলো পুরাতনের নতুনদের ওপর ভার হওয়ার প্রকাশ।

আজ যখন শহরের পাড়ায় পাড়ায় , অলিতে গলিতে বৃদ্ধাশ্রমগুলো দেখি তখন মন বলে এ তো বানপ্রস্থ আর সন্যাসেরই আরেক বিকৃত রুপ যেখানে যেতে বাধ্য করি আমরা , নতুন প্রজন্ম , আমাদের বাবা মা , শ্বশুর শাশুড়ি সকলকে সেখানে পাঠানোর দায়িত্ব পালন করে।

হ্যাঁ এটাও একপ্রকার দায়িত্ব আর কর্তব্য পালনই আমাদের । যারা পরিবার ঘর সংসার , ছেলে বৌ নাতি নাতনীর আর আজন্মের বসত বাড়ির মায়া ছেড়ে কোথাও যেতে চাননা ,  তারা দিনপ্রতিদিন তাদের বয়সের সঙ্গে সঙ্গে দিন শেষ হয়ে আসার আভাস পান , আমরা তাদের জোরজবরদস্তি বুঝিয়ে ছাড়ি তারা সেখানেই ভালো থাকবেন।

সমময়সী আরো সঙ্গ পাবেন। ডাক্তার থেকে খাওয়া দাওয়া সব পাবেন । আর কি চাই ভালো থাকার জন্য। কিন্তু আদৌ তাঁরা সেখানে ভালো থাকেন তো!

সেটুকু জানার বা তাঁদের মনের অবস্হা জানার প্রয়োজনও আমাদের হয়না । সময় মত নিয়ম মাফিক নয় মাসে , ছয় মাসে একটু দেখা করে আসাই যথেষ্ট মনে হয় আমাদের । এত ব্যস্ততাময় জীবনে আর কি দরকার!

আর যারা বৃদ্ধাশ্রমে যান না , যাদের বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়ার বা যাদের রাখার সামর্থ্য থাক না শারীরিক ভাবে অসমর্থ্য হতে হতেই তারা বাড়িতেও বোঝা হয়ে ওঠেন । কবে তারা তাঁদের জায়গা ছেড়ে চিরতরে চলে যাবেন সেই দিনগোনাও চলে কোথাও কোথাও।

বয়স হলে মানুষ একটু কথা বলতে ভালোবাসে। শিশুর মত আদর ভালোবাসা সঙ্গ চায় । অনেকের শিশুর মতই নানারকম খাওয়ার ইচ্ছে বেড়ে যায় । অনেকেই এ সময়ে এসে তাদের আজীবনের জীবন সঙ্গী বা সঙ্গীনী কে চিরতরে হারিয়ে একা হয়ে যান । স্বামী বা স্ত্রী থাকেননা অনেকের একটু মনের কথা বলার মত । তার সাথে সুগার প্রেসার ছানি থেকে হাজার রোগ বাহিত শরীর নিয়ে এদের আর বোঝা ভাবা ছাড়া আমাদের কতটুকু আন্তরিকতা বা শ্রদ্ধাবোধ থাকে ! কতটুকু আমারা আন্তরিক ভাবে করি এদের জন্য দায়ে পড়ে বা বাধ্য না হয়ে করা ছাড়া!

মাঝেমাঝে এই বর্তমান সামাজিক আধুনিকার যুগে বৃদ্ধাবস্হার চিত্রগুলো দেখতে দেখতে মন বলে বড় ভালো ছিলো জীবনে বানপ্রস্থ আর সন্যাসের মত সময়গুলো তাদের স্বেচ্ছায় বেছে নেয়া । ভার হওয়ার আগেই ভারমুক্ত করে চলে যাওয়া । তাতে অন্ততঃ দিনপ্রতিদিন অবহেলার জীবন যাপন করতে হতনা তাঁদের।

কিন্তু আধুনিক সভ্যতা তার সর্বগ্রাসী খুদায় তপোবন থেকে জঙ্গল , সমস্ত বনভূমি কেটে নিয়েছে । আজ শান্তিতে নির্জনে বাকি জীবন অতিবাহিত করার মত কোনো তপোবনে বা আশ্রম নেই আর তাদের জন্য।

শুধু পড়ে থাকে বৃদ্ধাশ্রমের খুপরী খুপরী ঘর আর জেলবন্দী জীবন ভবিষ্যতে আমাদেরও প্রতীক্ষায়।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours