Silpir oviman
কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:


(সে এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা। বুঝতে পেরেছিলাম দরদী শিল্পীমন বস্তুটা ঠিক কী! তাঁর মহাশয়ানে যাওয়ার ঠিক কিছুদিন আগেই, সাক্ষাতকার নিতে গেছিলাম স্বর্ণযুগের অন্যতম এক শিল্পী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের)

ঠিক আজকের মতোই, সেও ছিল এক সকাল।

একটু আগেই শেষ হয়েছিল, আকাশবাণীর প্রভাতী অনুষ্ঠান 'মহিষাসুরমর্দিনী'।

মহালয়ার সকাল। চোখের সামনেই দেখেছিলেন স্ত্রী, সবিতার দেহ নিথর হয়ে যেতে।

তারপর থেকেই দেবীপক্ষের সূচনায়, আর কখনও কাকভোরে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েননি তিনি। খুলে বসেননি রেডিও।

'জাগো দুর্গা। জাগো দশপ্রহরণধারিনী!' তাঁর দরাজ গলার সুরে জেগে উঠেছে গোটা বিশ্বের বাঙালি। ঘুম ভেঙেছে দরদী শিল্পীরও। বহুদিনের নিয়ম মেনেই। মনভারী হয়ে উঠেছে স্মৃতিভারে।

শিল্পীর বুকেও জমতো একরাশ অভিমান? সেই একরাশ অভিমান বুকে নিয়েই, অমৃতধামে পাড়ি দিয়েছেন তিনিও।

অভিমানী শিল্পী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়। প্রয়াত লিখলাম না। কারণ শিল্পীদের প্রয়াত হতে নেই। তাঁরা অবিনশ্বর। প্রবল ভাবে বেঁচে থাকেন তাঁদের কীর্তিতে। স্বমহিমায়।

কথা হচ্ছিল সল্টলেকে শিল্পীর বাড়িতে বসে। আমার সামনেই বসে দীর্ঘদেহী দ্বিজেনবাবু। একেবারে খাঁটি বাঙালির প্রতিমূর্তি। সাদা ধুতি, হাতগোটানো শার্ট বা পাঞ্জাবিতেই বাঙালি চেনে তাঁকে। "শরীরের গতিক খুব একটা সুবিধার ঠেকছে না," বলেছিলেন সেই দরাজ গলার গায়ক। মুখে তবুও ম্লান হাসি। থাকতেন ছেলে, ছেলেবউয়ের সঙ্গে। মুখে কিছু না বললেও, স্ত্রী চলে যাওয়ার পরেই ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়েছিলেন তিনি।

সময়টা ছিল দেবীপক্ষের শুরু হওয়ার পরেই। তাই কথাবার্তার শুরুতেই শিল্পী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, "মহিষাসুরমর্দিনী' শুনলেন?"

মুহূর্তের নীরবতা।

চশমার আড়ালে মুক্তোর মতো চিকচিক করে উঠেছিল শিল্পীর দু'চোখ। বুকের অতলে জমে থাকা বেদনার বাষ্প দু'চোখের কোলে জমে উঠলে ঠিক যেরকমটা হয়। বুঝতে পেরেছিলাম কিছু একটা ভুল করে বসেছি। শরমে মরে যাচ্ছিলাম। কিন্তু বাক্যবাণ বলে কথা! একবার ছোঁড়া হয়ে গেলে, আর ফেরানো যায় না। রীতিমত অস্বস্তিতে পড়ে গেছিলাম। কয়েক মুহূর্ত। তারপরেই সহায় হয়েছিলেন খোদ শিল্পী। কথা বলতে গেলেন। কিন্তু আবেগে বুজে এলো গলা।

"মহালয়ার সকালেই মারা গেছিলো সবিতা," খুব ধীরস্বরে বললেন শিল্পী।  "ক্যানসার ঘর বেঁধেছিলো ওর শরীরে।" ধীরে ধীরে স্মৃতির আগল হাটখুলে দিয়েছিলেন নব্বই ছুঁতে চলা প্রবীণ দ্বিজেনবাবু। "সবাই মিলে বেশ হইচই করেই 'মহিষাসুরমর্দিনী' শুনেছিলাম সেবার। অনুষ্ঠান শেষ হলো। সকালে স্নান সেরে নিতো ও। রোজকার মতো সেদিনও বাথরুমে ঢুকলো।" কয়েক মুহূর্তের জন্য ফের নীরব হলেন শিল্পী।

"স্নান সেরে বেরিয়েই বললো, ভালো লাগছে না। কেমন যেন করছে শরীরটা। একটু শোব।" শুয়ে পড়লেন সবিতা দেবী। ঘটনা যে কোনদিকে গড়াচ্ছে, তখন কেউ ঘুণাক্ষরেও ভাবতেও পারেনি। "সেই ঘুম আর ভাঙেনি," বললেন শিল্পী। স্বামীর চোখের সামনেই, সেই পুণ্য সকালে চিরশয়ানে গেছিলেন স্ত্রী।

ওই ঘটনার পর আর 'মহিষাসুরমর্দিনী' শোনেননি দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়। চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছিলাম 'অমর প্রেম'- এর নায়ককে।

আকাশবাণীর প্রভাতী অনুষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল শিল্পীর অনেক মধুস্মৃতিও। 'মহিষাসুরমর্দিনী' অনুষ্ঠানের অনেক প্রাণপুরুষরাই ততদিনে গত হয়েছিলেন। "প্রথম দিকে 'লাইভ প্রোগ্রাম' হতো," বলেন প্রবীণ দ্বিজেনবাবু। "তার মজাটাই ছিল আলাদা।"

আজকের ইডেন গার্ডেনে না। তখন এক নাম্বার গার্স্টিন প্লেসে ছিল আকাশবাণী ভবন। আর ছিল ভুতুড়ে বাড়ির বদনাম। ছিল সাহেবভূতও। দ্বিজেনবাবু নিজেও সেই ভূতের পাল্লায় পড়েছিলেন।

মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানের আগের দিন সকাল থেকেই সাজ সাজ রব। বেড়ে যেত ব্যস্ততা। আর সন্ধ্যা গড়াতে না গড়াতেই উৎসবের মেজাজ। সারারাত শিল্পীদের আনাগোনা। কত শত প্রস্তুতি। সে এক মজলিশি ব্যাপার। অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি, পাশাপাশি জমিয়ে আড্ডা। নির্ভেজাল বাঙালি খানাপিনা।

এরইমধ্যে স্টুডিওতে একে একে এসে হাজির হতেন সিনিয়র শিল্পীরা। "সিনিয়র আর্টিস্টরা ঘরে ঢুকলেই, জুনিয়র শিল্পীরা সবাই উঠে দাঁড়াতো। এটাই ছিল তখনকার রীতি," বলেন দ্বিজেনবাবু। তবে আড্ডা চলতো একসঙ্গেই। ঠাট্টা, ইয়ার্কি, ফাজলামি, এ ওর পেছনে লাগা, কোনও কিছুই বাদ থাকতো না। কথার মাঝেই সুদূর কোন অতীতে, হয়ত বা সুখস্মৃতির তেপান্তরে হারিয়ে যাচ্ছিলেন শিল্পী। চোখজুড়ে তখন একরাশ শূন্যতা।

বাণীকুমার, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র আর স্বর্ণযুগের সব বাঘা শিল্পীদের সেই ঐকতান আজও শোনে বাংলা। এত যুগ পরেও, এতটুকু আকর্ষণ কমেনি সেই আদি 'মহিষাসুরমর্দিনী'র। এমনকি বাংলার মহানায়ককেও একসময়  হার মানতে হয়েছিলো ওই সাদামাটা অনুষ্ঠানের কাছে। দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা ওই অনুষ্ঠানের মাহাত্ম্য, সেদিন বুঝতে ভুল করে ফেলেছিলেন আকাশবাণী অধিকর্তারা। চেষ্টা হয়েছিল যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে। উত্তমকুমারের মতো স্টারকে দিয়ে চলতি হাওয়ায় গা ভাসানোর মতো কোনও কিছু করতে।

আকাশবাণীর সেই 'মহিষাসুরমর্দিনী"র আধুনিক সংস্করণ সরাসরি বয়কট করে বসে বাঙালি। প্রতিবাদের আওয়াজ ওঠে সর্বস্তরে। শ্রোতাদের চাপে পড়ে সে বছরই, ফের পুরনো 'মহিষাসুরমর্দিনী' প্রচার করে আকাশবাণী। আজ যেন ওই অমরসৃষ্টি, আকাশবাণীর এক নিছক প্রভাতী অনুষ্ঠান না। বাংলা, বাঙালির অভ্যেস হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাঙালির মুখে মুখে 'মহিষাসুরমর্দিনী' অনুষ্ঠানের নাম দাঁড়িয়েছে 'মহালয়া'। তাতে কিই বা আসে যায়? মোট কথা, রেডিওতে মহালয়া না বাজলে শারদোৎসবের আবহটাই তৈরি হয় না।

দ্বিজেনবাবুর দরদী গলায় 'জাগো দুর্গা' ডাক শুনেই যেন 'দেবী' ছুটে আসেন বাংলায়। তবে স্বর্গের সেই 'দেবী'র জন্য আজ আর মর্তে অপেক্ষা করে থাকেন না, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় সবিতা দেবীর জুটি।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours