Bollywood a Amitav
কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

বরাবরই অন্যদের থেকে মাথাটা একটু বেশি উঁচু।

মঙ্গলবার থেকে সেই উচ্চতা আরও অনেকটা বেড়ে গেল। তাও একলাফে।

বলিউডের স্টুডিও পাড়ায় তাঁর আদরের নাম 'লম্বু'। এতদিনে সেদিনের সেই লম্বুই পৌঁছে গেলেন স্বীকৃতির শেষ ধাপে। এবছরেই পঞ্চাশ বছরের ফিল্মিসফর পুরো করলেন তিনি।

অমিতাভ বচ্চন। ভারতীয় সিনেমার 'বিগ বি'। ২০১৮ সালের 'দাদাসাহেব ফালকে' পুরস্কার তুলে দেওয়া হবে তাঁর হাতে। মঙ্গলবার ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের সর্বোচ্চ সম্মানের জন্য, অমিতাভ বচ্চনের নাম ঘোষণা হতেই একেবারে হইচই ব্যাপার।

ছিয়াত্তুরে স্বপ্নপূরণ। সিনেমা জগতের সবাই মনে মনে স্বপ্ন দেখেন ওই পুরস্কারের। পান ভাগ্যবানেরাই।

খেললেন বটে 'লাল বাদশাহ'। তবে দ্বিতীয় ইনিংসটাই সেরা। তখন কোনঠাসা অমিতাভ। অসুস্থতা, দেনার দায়, সবমিলিয়ে পরিস্থিতির দারুণ মার। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছিলো বলিউডের 'ডন'- এর। ঠিক তখনই জ্বলে উঠেছিলেন যেন আচমকাই।

"বনাকে কিঁউ বিগাড়া রে!" উপরওয়ালার কাছে আর্তি করেছিলেন জয়া ভাদুড়ি। অমিতাভ জয়ার জুটি ওই প্রথম সবার নজর কাড়লো। তার দু'বছর আগেই অবশ্য ১৯৭১ সালে ওই জুটির 'বৈজুবাওড়া' রিলিজ করেছিলো। তবে সেভাবে হিট হয়নি। বক্স অফিস কাঁপালো প্রকাশ মেহরার 'জঞ্জির'। মধ্যে অনেক চড়াই- উতরাই থাকলেও জয়ার আর্তিতে সাড়া দিয়েছিলেন উপরওয়ালা। আজ হলপ করে সেটা বলা যায়। সফর শুরুটা মোটেই ভালো ছিলো না।

সাল ১৯৬৯। ফিল্ম 'সাত হিন্দুস্তানি'। পরিচালক খোয়াজা মহম্মদ আব্বাস পর্তুগিজদের কবল থেকে গোয়ার মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সিনেমা বানানোর জন্য সাতটি নতুন মুখ খুঁজছিলেন। কলকাতার চাকরি ছেড়ে মুম্বই ছোটেন অমিতাভ। আব্বাস বলেন, "এক শিখ আর এক মুসলিম, এই দুই চরিত্রের মধ্যে যে কোনও একটা অমিতাভকে বেছে নিতে বলি। ও বিহারের উর্দুভাষী মুসলিম শায়র আনোয়ার আলির চরিত্র বেছে নেয়।"

কিন্তু দর্শকদের মনে ধরেনি সেই সিনেমা। তবে রাষ্ট্রীয় অখন্ডতার বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য 'সাত হিন্দুস্তানি' জাতীয় পুরস্কার পায়। সিনেমায় হিন্দিতে অজ্ঞ আনোয়ার আলির মুখে ডায়লগ ছিলো- "হমকো হিন্দি কী অরন্তু- পরন্তু সমঝদার নহি আতি।"

পরে দেখা গেছিলো সব অরন্তু- পরন্তুই দিব্য বুঝতে পেরেছিলেন আনোয়ার আলিরূপী অমিতাভ বচ্চন। আর এর জন্য সময় লেগে ছিলো মাত্র চারবছর। ১৯৭৩ সালে 'জঞ্জির' রিলিজ হতেই, অমিতাভ পিটিয়ে খেলা শুরু করলেন তাঁর ফিল্মি ক্যারিয়ারের ফার্স্ট ইনিংস। একেবারে মারমুখী। অত ভালমন্দর বিচার নেই। আনন্দ, অভিমান, আলাপ, মঞ্জিল- এও চুটিয়ে অভিনয় করছেন। আবার শোলে, দিওয়ার, অমর আকবর অ্যান্থনি, নমকহলাল, ডনে নেচেকুঁদে দর্শক মাতাচ্ছেন।

সত্তর দশকের মাঝামাঝি থেকে আশি শতক, অমিতাভ মানেই হিট। তারপরেই হঠাত্ মাথায় বাজ ভেঙে পড়লো। 'কুলি' সিনেমার শুটিংয়ে মারাত্মক রকমের জখম হলেন বিগ বি। দীর্ঘদিন চিকিৎসকরা পর, সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরলেন ঠিকই, কিন্তু ছন্দপতন হয়ে গেল স্বাভাবিক জীবনে। চারদিক থেকে বিপদের রাহুগ্রাস। শরীর তখনও আগের মতো মজবুত না। হাতে সেরকম সিনেমা নেই, আর্থিকমন্দা, এমনকি দেনার দায়ে ঘরবাড়ি বিক্রি হতে বসলো।

"সেদিন আমার বিবেকই আমাকে সচল রেখেছিলো," এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন অমিতাভ। "বহুরাত ঘুমাইনি। একদিন সকালে যশ চোপড়ার বাড়ি গেলাম। খুলে বললাম সবকথা। ঠান্ডা মাথায় সব শুনলেন। তারপরেই 'মহব্বতে'র জন্য সাইন করালেন। ওদিকে বিজ্ঞাপনের কাজ শুরু করলাম। টেলিভিশনে এলাম। ধীরে ধীরে ঘাড় থেকে নব্বই কোটির দেনা নামালাম।"

অমিতাভের এই নয়া পর্বে, ভক্তদের আর সিনেমা হলে ছুটতে হলো না। অমিতাভ নিজেই হাজির হয়ে গেলেন ভক্তদের বেডরুম, ড্রয়িংরুমে। রাতটা ছিল ২০০০ সালের ৩ জুলাইয়ের। ঘড়িতে তখন ন'টা। টিভি'র পর্দায় ভেসে উঠলো অমিতাভ বচ্চনের মুখ। কানাঢাকা চুল গায়েব। চোখে উঠেছে চশমা। বয়সের সঙ্গে মানানসই মেকআপ। গ্ল্যামার বাড়াতে মুখে সাদা ফ্রেঞ্চ কাট। মুখে সৌজন্যের হাসি-  "নমস্কার। ম্যায় অমিতাভ বচ্চন বোল রহা হুঁ!" কৌন বনেগা ক্রোড়পতি। ফের মাতিয়ে দিলেন পরিণত বয়সের অমিতাভ। একেবারে মানানসই ফ্রেশ লুক। শুরু হলো এক নতুন সফর।

ছিলেন হিরো, নায়ক, হয়ে গেলেন অভিনেতা। ধুয়ে মুছে সাফ অ্যাঙ্গরি ইয়াং ম্যান ইমেজ।

নতুন শতাব্দির হাত ধরেই অমিতাভ এগিয়ে গেলেন তাঁর নতুন যাত্রাপথে। সে এক নতুন অমিতাভ বচ্চন। ২০০১ সাল। এক নেগেটিভ চরিত্রে বিগ বি কে দেখা গেলো 'অক্ষ' সিনেমায়। পরের বছর এলো জমজমাট এক নির্ভেজাল ফ্যামিলি ড্রামা 'বাগওয়ান'। ২০০৫ সালে এলো 'ব্ল্যাক'। এক অ্যালজাইমার্স পেশেন্টের ভূমিকায় তাক লাগিয়ে দিলেন অমিতাভ। ফের চমক, বাল থাকরের কেতায় 'সরকার'।

'চিনি কম', 'নিঃশব্দ'-এ ফিরে এলো সেই প্রেমিক। তবে অনস্ক্রিন পরিণত বয়সের এই প্রেমের পাগলামি অন্যরকম। কতই না শেড এই রোমান্টিসিজমের! প্রথম ইনিংসের 'সিলসিলা', 'নটবরলাল', 'লভ ইন গোয়া'র মতো বেশকিছু সিনেমায় গান গেয়েছিলেন তিনি। দ্বিতীয় ইনিংসেও গাইলেন 'বাগওয়ান', 'নিঃশব্দ'- এ। আবার ওদিকে ভালো ভূতের 'ভূতনাথ', 'পা', 'পিকু'তেও অসাধারণ অভিনয় করলেন তিনি।

দেখতে দেখতে দ্বিতীয় ইনিংসের বয়সও দু'দশক হতে চললো। আর দুই ইনিংস মিলে অভিনয় জীবনের হাফ সেঞ্চুরি। আজও দর্শক তাকিয়ে প্রবীণ বিগ বি'র দিকে।

এখনও তো অনেক বাকী।
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours