ব্রহ্মচারী শুভ্র, রামকৃষ্ণ আশ্রম কলকাতাঃ 
এবার শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবের আবির্ভাব ঐশ্বর্যবিহীন ভাবে। তাঁর শক্তি সারদাদেবীও আজীবন ছিলেন অবগুন্ঠিতা। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের মত তিনিও এবার ছদ্মবেশে এসেছিলেন। জগন্মাতা এসেছিলেন দরিদ্র ব্রাহ্মনের দুহিতা হয়ে সঙ্গোপনে স্বীয় স্বরুপ ঢেকে। তাঁর স্বামীর তবুও ঈশ্বরীয় ভাবাবেশ হতো কিন্তু তিনি ঈছিলেন সম্পূর্ণ ভাবে ঐশ্বর্যবিহীণা রূপে। অনেকেই এমনকি ঠাকুরের বিশেষ ভক্তদের মধ্যে অনেকেই শ্রীশ্রীমায়ের স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারেন নি। তিনি কখনও পাহাড়-পর্বতে তপস্যা করতে যাননি, বই লেখেননি কিম্বা বক্তৃতাও দেন নি। ত্যাগী শিষ্যদের সাথেও সামনা সামনি কথা পর্যন্ত বলেননি, অথচ লোকচক্ষুর আড়ালে এক সুমহান আদর্শ জগতের জন্য রেখে গেছেন।

ছোট ছোট দু একটি কথা ও কাজের মাধ্যমে শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর লীলা সঙ্গিনীর স্বরূপ প্রকাশ করেছেন। স্থুল ও সূক্ষ্ম দেহে বিভিন্ন জনের কাছে শ্রীশ্রীঠাকুর মায়ের দিব্যতা ও স্বরূপ প্রকাশ করেছেন।

সারদাদেবী সম্বন্ধে ঠাকুর বলেছেন – “ও (শ্রীমা) সারদা-সরস্বতী-জ্ঞান দিতে এসেছে।রূপ থাকলে পাছে অশুদ্ধ মনে দেখে লোকের অকল্যান হয়,তাই এবার রূপ ঢেকে এসেছে।“
“ও জ্ঞানদায়িনী, মহা বুদ্ধিমতী! ও কি যে সে ? ও আমার শক্তি।“ আবার কখনও ইঙ্গিত করে বলেছেন “আমি কি আর লাউশাক-খাকী, পুঁইশাক-খাকীকে বে করেছি?”
শ্রীশ্রীঠাকুর শ্রীশ্রীমা সম্বন্ধে বলেছিলেন ‘ও আমার শক্তি’। সাধারনতঃ বিবাহিত পত্নীকে কে শক্তি বলা হয়। কিন্তু শ্রীশ্রীঠাকুর এক বিশেষ অর্থে এই শক্তি শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তিনি ‘ব্রহ্ম ও শক্তির’ কথা বলেছেন। শ্রীশ্রীঠাকুর স্বয়ং ভগবাঞ্জীব কল্যানের জন্য নরদেহ ধারণ করে এসেছেন, আর সারদাদেবী আদ্যাশক্তি দেবী ভগবতী যুগাবতারের মানবলীলার পুষ্টিসাধনের জন্য মর্তধামে এসেছেন।
ঠাকুর মাকে সীতা ও রাধা বলে ইঙ্গিত করেহিলেন। সাধনার সময় মা সীতার দর্শন কালে মা সীতাকে ‘ডায়মন কাটা’ বালা পরিহিত দেখে পরবর্ত্তীকালে  শ্রীশ্রীমায়ের জন্যেও ওইরকম বালা তৈরী করিয়ে কৌতুক করে বলেছিলেন “আমার সঙ্গে ওর এই সম্পর্ক।“
ঈশ্বর কখনও একা পৃথিবীতে আসেন না, তিনি তাঁর সাথে স্বীয় শক্তিকেও নিয়ে আসেন। অগ্নি ও তার দাহিকা শক্তির মতই তাঁদের জন্ম জন্মান্তরের সম্বন্ধ। স্বামী শিবানন্দজীকে একদিন ঠাকুর বলেছিলেন “ওই যে মন্দিরে মা রয়েছেন (ভবতারিনী) আর এই নহবতের মা (সারদাদেবী) অভেদ।“
কামারপুকুরে একদিন রাতে পাড়ার মেয়েদের কাছে গদাধর নানা ঈশ্বরীয় তত্ত্বকথা বলছিলেন। এদিকে মা সারদা গুমিয়ে পরেছেন। মেয়েরা তাঁকে তুলতে গেলে তিনি বারণ করে বললেন – “ না গো না , ওকে তুলোনা। ও কি সাধে ঘুমোচ্ছে? এসব কথা শুনলে ও এখানে থাকবে না  -- চোঁচাঁ দৌড় মারবে ।“সারদাদেবী কে তা ঠাকুর জানতেন। তিনি জানতেন যে স্বয়ং জগন্মাতাই মানবীরূপে সারদাদেবীর শরীর অবলম্বনে এদেছেন। তাই নিজের স্বরূপ্ -তত্ত্ব শুনলে সারদাদেবী একেবারে সমাধিতে লীন হয়ে যাবেন।তাই তিনি মাকে ঘুম থেকে তুলতে না নরেন। 
আর একবার শ্রীশ্রীমা ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করেন যে “ আমাকে তোমার কি বলে মনে হয়?” উত্তরে ঠাকুর বলেন – “ যে মা মন্দিরে আছেন, তিনিই এই শরীরের জন্ম দিয়েছেন ও এখন নহবতে বাস করছেন আর তিনিই এখন আমার পদসেবা করছেন।“ দক্ষিণেশ্বরে সুদীর্ঘ আট মাস ঠাকুর ও শ্রীমা একসাথে বাস করেছিলেন। কিন্তু এই সুদীর্ঘ আট মাসে শ্রীশ্রীঠাকুর কখনও শ্রীশ্রীমায়ের মধ্যে দেহবুদ্ধির প্রকাশ লক্ষ্য করেন নি। তাই পবিত্রতা স্বরূপিনী সারদাদেবীর মহিমার কথা দ্ব্যর্থহীণ ভাষায় প্রকাশ করে বলেছেন—” ও (শ্রীমা) যদি এত ভাল না হত, আত্মহারা হয়ে তখন আমাকে আক্রমন করত, তাহলে সংযমের বাঁধ ভেঙ্গে দেহবুদ্ধি আসতো কিনা কে বলতে পারে?” স্বামী বিবেকানন্দ যাঁকে ত্যাগীশ্বর বলেছেন, তাঁর এই উক্তি কততা তাৎপর্যপূর্ণ তা বলবার অপেক্ষা রাখে না ।
একবার শ্রদ্ধেয়া যোগীন মায়ের মনে শ্রীশ্রীমা সম্বন্ধে সন্দেহের উদ্রেক হয়। তিনি ভেবেছিলেন ঠাকুর কত ত্যাগী আর মাকে দেখছি ঘোরতর সংসারী। এই সংশয় নিয়ে তিনি একদিন গঙ্গাতীরে জপ করছিলেন। তখন শ্রীশ্রীঠাকুর তার সামনে সূক্ষ্ম দেহে উপস্থিত হয়ে  গঙ্গার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন “দেখ, গঙ্গায় কি ভাসছে?” যোগীনমা দেখলেন নাড়িভুঁড়ি জড়ান একটি সদ্যজাত শিশু ভাসছে। তা দেখিয়ে ঠাকুর বললেন “ গঙ্গা কি কখনও অপবিত্র হয়? না তাঁকে কিছু স্পর্শ করে? ওকে আর একে (নিজেকে দেখিয়ে) অভেদ জানবে।“
ঠাকুর তাঁর সহধর্মিনীর প্রকৃত পরিচয় জানতেন বলে সর্বদা তাঁর প্রতি সম্ভ্রম প্রদর্শন করেছেন। ঠাকুরের কাছে যে সব ফল মিষ্টি আসত তা তিনি শ্রীশ্রীমায়ের কাছে নহবতে পাঠিয়ে দিতেন। শ্রীমা সেসব কিছু অকাতরে বিলিয়ে দিতেন বলে একদিন অনুযোগের সুরে বলেন “ এত খরচ করলে কিভাবে চলবে?” একথা শুনে শ্রীশ্রীমাকে নীরবে চলে যেতে দেখে ব্যস্ত হয়ে ভাইপো রামলালকে ডেকে বললেন “ ওরে রামলাল, যা তোর খুড়িকে গিয়ে শান্ত কর। ও রাগ করলে (নিজেকে দেখিয়ে) এর সব নষ্ট হয়ে যাবে।“
শ্রীশ্রীমা বলেছিলেন “ তিনি কখনও আমাকে তুই পর্যন্ত বলেন নি”। একবার দক্ষিণেশ্বরে ভাইঝি লক্ষ্মী ভেবে তুই বলে ফেলে সারারাত ঘুমোতে পারেননি, অপরাধ বোধে ভুগেছেন। পরেরদিন নহবতের সামনে গিয়ে বলেন “ দেখ গো, সারারাত আমার ঘুম হয়নি ভেবে ভেবে- কেন এমন রূঢ় বাক্য বলে ফেললুম।“ শ্রীমা বলেছেন – “ আহা ! তিনি আমার সঙ্গে কি ব্যবহারই করতেন ! একদিনও মনে ব্যথা পাবার মতো কিছু বলেন নি। কখনও ফুলটি দিয়েও ঘা দেননি। 
শ্রীশ্রীঠাকুর শ্রীমায়ের প্রকৃত স্বরূপ জানতেন, তাই, নিজে স্বয়ং ঈশ্বররূপে  পূজিত হলেও ও ঈশ্বরীয় ভাবে অধিকাংশ সময় বিভোর থাকলেও সর্বদা শ্রীশ্রীমায়ের প্রতি তাঁর সম্ভ্রম প্রকাশ পেত ও অন্যেরাও  যাতে শ্রীশ্রীমায়ের অশ্রদ্ধা বা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য না করে সে বিষয়েও সচেতন থাকতেন। কারণ জগতের আধারভূতা আদ্যাশক্তিকে যে অশ্রদ্ধা করে তার সামুহিক বিপর্যয় অনিবার্য্য।
দক্ষিণেশ্বরে হৃদয় শ্রীশ্রীমাকে সদা সর্বদা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে দেখে ঠাকুর তাকে সাবধান করে বলেছিলেন—“ওরে হৃদে, একে (নিজেকে দেখিয়ে) তুই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলিস বলে ওকে (শ্রীশ্রীমাকে দেখিয়ে) আর কখনও এমন কথা বলিসনি, এর ভেওর যে আছে সে ফোঁস করলে হয়তো রক্ষা পেলেও পেতে পারিস; কিন্তু ওর ভেতরে যে আছে, সে ফোঁস করলে তোকে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরও রক্ষা করতে পারবেন না।“
আর একবার ঠাকুরের শ্যামপুকুরে থাকা কালে গোলাপ মাকথায় কথায় যোগীণ মাকে বোলেছীলেণ “দেখ যোগেন, ঠাকুর বোধহয় মার উপর রাগ করে কলকাতা চলে গেছেন।“ যোগেন্ মার কাছে এই কথা শুনে শ্রীশ্রীমা কলকাতায় ঠাকুরের কাছে গিয়ে কেঁদে বললেন “ তুমি নাকি আমার উপর রাগ করে চলে এসেছ?” ঠাকুর বললেন “না, কে তোমায় এ কথা বলেছে?” মা বললেন “গোলাপ বলেছে।“
তখন ঠাকুর রেগে গিয়ে বললেন “ সে এমন কথা বলে তোমায় কাঁদিয়েছে? সে জানেনা তুমি কে? গোলাপ কোথায়? আসুক না?” শ্রীশ্রীমা শান্ত হয়ে দক্ষিণেশ্বরে ফিরে এলেন। পরে একদিন গোলাপ মা ঠাকুরের কাছে এলে তিনি তাকে খুব ভর্ৎসনা করে বললেন—” তুমি কি কথা বলে ওকে কাঁদিয়েছ? জান না ও কে?এক্ষুনি গিয়ে তাঁর কাছে ক্ষমা চাওগে।“
অন্য একদিন ঠাকুর বলেছিলেন “ নহবতে যে আছে সে যদি কোন কারণে কারও উপর বিরূপ হয়তো তাকে রক্ষা করা আমারও সাধ্যাতীত।“
দক্ষিণেশ্বরে একদিন লাটু মহারাজকে(স্বামী অদ্ভুতানন্দ)ধ্যান করতে দেখে ঠাকুর তাঁকে বলেন—” আরে , তুই যাঁর ধ্যান কচ্ছিস, তিনি তো নবতে ময়দা ঠেসছেন,” অন্য একদিন লাটু মহারাজ কে বলেন “ দ্যাখ, এখন থেকে যে কোন জিনিষ আসবে,সব নহবতে এনে দেখাবি,তারপর সবাইকে দিবি” এর কারণ ব্যখ্যা ওরে লাটু মহারাজ বলেন যে জিনিষ গুলোর দোষ কাটাবার জন্যে তিনি মায়ের কাছে নহবতে পাঠাতে বলেছেন। যোগীন মার স্মৃতি অনুসারে সেদিন ঠাকুর লাটু মহারাজকে বলেছিলেন “দ্যাখ, যে যা জিনিসপাতি আনে সব ওকে (শ্রীমাকে)  দেখাবি জানাবি। নইলে তাদের উদ্ধার কেমন করে হবে।“ আবার একদিন যোগীন কে (স্বামী যোগানন্দ) ঠাকুর নহবতে এনে শ্রীমাকে দেখিয়ে বলেন ঃ- “ওর চরণ ধরে পড়ে থাক, অখানে তোর সব হবে।“
শ্রীশ্রীমাকে তাঁর দৈবী সত্ত্বা ও স্বরূপ মনে করিয়ে দেবার জন্য ও স্বীয় অসমাপ্ত কাজের ভার তাঁর উপর অর্পন করবার জন্য শ্রীশ্রীমায়ের দক্ষিণেশ্বরে আসার প্রথম দিন থেকেই তিনি তাঁর লীলাস্পম্পুরণকর্ত্রীকে অন্তরের পূজা নিবেদন করে জগতে প্রতিষ্ঠিত করবার প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন। সেই প্রয়োজনই চরিতার্থতা লাভ কএ ষোড়শী পূজার মাধ্যমে।এর ফলে শ্রীশ্রীমা প্রতিষ্ঠিত হন বিশ্ব মাতৃত্বের বেদীতে। যে মহাশক্তি শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের সহধর্মিনী রূপে এই জগতে এসেছিলেন সে মহাশক্তির আনুষ্ঠানিক উদবোধনের প্রয়োজন ছিল—তাই ষোড়শী পূজার সময় শ্রীশ্রীমা কে দেবীর আসনে বসিয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর প্রার্থনা মন্ত্র উচ্চারণ করেন – “ হে বালে, হে সর্বশক্তির অধীশ্বরী মাতঃ ত্রিপুরাসুন্দরি, সিদ্ধিদ্বার উন্মুক্ত কর, ইহার  (শ্রীশ্রীমা) শরীর মনকে পবিত্র করিয়া ইহাতে আবির্ভূত হইয়া সর্বকল্যান সাধন কর।“ পূজাশেষে দেবীর চরণে , নিজেকে, নিজের এত বছরের সাধনার ফল ও জপমালা চিরদিনের জন্য সমর্পণ করেছিলেন। শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণের দৃষ্টিতে শ্রীশ্রীসারদাদেবীর কি স্থান ছিল ষোড়শীপূজাই এ বিষয়ে শেষ কথা।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

2 comments so far,Add yours

  1. আপনি যদি ক্রমাগত অস্ত্র সংগ্রহ করে সেগুলিকে শাণাতে থাকেন, তাহলে বুঝতে হবে নিশ্চয় আপনার এমন শত্রু আছে যার বিরুদ্ধে ঐগুলি প্রয়ােগ করার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন আপনি।

    ReplyDelete
  2. Thanks For Sharing The Amazing content. I Will also share it with my friends. Great Content thanks a lot. Please visit
    DoFollow

    ReplyDelete