কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতাঃ
দেখুন দেখি, কী কান্ডটাই না করে বসলেন গুরুদেব!
"সখী, একটি চুম্বন দাও
গোপনে একটি চুম্বন দাও!"
সখীর কাছে হামিভিক্ষা? ব্যাসদেব অমনি নাক কোঁচকালেন। গাঢ় কপালের ভাঁজ। কই, কৃষ্ণসখা তো কখনও আড়ালে, আবডালে সখী দ্রৌপদীর কাছে অমন আবদার করেনি। অতঃপর, বন্ধুত্বে চুম্বনের বৈধতা নিয়ে ভাবতে বসলেন মহাঋষি।
কেন মশাই, বন্ধু হিসেবে হাতে-হাত চলতেই পারে। তাহলে ঠোঁটে ঠোঁট নয় কেন? লিন্ডা সাপাডিন। নিউইয়র্ক শহরের এক ডাকাবুকো মনস্তত্ত্ববিদ। তিনি এই প্রশ্নটির জবাবে বলছেন, "ছেলেমেয়ের নির্ভেজাল বন্ধুত্বে বাগড়া দেয় ওই শরীর। মনের দিক থেকে, চুমু খাওয়ার সময়েও তারা বন্ধু। কিন্তু তাতে শরীর ফুঁসে ওঠে। সে মনে থেমে থাকতে চায় না। শরীরের দখল নিতে চায়।"
তবে ভবিষ্যতদ্রষ্টা আমাদের কবিগুরু। জানতেন, দুই বন্ধুর ঠোঁটে ঠোঁট স্বঘোষিত নীতি পুলিশের চোখে পড়লেই তেড়ে আসবে। তাই গুরুদেবও যথেষ্ট সাবধানী। বলেই দিয়েছেন- "গোপনে একটি চুম্বন দাও!" দুটি নয়, চারটি নয়, মাত্র একটি। তবু ওই একটি চুম্বনেই ভদ্রজনের চোখ কপালে উঠবে। চুম্বন মানে যৌনতাই। নিদেনপক্ষে পূর্বরাগ তো বটেই। সখী মানেতো বন্ধু। ওই তো, কেষ্টঠাকুর সহস্রবার অর্জুনকে সম্বোধন করেছেন 'হে সখা' বলে। আবার দ্রৌপদীও কৃষ্ণের সখী। কই, এমন যে প্রেমের ঠাকুর কৃষ্ণ, তিনিও তো দ্রৌপদীর কাছে কখনও সাধু অথবা চলিত ভাষায় চুম্বন ভিক্ষা করেছিলেন বলে শুনিনি।
এও এক অদ্ভুত সম্পর্ক! সখী কখন বন্ধু, কখন প্রেমিক, মধ্যেকার এই 'লক্ষণ রেখা' বড়ই সূক্ষ্ম। আর রবীন্দ্রকাব্যে তো সব মিলেমিশে একাকার। পূজা প্রেম প্রকৃতি কখন যেন সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়। কৃষ্ণ দ্রৌপদীও যেন রবীন্দ্রকাব্যের দুই চরিত্র। কৃষ্ণের ওপর তাঁর অধিকারের কথাও সগর্বে জানিয়েছিলেন পাঞ্চালি। পঞ্চপান্ডবের স্ত্রী হয়েও বলেছিলেন, তিনি কৃষ্ণের প্রেমিক। বন্ধুত্বের সম্পর্ক যে কত ব্যাপক তা যেমন রবীন্দ্রকাব্যে, ঠিক তেমনি ব্যাসদেবের মহাভারতেও। মানসিকতার দিক থেকে আধুনিকতম।

পাঞ্চালির স্বয়ম্বর সভা। হাজির শ্রীকৃষ্ণও।
পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের ইচ্ছাও ছিল কৃষ্ণকে জামাই করার। কিন্তু কৃষ্ণ পাঞ্চালিরাজকে জানিয়ে দেন, তিনি পাঞ্চালিকে বিয়ে করছেন না। একই কথা জানান পাঞ্চালিকেও। অঙ্গীকার করেন আজীবন বন্ধুত্বের। সেদিন থেকেই দুজনে সখা, সখী। সময়ের সঙ্গে সেই সম্পর্কের শেকড় ছড়ায় হৃদয়ের আরও, আরও অতল গভীরে। বন্ধুত্ব ছাড়া আর কিই বা নাম দেব ওই সম্পর্কের? কৃষ্ণ, কৃষ্ণার ওই সম্পর্ক থেকেই ধার করা নয়তো আজকের বয়ফ্রেন্ড, গার্লেফ্রন্ড কনসেপশন? কথায় বলে যা নেই ভারতে, আছে মহাভারতে। শাস্ত্রকাররা তাই চার বেদ ছাড়িয়ে 'পঞ্চম বেদ'- এর সম্মান দেন মহাভারতকে।
সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়েই রং পাকা হয় বন্ধুত্বের। পেরোয় একের পর আরেক স্তর, জানাচ্ছেন আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অফ কানসাস- এর গবেষক জেফ্রি হল। চল্লিশ থেকে ষাট ঘণ্টা গল্পগাছা, মেলামেশা করলেই মিতালি। আরেকটু সময় দিন। আশি থেকে একশো ঘণ্টা পেরোলেই হলো। মিতালিতে বন্ধুত্বের রং ধরা শুরু করবে। আর যদি দুশো ঘণ্টা কাটিয়ে ফেলতে পারেন, তাহলে তো কথাই নেই। আপনাদের দোস্তি হবে, 'শোলে' সিনেমার জয় আর বীরুর মতো।
"ইয়ে দোস্তি, হম নেহি ছোড়েঙ্গে!"
পাঞ্চালির বিয়ের পরেও কৃষ্ণের সঙ্গে বন্ধুত্ব অটুট। সম্পর্কে এতটুকু ভাটা পড়েনি। উল্টে তা যেন আরও গাঢ় হয়। সংক্রান্তির দিন। ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে মাঞ্জাসুতোয় আঙুল কেটে ফেললেন কৃষ্ণ। ছুটে এলেন দ্রৌপদী। নিজের শাড়ির আঁচল ছিড়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন কৃষ্ণসখার আঙুলে। কৃষ্ণ ফের কথা দিলেন, সখী দ্রৌপদীর আপদ-বিপদে তিনি পাশে থাকবেন।
দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ। পঞ্চস্বামী মুখ নীচু করে বসে। দ্বাপর যুগের শ্রেষ্ঠ বিদ্বজ্জন। ভরা রাজসভায় উলঙ্গ হতে চলেছেন ভরাযৌবনা, রজঃস্বলা দ্রৌপদী। স্মরণ করলেন সখা কৃষ্ণকে। তার পরের ইতিহাস সবার জানা। কৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথাও সগর্বে জানিয়েছিলেন দ্রৌপদী। প্রথমত, কৃষ্ণ তাঁর আত্মীয়। দ্বিতীয়ত, অগ্নিকুন্ডে জন্ম দ্রৌপদীর। তাই তিনি গৌরবশালী। তৃতীয়ত, সে কৃষ্ণের প্রেমিক। চতুর্থত, কৃষ্ণের ওপর তাঁর অধিকার।
যেন এক স্বর্গীয় সৌরভ কৃষ্ণ দ্রৌপদীর বন্ধুত্বে। বন্ধুত্বের আড়ালে কি নিরন্তর বয়ে চলেছিল প্রেমের ফল্গুধারা? ব্যাসদেব কিন্তু তেমন কিছু স্বীকার করেননি। আবার অদ্ভুত ভাবে তিনি নানা সাদৃশ্যের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন দুজনের মধ্যে। যেমন কৃষ্ণ, দ্রৌপদী, দুজনেই শ্যামবর্ণ। একজন কৃষ্ণ হলে, অন্যজন কৃষ্ণা। একে যেন অনের পরিপুরক। পঞ্চস্বামী যেখানে ঠুঁটো জগন্নাথ, সেখানেও দ্রৌপদীর সহায় কৃষ্ণ। যেন একই লক্ষ্যে ছুটে চলা দুজনের। দুজনেই দুজনকে পেয়েছিল বন্ধুরূপে।
কানাডার ইউনিভার্সিটি অফ উইনিপেগ- এর এক সমাজতত্ত্ববিদ বেভারলি ফার। তাঁর মতে, 'জাস্ট ফ্রেন্ড' বা নিছক বন্ধু থেকে সখা, সখী হতে গেলে খোলামেলা হতে হবে দুজনকেই। দুজনেই দুজনের কাছে মেলে ধরবে নিজেদের। আর যদি দুই বন্ধুর পছন্দ অপছন্দগুলি মিলে যায়, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। তাদের সখা- সখী হওয়া রোখে কে? একজনের মনের কাছাকাছি পৌঁছে যায় আরেকজন।
তবে পছন্দের জনের কাছে পৌঁছনোর আরও এক সোজা রাস্তা আছে। তা শত্রুতার। ভগবান শ্রীবিষ্ণু কিন্তু সেরকমই বলেছিলেন।
"ভক্ত হয়ে পেতে গেলে লাগবে সাতজন্ম। শত্রু হয়ে পেতে গেলে লাগবে তিনজন্ম।"
ছোট্ট করে ঘটনাটা শোনাই। বৈকন্ঠপুরীর দ্বাররক্ষীর কাজে গাফিলতি। এই অভিযোগে দন্ডিত হলেন দুই দ্বারপাল জয় বিজয়। অপরাধী দুই দ্বারপালের কাতর আবেদনে মন গললো শ্রীবৃষ্ণুর। অপশন দিলেন তিনি। বুদ্ধিমান দুই দ্বাররক্ষী দ্বিতীয় অপশনটি বেছে নিয়েছিল। এরপরেই সত্যযুগে মর্ত্যে জন্ম নেন হিরনক্ষ আর হিরণ্যকশিপু। ত্রেতাযুগে রাবণ, কুম্ভকর্ণ। সবশেষে দ্বাপরে, শিশুপাল, দন্তবক্র। ওদিকে তাদের উদ্ধার করতে তিন অবতাদের রূপ নিয়ে আবির্ভাব হয় বিষ্ণুর। নরসিংহ, রাম আর কৃষ্ণ। তিন জন্মেই তিন অবতারের সঙ্গে শত্রুতার পথ বেছে নিলেন অভিশপ্ত দুই দ্বারপাল। অবতারের হাতে নিধনের পর, ফের তাদের জায়গা হলো বৈকুন্ঠপুরীতে। তাহলে 'মন মহাজন'কে চট করে পেতে হলে বন্ধুত্ব না, শত্রুতার রাস্তাটাই বেশি সোজা ? পুরাণ সেরকমটাই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
আবার কাল যাদের বন্ধু মনে হতো, আজ তাদের নিছক পরিচিত বলেই মনে হয়। প্রায় তিন দশক যাদের সঙ্গে অফিসে কাটালেন, তাঁদের একজনও বন্ধু হলো না। এটা টের পেলেন অবসরের পর মাসখানেক কাটতে না কাটতেই। কেন? মনস্তত্ত্বের সব হিসেব- কিতেব পালটে গেল নাকি? মোটেই নয়। আপনারা কেউ স্বেচ্ছায় জীবনের এক দীর্ঘ সময় একসঙ্গে কাটাননি। পরিস্থিতি বাধ্য করেছিল একসঙ্গে থাকতে। তাই সহকর্মীদের বন্ধু মনে হলেও, আসলে তাঁরা সহকর্মীই থেকে গেছিলেন।
ইন্টারনেটের যুগ। অনলাইন বন্ধুত্ব। হতেই পারে। কিন্তু ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের সঙ্গে তার কোনও তুলনাই চলে না বলে মনস্তত্ত্ববিদের মত। গোটা ব্যাপারটাই যেন ভার্চুয়াল। মনের ছোঁয়া থাকলেও থাকতে পারে, শরীর কোনমতেই থাকে না। ফাঁক থেকে যায় সম্পর্কে।
আবার দেখুন, মনের বন্ধুত্বে শরীরের ছোঁয়া, তাহলেই প্রেম। বন্ধু থেকে প্রেমিক হওয়াটা আকছার। কিন্তু প্রেমিক থেকে বন্ধু নৈব নৈব চ। তাহলে বন্ধু প্রমোশন পেয়ে প্রেমিক। আর প্রেমিক ডিমোশন পেয়ে বন্ধু। ডিমোশন কেই বা অ্যাকসেপ্ট করে ?
তাই প্রেমিকের কদর বেশি। রাধাকৃষ্ণ,
লায়লা-মজনু, রোমিয়ো-জুলিয়েট আরও কতজনা। কিন্তু সবাই ফেলিয়োর। ট্র্যাজেডির
পর ট্র্যাজেডি। বিচ্ছেদ। এমনকি জীবনও যায়। তবু মানুষ পা বাড়ায় সেই
যন্ত্রণাকীর্ণ পথেই। বিচ্ছেদ অনিবার্য জেনেও প্রেমে পড়ে জীবনের। কিন্তু
জীবন যখন দুর্বিসহ তখন? জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে, মনে পড়ে সখার কথা।
শেষ ভরসা সেই বন্ধুত্বেই।
ধৃতরাষ্ট্র রাজসভায় অসহায় দ্রৌপদী কাতর কন্ঠ ডেকেছিলেন কৃষ্ণসখাকে। সেই ডাকে যেন বেজেছিল কবিগুরুর সুর- "চিরসখা ছেড়ো না মোরে ছেড়ো না!"
"সখী, একটি চুম্বন দাও
গোপনে একটি চুম্বন দাও!"
সখীর কাছে হামিভিক্ষা? ব্যাসদেব অমনি নাক কোঁচকালেন। গাঢ় কপালের ভাঁজ। কই, কৃষ্ণসখা তো কখনও আড়ালে, আবডালে সখী দ্রৌপদীর কাছে অমন আবদার করেনি। অতঃপর, বন্ধুত্বে চুম্বনের বৈধতা নিয়ে ভাবতে বসলেন মহাঋষি।
কেন মশাই, বন্ধু হিসেবে হাতে-হাত চলতেই পারে। তাহলে ঠোঁটে ঠোঁট নয় কেন? লিন্ডা সাপাডিন। নিউইয়র্ক শহরের এক ডাকাবুকো মনস্তত্ত্ববিদ। তিনি এই প্রশ্নটির জবাবে বলছেন, "ছেলেমেয়ের নির্ভেজাল বন্ধুত্বে বাগড়া দেয় ওই শরীর। মনের দিক থেকে, চুমু খাওয়ার সময়েও তারা বন্ধু। কিন্তু তাতে শরীর ফুঁসে ওঠে। সে মনে থেমে থাকতে চায় না। শরীরের দখল নিতে চায়।"
তবে ভবিষ্যতদ্রষ্টা আমাদের কবিগুরু। জানতেন, দুই বন্ধুর ঠোঁটে ঠোঁট স্বঘোষিত নীতি পুলিশের চোখে পড়লেই তেড়ে আসবে। তাই গুরুদেবও যথেষ্ট সাবধানী। বলেই দিয়েছেন- "গোপনে একটি চুম্বন দাও!" দুটি নয়, চারটি নয়, মাত্র একটি। তবু ওই একটি চুম্বনেই ভদ্রজনের চোখ কপালে উঠবে। চুম্বন মানে যৌনতাই। নিদেনপক্ষে পূর্বরাগ তো বটেই। সখী মানেতো বন্ধু। ওই তো, কেষ্টঠাকুর সহস্রবার অর্জুনকে সম্বোধন করেছেন 'হে সখা' বলে। আবার দ্রৌপদীও কৃষ্ণের সখী। কই, এমন যে প্রেমের ঠাকুর কৃষ্ণ, তিনিও তো দ্রৌপদীর কাছে কখনও সাধু অথবা চলিত ভাষায় চুম্বন ভিক্ষা করেছিলেন বলে শুনিনি।
এও এক অদ্ভুত সম্পর্ক! সখী কখন বন্ধু, কখন প্রেমিক, মধ্যেকার এই 'লক্ষণ রেখা' বড়ই সূক্ষ্ম। আর রবীন্দ্রকাব্যে তো সব মিলেমিশে একাকার। পূজা প্রেম প্রকৃতি কখন যেন সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়। কৃষ্ণ দ্রৌপদীও যেন রবীন্দ্রকাব্যের দুই চরিত্র। কৃষ্ণের ওপর তাঁর অধিকারের কথাও সগর্বে জানিয়েছিলেন পাঞ্চালি। পঞ্চপান্ডবের স্ত্রী হয়েও বলেছিলেন, তিনি কৃষ্ণের প্রেমিক। বন্ধুত্বের সম্পর্ক যে কত ব্যাপক তা যেমন রবীন্দ্রকাব্যে, ঠিক তেমনি ব্যাসদেবের মহাভারতেও। মানসিকতার দিক থেকে আধুনিকতম।

পাঞ্চালির স্বয়ম্বর সভা। হাজির শ্রীকৃষ্ণও।
পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের ইচ্ছাও ছিল কৃষ্ণকে জামাই করার। কিন্তু কৃষ্ণ পাঞ্চালিরাজকে জানিয়ে দেন, তিনি পাঞ্চালিকে বিয়ে করছেন না। একই কথা জানান পাঞ্চালিকেও। অঙ্গীকার করেন আজীবন বন্ধুত্বের। সেদিন থেকেই দুজনে সখা, সখী। সময়ের সঙ্গে সেই সম্পর্কের শেকড় ছড়ায় হৃদয়ের আরও, আরও অতল গভীরে। বন্ধুত্ব ছাড়া আর কিই বা নাম দেব ওই সম্পর্কের? কৃষ্ণ, কৃষ্ণার ওই সম্পর্ক থেকেই ধার করা নয়তো আজকের বয়ফ্রেন্ড, গার্লেফ্রন্ড কনসেপশন? কথায় বলে যা নেই ভারতে, আছে মহাভারতে। শাস্ত্রকাররা তাই চার বেদ ছাড়িয়ে 'পঞ্চম বেদ'- এর সম্মান দেন মহাভারতকে।
সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়েই রং পাকা হয় বন্ধুত্বের। পেরোয় একের পর আরেক স্তর, জানাচ্ছেন আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অফ কানসাস- এর গবেষক জেফ্রি হল। চল্লিশ থেকে ষাট ঘণ্টা গল্পগাছা, মেলামেশা করলেই মিতালি। আরেকটু সময় দিন। আশি থেকে একশো ঘণ্টা পেরোলেই হলো। মিতালিতে বন্ধুত্বের রং ধরা শুরু করবে। আর যদি দুশো ঘণ্টা কাটিয়ে ফেলতে পারেন, তাহলে তো কথাই নেই। আপনাদের দোস্তি হবে, 'শোলে' সিনেমার জয় আর বীরুর মতো।
"ইয়ে দোস্তি, হম নেহি ছোড়েঙ্গে!"
পাঞ্চালির বিয়ের পরেও কৃষ্ণের সঙ্গে বন্ধুত্ব অটুট। সম্পর্কে এতটুকু ভাটা পড়েনি। উল্টে তা যেন আরও গাঢ় হয়। সংক্রান্তির দিন। ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে মাঞ্জাসুতোয় আঙুল কেটে ফেললেন কৃষ্ণ। ছুটে এলেন দ্রৌপদী। নিজের শাড়ির আঁচল ছিড়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন কৃষ্ণসখার আঙুলে। কৃষ্ণ ফের কথা দিলেন, সখী দ্রৌপদীর আপদ-বিপদে তিনি পাশে থাকবেন।
দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ। পঞ্চস্বামী মুখ নীচু করে বসে। দ্বাপর যুগের শ্রেষ্ঠ বিদ্বজ্জন। ভরা রাজসভায় উলঙ্গ হতে চলেছেন ভরাযৌবনা, রজঃস্বলা দ্রৌপদী। স্মরণ করলেন সখা কৃষ্ণকে। তার পরের ইতিহাস সবার জানা। কৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথাও সগর্বে জানিয়েছিলেন দ্রৌপদী। প্রথমত, কৃষ্ণ তাঁর আত্মীয়। দ্বিতীয়ত, অগ্নিকুন্ডে জন্ম দ্রৌপদীর। তাই তিনি গৌরবশালী। তৃতীয়ত, সে কৃষ্ণের প্রেমিক। চতুর্থত, কৃষ্ণের ওপর তাঁর অধিকার।
যেন এক স্বর্গীয় সৌরভ কৃষ্ণ দ্রৌপদীর বন্ধুত্বে। বন্ধুত্বের আড়ালে কি নিরন্তর বয়ে চলেছিল প্রেমের ফল্গুধারা? ব্যাসদেব কিন্তু তেমন কিছু স্বীকার করেননি। আবার অদ্ভুত ভাবে তিনি নানা সাদৃশ্যের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন দুজনের মধ্যে। যেমন কৃষ্ণ, দ্রৌপদী, দুজনেই শ্যামবর্ণ। একজন কৃষ্ণ হলে, অন্যজন কৃষ্ণা। একে যেন অনের পরিপুরক। পঞ্চস্বামী যেখানে ঠুঁটো জগন্নাথ, সেখানেও দ্রৌপদীর সহায় কৃষ্ণ। যেন একই লক্ষ্যে ছুটে চলা দুজনের। দুজনেই দুজনকে পেয়েছিল বন্ধুরূপে।
কানাডার ইউনিভার্সিটি অফ উইনিপেগ- এর এক সমাজতত্ত্ববিদ বেভারলি ফার। তাঁর মতে, 'জাস্ট ফ্রেন্ড' বা নিছক বন্ধু থেকে সখা, সখী হতে গেলে খোলামেলা হতে হবে দুজনকেই। দুজনেই দুজনের কাছে মেলে ধরবে নিজেদের। আর যদি দুই বন্ধুর পছন্দ অপছন্দগুলি মিলে যায়, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। তাদের সখা- সখী হওয়া রোখে কে? একজনের মনের কাছাকাছি পৌঁছে যায় আরেকজন।
তবে পছন্দের জনের কাছে পৌঁছনোর আরও এক সোজা রাস্তা আছে। তা শত্রুতার। ভগবান শ্রীবিষ্ণু কিন্তু সেরকমই বলেছিলেন।
"ভক্ত হয়ে পেতে গেলে লাগবে সাতজন্ম। শত্রু হয়ে পেতে গেলে লাগবে তিনজন্ম।"
ছোট্ট করে ঘটনাটা শোনাই। বৈকন্ঠপুরীর দ্বাররক্ষীর কাজে গাফিলতি। এই অভিযোগে দন্ডিত হলেন দুই দ্বারপাল জয় বিজয়। অপরাধী দুই দ্বারপালের কাতর আবেদনে মন গললো শ্রীবৃষ্ণুর। অপশন দিলেন তিনি। বুদ্ধিমান দুই দ্বাররক্ষী দ্বিতীয় অপশনটি বেছে নিয়েছিল। এরপরেই সত্যযুগে মর্ত্যে জন্ম নেন হিরনক্ষ আর হিরণ্যকশিপু। ত্রেতাযুগে রাবণ, কুম্ভকর্ণ। সবশেষে দ্বাপরে, শিশুপাল, দন্তবক্র। ওদিকে তাদের উদ্ধার করতে তিন অবতাদের রূপ নিয়ে আবির্ভাব হয় বিষ্ণুর। নরসিংহ, রাম আর কৃষ্ণ। তিন জন্মেই তিন অবতারের সঙ্গে শত্রুতার পথ বেছে নিলেন অভিশপ্ত দুই দ্বারপাল। অবতারের হাতে নিধনের পর, ফের তাদের জায়গা হলো বৈকুন্ঠপুরীতে। তাহলে 'মন মহাজন'কে চট করে পেতে হলে বন্ধুত্ব না, শত্রুতার রাস্তাটাই বেশি সোজা ? পুরাণ সেরকমটাই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
আবার কাল যাদের বন্ধু মনে হতো, আজ তাদের নিছক পরিচিত বলেই মনে হয়। প্রায় তিন দশক যাদের সঙ্গে অফিসে কাটালেন, তাঁদের একজনও বন্ধু হলো না। এটা টের পেলেন অবসরের পর মাসখানেক কাটতে না কাটতেই। কেন? মনস্তত্ত্বের সব হিসেব- কিতেব পালটে গেল নাকি? মোটেই নয়। আপনারা কেউ স্বেচ্ছায় জীবনের এক দীর্ঘ সময় একসঙ্গে কাটাননি। পরিস্থিতি বাধ্য করেছিল একসঙ্গে থাকতে। তাই সহকর্মীদের বন্ধু মনে হলেও, আসলে তাঁরা সহকর্মীই থেকে গেছিলেন।
ইন্টারনেটের যুগ। অনলাইন বন্ধুত্ব। হতেই পারে। কিন্তু ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের সঙ্গে তার কোনও তুলনাই চলে না বলে মনস্তত্ত্ববিদের মত। গোটা ব্যাপারটাই যেন ভার্চুয়াল। মনের ছোঁয়া থাকলেও থাকতে পারে, শরীর কোনমতেই থাকে না। ফাঁক থেকে যায় সম্পর্কে।
আবার দেখুন, মনের বন্ধুত্বে শরীরের ছোঁয়া, তাহলেই প্রেম। বন্ধু থেকে প্রেমিক হওয়াটা আকছার। কিন্তু প্রেমিক থেকে বন্ধু নৈব নৈব চ। তাহলে বন্ধু প্রমোশন পেয়ে প্রেমিক। আর প্রেমিক ডিমোশন পেয়ে বন্ধু। ডিমোশন কেই বা অ্যাকসেপ্ট করে ?

ধৃতরাষ্ট্র রাজসভায় অসহায় দ্রৌপদী কাতর কন্ঠ ডেকেছিলেন কৃষ্ণসখাকে। সেই ডাকে যেন বেজেছিল কবিগুরুর সুর- "চিরসখা ছেড়ো না মোরে ছেড়ো না!"
বেশ লাগলো পড়ে।
ReplyDelete