সুমিত তালুকদার, ফিচার রাইটার, উত্তর ২৪ পরগনা:
যত্রতত্র
শব্দটির প্রতি এখন জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার। যত্রতত্র অর্থাৎ যেখানে
সেখানে যা খুশি তাই করো, নিজের মনে করে ব্যবহার করো, প্রতিবাদ করা চলবে না।
বাধানিষেধের বালাই নেই। যেমন একসময় পানের পিক গুটখার রস নিক্ষেপ করা ছিল
গণতান্ত্রিক অধিকার। যত্রতত্র এই সরস সবর্ণ বর্জ্য নিক্ষেপ করা ছিল
মানবধর্ম, মৌলিক অধিকার। যত্রতত্র পানের পিকে রঞ্জিত করা, রঙ্গোলী সৃষ্টি
করা ছিল পথযাত্রীর শৈল্পিক কীর্তিস্বরূপ। টনক নড়েছিল দক্ষিণেশ্বর
স্কাইওয়ার্কের যত্রতত্র বর্জ্যচিহ্ন লক্ষ্য করে। তারপর সাময়িক বন্ধ,
জরিমানা। বর্তমানে আবার স্বধর্মে স্বপরিচয়ে ফিরেছে পানের পিক, গুটকার রসে
রঞ্জিত বিচিত্র বর্জ্যচিহ্ন। সম্প্রতি বাধ্য হয়ে দেবদেবীর মূর্তির টাইলস
বসিয়ে এই দুষ্কর্মের হাত থেকে রেহাই পেতে চাইছে। এছাড়া যত্রতত্র ‘Commit no
nuisance’ লিখে বা বোর্ড লাগিয়েও যখন মুক্তিলাভ অসম্ভব তরল বর্জ্যত্যাগী
দুষ্কৃতীদের তাণ্ডব থেকে তখন দেবদেবীর মূর্তি স্থাপনা বেশ কার্যকরী হতে
পারে। কেননা দেবশক্তির কাছে সরকারিশক্তি বরাবর নিষ্ক্রিয়। এছাড়া যত্রতত্র
আবর্জনা নিক্ষেপও আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। সকালবেলায় পৌরসভার ‘clean
city’ ছাপমারা গাড়ি এসে শ্যামের বাঁশি বাজালেও আমাদের টনক নড়ে না তেমন। বরং
প্লাস্টিক ব্যাগে ভরে বর্জ্য আবর্জনা যত্রতত্র নিক্ষেপ করার মধ্যে আমাদের
মন কুৎসিত আনন্দে নেচে ওঠে। এছাড়া যত্রতত্র কনডোমের প্যাকেট, ব্যবহৃত
ন্যাপকিন, মাছের আঁশ পেটা ভর্তি প্লাস্টিক ব্যাগ, মদের বোতল, কোকোকোলার
ক্যান নিক্ষেপ করার কুঅভ্যাস বদঅভ্যাস আজো আমরা পরিত্যাগ করতে পারি নি।
আসলে
‘যত্রতত্র’ শব্দটির মধ্যে যে অলিখিত স্বাধীনতা, স্বাধিকারবোধ তা উপভোগ
করতে চাই আমরা ভদ্রতার মুখোশ পরে। এ হোলো আমাদের এক বিকৃত রুচির পরিচয় যা
কিনা আমাদের আদিম বদভ্যাসের আধুনিক সংস্করণ। ভালো হোক বা মন্দ, উচিত হোক বা
অনুচিত যত্রতত্র মিশে থাকে গুণাগুণের বিভিন্ন বিচিত্র প্রকাশ।
ইদানিং
যত্রতত্র পার্লার, জিম, বুটিক, সেলুন, মুদিখানার দোকানের মতো অলিতে গলিতে
ছড়িয়ে আছে। শংসাপত্রের দরকার নেই, ডিগ্রি- ডিপ্লোমা চুলোয় থাক, ট্রেড
লাইসেন্স পরোয়া করি না- এমন ধান্দায় বাংলার মা- বোনেরা বৌদিরা আজ শশব্যস্ত।
গৃহবধূ থেকে বিজনেসওম্যান যত্রতত্র। বেকার স্বামীর সংসারে রোজগেরে গিন্নি।
আরও আছে। যত্রতত্র গানের দিদিমনির ছড়াছড়ি, সামান্য সা-রে-গা-মা-পা জ্ঞান
থাকলে, হারমোনিয়াম- এ আঙুল বোলাতে পাড়লেই যত্রতত্র রবীন্দ্র- নজরুল সংগীত
শিক্ষায়তনের বোর্ড ঝুলিয়ে দাও। তেলেভাজা শিল্পের মতোই সংগীত শিল্পেরও আজকাল
কদর। কি শিখল কারা শিখল সেসব যুক্তিতর্ক, পরীক্ষা – নিরীক্ষার পথে
সাধারণতঃ হাঁটেন না দিদিমণিরা। মাদুর পেতে বসে গেলেই হোলো। একাই চর্চায়
মেতেছে বেকার যুবক যুবতীরাও। প্রাইভেট টিউশনি তাই যত্রতত্র। বিদ্যালয়ের
শিক্ষকও স্যার প্রাইভেট টিউটরও স্যার। বিদ্যাদানে ভেদাভেদ, পদাধিকারের
পার্থক্য নেই। ‘যত্রতত্র’ তাই আজ সর্বজনীন ও অবাধ।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours