ABVPer michil
কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট: 


প্রত্যেক ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে।

যাদবপুরে যতই স্বতন্ত্র হোক না কেন, তার ক্যাম্পাসেও বিজ্ঞানের ওই নিয়ম প্রযোজ্য। তাতে অতিবিপ্লবী পড়ুয়ারা বা উপাচার্য যাই বলুন না কেন।
যাদবপুর ইউনিভার্সিটির বৃহস্পতিবারের গোটা ঘটনাকে দু'ভাগে ভাগ করে নেওয়া যাক- ক্রিয়া আর প্রতিক্রিয়া।
ঘটনার প্রথম ভাগে যা ঘটল তা নিশ্চয়ই 'ক্রিয়া'। তার জবাবে যা ঘটল, তা অবশ্যই 'প্রতিক্রিয়া'।

ঘটনার শুরু বাবুল সুপ্রিয়কে ঘেরাও করা নিয়ে। এরপর একে একে বেপরোয়া সব কান্ড ঘটিয়ে চললেন বামপন্থী, অতিবামপন্থী মেধাবীরা। পরে অবশ্য জানা গেল ওই মারমুখী পড়ুয়াদের মধ্যে মিশেছিলেন তৃণমূল ছাত্র পরিষদের কর্মী সদস্যরাও। এক কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রীর ওপর কিল চড় ঘুষি চুলের মুঠি ধরে টানাটানি। ছেঁড়া হলো তাঁর জামাও। সেবার ছিল 'হোক কলরব', এবার হলো 'গো ব্যাক'। কিন্তু ব্যাক হবেনটা কী ভাবে? ডাইনে বাঁয়ে আগে পিছে সর্বত্রই তো ছাত্র আর ছাত্রীরা। সেদিন পাক্কা ছ'ঘণ্টা কেটেছিলো এমনভাবেই। এখান থেকেই শুরু গন্ডগোলের। তার মানে এটাই 'ক্রিয়া'। যার (খল)নায়ক নিশ্চয়ই এক ও একমাত্র পড়ুয়ারা।

এরপরে আসি 'প্রতিক্রিয়া' প্রসঙ্গে।
আর এই প্রতিক্রিয়ার দায় কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়র। একজন মানুষকে লাগাতার হেনস্থা করা হবে, আর তিনি নির্লিপ্ত, নির্বিকার হয়ে প্রসন্ন বদনে সবকিছু সহ্য করে যাবেন, এরকম আশা করাটা সম্ভবত বাড়াবাড়ি। তবে আমরা সেদিন মেডিয়ার 'লাইভ টেলিকাস্ট'-এ যা দেখেছি, তাতে বাবুল কিন্তু কখনোই মারমুখী হয়ে ওঠেননি। বরং ছবিটা ছিলো উল্টো। "গায়ে হাত দেবে না," বহুবার বলতে দেখা গেছে বিধ্বস্ত বাবুলকে। তবু তাঁর দিকে বারেবারে রীতিমতো তেড়ে যেতে দেখা গেছে, নির্দিষ্ট কিছু মুখকে।
এরপরেই আবার বাবুলকে বলতে শোনা গেছে, "আরে ওই বেটে ছেলেটাকে গাইতে দাও। ও দারুণ গাইছে।" প্রেসের গাড়ির বনেটে বসে পড়ুয়াদের কোরাসে হাততালি দিয়ে চলেছেন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী। তখন ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না, কে কাকে ঘেরাও করে রেখেছে? সেই রাগী, বেপরোয়া মুখগুলি তখন তালে-বেতালে কোরাস গেয়ে চলেছে। কোথাও কোনও খিস্তিখাস্তা নেই। বুর্জোয়া, ফ্যাসিস্ট, গো ব্যাকের গর্জন নেই। যাদবপুর ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে তখন যেন সান্ধ্য সুরের আসর পড়ুয়াদের। একমাত্র শ্রোতা বাবুল সুপ্রিয়।

এখানেই কিন্তু 'ক্রিয়া', 'প্রতিক্রিয়া'র খেলা শেষ হয়ে যেতে পারতো। কিন্তু বাস্তবে পড়ুয়াদের সামনে রেখে বড়ের চাল দিয়ে চলেছিলেন পাকামাথার বাস্তুঘুঘুরা।

তাই পরিস্থিতি বদলাতে সময় লাগেনি। ঘুরেফিরে দেখা যাচ্ছিল হাতেগোনা কিছু মুখ। যাঁরা সমানে তাঁতিয়ে চলেছিলেন বাবুলকে। বাবুলকে নিয়ে নিজে অজান্তেই হয়তো ভারী সুন্দর মন্তব্য করে বসেছেন তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বাবুলের মতো মানুষ তিনি দেখেননি। মাথা ঠান্ডা রেখে দিব্য নিজের কাজটি করে আসেন। যাদবপুরের ক্যাম্পাসে সেদিন দেখা মিলেছিল, সেই শান্ত কুশলী বাবুল সুপ্রিয়র। পড়ুয়াদের শত প্ররোচনাতেও তিনি মেজাজ হারাননি। মনে রাখবেন, প্রোটোকল মেনে প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে কিন্তু তাঁর সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষীরাও ছিল। ধস্তাধস্তিতে তাঁদের রাইফেল থেকে ম্যাগাজিন খুলে পড়তেও দেখা গেছিল। তবু তাঁরা ধৈর্য হারাননি। আর তাঁরা যদি প্রতিমন্ত্রীর সুরক্ষায় কোনও কড়া পদক্ষেপ করতেন, তাতে উপাচার্যর অনুমতি দরকার হতো না।

এ পর্যন্ত যা লিখলাম, তার গোটাটাই মেডিয়ার চোখ দিয়ে দেখা। এবার সোশ্যাল মেডিয়ার কথা বলি। ফেসবুকে বাবুল এবং তাঁর দলকে খিস্তিখেউড় করে পোস্টগুলোর ভাষা দেখলে মনে হয় না, কোনও ন্যূনতম শিক্ষিত মানুষের ভাষা। যাদবপুরের মেধাবী বিপ্লবীরা যদি এই পোস্টগুলো করে থাকেন, তাহলে আর যাই হোক ফাইভ স্টার ইউনিভার্সিটির দেখনদারি ঝেড়ে ফেলাই উচিত। অনেক সত্যবাদি যুধিষ্ঠির আবার পরামর্শ দিয়েছেন- মাথাবিকোনো মেডিয়ার খবরে ভরসা করবেন না।
ফেসবুকের ভিডিও পোস্টে দেখা গেছে বাবুল কোনও এক ছাত্রের কালে টি শার্ট ধরে টানছেন। কোথাও আবার তিনি হাত উঁচিয়ে।

অতিবিপ্লবীদের দাবি, পড়ুয়াদের মারতে উদ্যত প্রতিমন্ত্রী। সৌরদীপ্ত সেনগুপ্ত সরাসরি মেডিয়ার ক্যামেরার সামনেই দাবি করেছেন, বাবুল তাঁকে চড় মেরেছিল। আবার বাবুলের চুল টেনে বিখ্যাত বা কুখ্যাত হয়ে যাওয়া দেবাঞ্জন বল্লভ বলেন, "যেটা করেছি, সেটা ন্যায্য জিনিস।" তার আরও অভিযোগ, বাড়িতে হুমকি দিচ্ছে।

ধরেই নিলাম পড়ুয়ারা একেবারে যথার্থই বলেছেন। মেডিয়ার ক্যামেরা তখন চোখবুজে ছিল। বেশ। তাহলে ওই মারমুখী ছাত্রছাত্রীরা কি আশা করছিলেন? তাঁরা বাবুলের ওপর হামলা চালাবেন, আর বাবুল ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে থাকবেন? এতটা আবদার সম্ভবত ঠিক না।
ফেসবুকের পোস্টিংয়েই দেখা গেছে এক ছাত্রী বুক চিতিয়ে একেবারে বাবুলের সামনে দাঁড়িয়ে। ভাবখানা এরকম, কী করবি কর দেখি! আবার এই ছাত্রীরাই অভিযোগ এনেছে, বাবুল তাঁদের কূপ্রস্তাব দিয়েছিলেন। একবার ভেবে দেখুন তো, বাবুলের কি সত্যিই দরকার ছিল কারও গায়ে হাত তোলার? সঙ্গে যখন ছিল সশস্ত্র দেহরক্ষী।
ওদিকে সোমবার লালবাজারের সাইবার ক্রাইমে অভিযোগ দায়ের করলেন অগ্নিমিত্রা পল। তাঁর অভিযোগ, ফেসবুকে অরিজিত দেবঋষি সরকার নামের এক পড়ুয়া ভিড়ের সুযোগে তাঁর শাড়ি ছেঁড়ার কথা জানিয়েছেন।

তাহলে একটা কথা নিয়ে অন্তত একমত হওয়াই যায়, ঘটনার শুরু করেছিলেন পড়ুয়ারা। মানে আমরা যাকে 'ক্রিয়া' বলছি। তার বিপরীতে বাবুল যা করেছেন, তার গোটাটাই 'প্রতিক্রিয়া'।

যাদবপুরের 'ক্রিয়া', 'প্রতিক্রিয়া'র খেলা এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু হলো না। কারণ ততক্ষণে অন্য এক দৃশ্যের অবতারণা করে ফেলেছেন ক্যাম্পাসের অভিভাবক, উপাচার্য সুরঞ্জন দাস। 'বেনিফিট অফ ডাউট' বলে একটা কথা আছে ক্রিকেট ময়দানে। এখানেও অন্য এক খেলা চললো। তাই নাটক না বলে ময়দানের ভাষাটাই বললাম।

পড়ুয়াদের মেজাজ যখন তুঙ্গে, অবস্থা যখন রীতিমতো ঘোরালো, তখন নিজের দপ্তর থেকে সপার্ষদ বেরিয়ে সরেজমিনে পৌঁছলেন উপাচার্য সুরঞ্জন দাস। চললো প্রতিমন্ত্রী, উপাচার্যের কথা কাটাকাটি। সুরঞ্জনবাবু স্পষ্ট ভাষায় বলে দিলেন, "ক্যাম্পাসে পুলিস ডাকবো না। দরকারে ইস্তফা দেব।"

এর খানিক পরেই শোনা গেলো হঠাত করেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন উপাচার্য, সহ উপাচার্য। মন্ত্রীকে ঘেরাওয়ের মধ্যে ফেলে রেখেই, উপাচার্য আর সহ- উপাচার্যকে নিয়ে গাড়ি ছুটলো এক বেসরকারি হাসপাতালে। রক্তচাপ বেড়েছে দুজনেরই। ক্যাম্পাস তখন অভিভাবকহীন।
বল্গাহীন ঘেরাওকারী ছাত্রছাত্রীরা। ঘটনা যে তখন চরম পরিণতির দিকে এগোয়নি, তার জন্য ধন্যবাদ পড়ুয়াদের। ততক্ষণে প্রায় ঘণ্টা পাঁচেক কেটে গিয়েছে। ধন্যবাদ বাবুলকে তিনি তখনও মাথা গরম করে ফেলেননি বলে।

তখনও চলেছে এক অন্তহীন ঘেরাও। ঝুপ করে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমেছে ক্যাম্পাসে। বাবুল বারেবারে প্রশ্ন তুলছেন নিরাপত্তা নিয়ে। তাঁর নিজের নিরাপত্তা না, সতর্ক করেছেন ছাত্রীদের নিরাপত্তা নিয়ে। মওকার ফায়দা তুলতে পারে দুষ্কৃতিরা।

ওদিকে  ততক্ষণে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে এবিভিপি'র। তছনছ করে দেওয়া হয়েছে এফএফআইয়ের দপ্তর। আগুন জ্বলছে ক্যাম্পাসের ভেতর। লাঠি হাতে ভেতরে ঘোরাঘুরি করছে বেশকিছু 'গেঞ্জিধারি'। পরে শোনা গেছিলো তারা ছিলো 'গেঞ্জিধারী পুলিস'।

অবস্থা যখন ঘেঁটে 'ঘ', ঠিক তখনই পরিত্রাতার ভূমিকায় ক্যাম্পাসের ভেতরে ঢুকে পড়লো রাজ্যপালের কনভয়। তাঁকেও রেয়াত করলেন না যাদবপুরের কীর্তিমানরা। দু'বারের চেষ্টায় তিনি বাবুলকে উদ্ধার করে নিজের গাড়িতে বসালেন। বিপ্লবীদের আমন্ত্রণ করলেন, তাঁর সঙ্গে আলোচনায় বসতে। "এরপরেই ধীরে ধীরে সরে পড়তে লাগলো এতক্ষণ যারা ঘেরাও করে বসেছিল তারা," বলেন বাবুল সুপ্রিয়। ঠিক এই সুযোগটাকেই কাজে লাগালেন রাজ্যপালের নিরাপত্তারক্ষীরা। প্রায় সওয়া এক ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকার পর বেরিয়ে গেল রাজ্যপালের কনভয়। ওদিকে ততক্ষণে যুদ্ধক্ষেত্রের চেহারা নিয়েছে গোটা এলাকা। কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রীর নিয়ে রাজ্যপাল বেরিয়ে যাওয়ার মিনিট দশেকের মধ্যেই ঘটনাস্থলের দখল নিলো বিশাল র‍্যাফ বাহিনী।

কিন্তু কেন্দ্রের একজন মন্ত্রী যখন পড়ুয়াদের হাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটক হয়ে পড়ে থাকেন, তখনও ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে পুলিস ডাকতে এত অনীহা কেন? আসলে পুলিস এলে 'বাবা- বাছা' করেই হোক বা লাঠি চালিয়েই হোক, ঘেরাও থেকে উদ্ধার করতো বাবুল সুপ্রিয়কে। আর তাহলেই জল ঢালা হয়ে যেত 'ক্রিয়া'র গোড়ায়। বন্ধ হয়ে যেত 'প্রতিক্রিয়া'ও। কিন্তু ঘরের মাঠে রাজনীতির এই ডার্বি ম্যাচ হাতছাড়া করতে চাইলো না শাসকদল। রাজ্য- রাজ্যপাল, বৃহত্তর অর্থে তৃণমূল- বিজেপি রেষারেষির এক জমজমাট প্রেক্ষাপট প্রশস্ত করে দিলো বামপন্থী, অতিবামপন্থী, তৃণমূল ছাত্র সংগঠন মিলেমিশে।

রাজ্যপাল সরকারকে না জানিয়েই যাদবপুরে গেছিলেন। বিবৃতিতে জানালেন তৃণমূল কংগ্রেসের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়। মুখ খুললেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়। তিনি জানিয়ে দিলেন, রাজ্যের ডিজি, মুখ্যসচিব, এমনকি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও অবস্থার কথা জানিয়েছিলাম। একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর নিরাপত্তা নিয়ে এত ঢিলেমি করলে চলে না।

ঘটনার দিনই ঘেরাওয়ের নিন্দা করেছিলেন পরিষদীয় প্রতিমন্ত্রী তাপস রায়। পুলিস না ডাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ও। যাদবপুরের বর্তমান উপাচার্যের ভূমিকাতে বিরক্ত ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন  উপাচার্য অভিজিত চক্রবর্তীও। ওদিকে সিপিএম নেত্রী বৃন্দা কারাত গোটা ঘটনা এড়িয়ে মুখ খুললেন রাজ্যপালকে নিয়ে। তাঁর অভিযোগ, রাজ্যপাল বিজেপি নেতার মতো আচরণ করছেন।

তৃণমূল হোক বা সিপিএম, কোনও পক্ষই পড়ুয়াদের আচরণে কোনও দোষ দেখতে পাননি। দুই দলের এই মিতালির ছবি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠলো সোমবার। উপাচার্য সুরঞ্জন দাস, এই দুই দলেরই 'গুডবুকে' আছেন। এবিভিপি'র মিছিল প্রতিহত করতে ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে মানব বন্ধন তৈরি করে সিপিএম সমর্থিত শিক্ষক সংগঠন 'জুটা'। ওদিকে তখন চলেছে এফএফআইয়ের বিক্ষোভ, শ্লোগান। এদিকে যত দোষ নন্দ ঘোষের মতো হাল হয়েছে বাবুল সুপ্রিয়র। আক্রমণের মুখে পড়েছেন রাজ্যপালও। mkযাদবপুরের কান্ড প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য, দেখছেন তো, সবকিছুই গায়ের জোরে করতে চাইছে।
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours