জয়ন্ত কুমার সাহা, ফিচার রাইটার, কলকাতা:
চোখে পড়লো 'বিশ্ব বাংলা' এর উঁচু মঞ্চ। মনে ধরলো তার নির্মাণশৈলীতে পেশাদার মুন্সিয়ানার ছাপ।
উচ্চ
মাধ্যমিক পরীক্ষার পরে একবার মরিস অক্সফোর্ড গাড়িতে সওয়ার হয়ে ওল্ড দীঘায়
এসেছিলাম। সেইবারের অভিজ্ঞতা নিদারুণ। বহুবার যান্ত্রিক বিভ্রাটের কারণে
গাড়ির গতিপথ রুদ্ধ হয়েছে। বালেশ্বর অবধি পৌঁছেও পঞ্চলিঙ্গেশ্বর বা চাঁদিপুর
পৌঁছাতে পারিনি। সেইবার ছিলাম 'হোস্ট' হোটেলে। তখনকার দেখা প্রায় সিকি শতক
আগের ওল্ড দীঘা আজ একেবারেই বদলে গেছে। তার বহির্দেশে অনেক সাজসজ্জা হয়েছে
- শরীরে অলংকারের প্রাচুর্য - গা ভর্তি ভারী ভারী গহনা - জমজমাট পর্যটন
কেন্দ্র। কিন্তু শিল্পীর রূপটানটিই হারিয়ে গেছে। চিনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল
কৈশোরের সেই চেনা কিশোরীকে। এখন সে যেন সে পূর্ণ সংসারী - সম্ভ্রান্ত
গৃহিণীর আভিজাত্যে আত্মগোপন করেছে সেইদিনের সেই পরিচিতা তন্বী।
দীঘায় আজ তৃতীয় দিন।
এখানে
আসার আগে থেকেই বেশ কাশিতে ভুগছি। হেমিওপ্যাথী চলছিল। তবে তাতে বিশেষ কিছু
সুবিধা না হওয়ায় এখানে এসে এলোপ্যাথী ধরতে হলো। তবু সারাদিনই সেই উৎপাত
চলছে। রাতে আদা চিবিয়ে কোনওরকমে শুতে পারছি।
প্রথম দিন এসে বেশ কিছুক্ষণ সমুদ্রে স্নান করেছিলাম। দ্বিতীয় দিন সেটি আর হয়নি। আজ আবারও সেই অভিজ্ঞতা হলো।
একটু
একটু ক'রে এগিয়ে গেলাম সমুদ্রের দিকে - ধীরে ধীরে তার মধ্যেই। আমাকে এগোতে
দেখে সেও যেন কিছুটা এগিয়ে এলো। কোমর, পেট, বুক হয়ে কখনও গলা অবধি জলেও
নেমে গেলাম সমুদ্রজলে। কিছুটা দুঃসাহসী হয়ে যারা স্নান করে তাদের সঙ্গেই
এগিয়ে গেলাম একেবারে সামনের সারিতে।
প্রবল
ঢেউয়ের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে অবিরত স্পট জাম্প দিতে হচ্ছিল। তা সত্ত্বেও
অনেক সময়ই মাথার ওপর দিয়ে ঢেউ এসে ডুবিয়ে দিচ্ছিল শরীরটিকে। আবার ভেসে
উঠছিলাম। এইভাবেই বেশ কিছুক্ষণ কসরত চললো। এবং অনভ্যাসের কেরামতিতে একসময়ে
ক্লান্তি এলো। রণে ভঙ্গ দিয়ে ফিরে এলাম।
হলিডে হোমের নিজস্ব ক্যান্টিনে সুলভে মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা হলো। তারপর ঘরে ফিরে বারান্দায় চেয়ার টেনে বসলাম।
আজও
বারান্দা থেকে দেখছি পাশের মাঠে বিস্তর বনভোজনের আয়োজন। অনেকগুলি দলের
সন্নিবেশ। বিগত দু'দিন দেখেছি মূলত পারিবারিক চড়ুইভাতি। আজ তার চরিত্রের
পরিবর্তন ঘটেছে। আজ আর চড়ুইয়ের মতন খুঁটে খাওয়া দল নয়, এক্কেবারেই বায়স বলা
যেতে পারে।
যুব ও
মধ্যবয়সী একদল পুরুষ চা পানে ব্যস্ত। খানিক পরেই কানে এলো তাদের চাপানউতোর।
চা পান থেকে চাপানউতোর ! ভুল ভাঙলো। চা পান নয়, ও তো সুরা পান।
যাইহোক,
তাদের উদ্ভ্রান্ত মদমত্ত অবস্থা, বচসায় জড়ানো ও অতঃপর নির্বিকল্প
নির্বিকার শবাসন - সবই দেখতে বাধ্য হচ্ছি। কারণ বারান্দায় বসে যখন এই লেখা
লিখছি তখন তারাও আমার অগোচর থাকছে না আর আমিও তাদের অগোচর থাকছি না। তবে
লিখতে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না। কারণ কলকাতাতেও তো এইসব অভিজ্ঞতা সঞ্চয়
করেই বেড়ে উঠেছি। শুধু মাঝে মাঝে তাদের অনায়াস ও অভ্যস্ত সংলাপের
শব্দব্যঞ্জনায় অজান্তেই ভ্রু-কুঞ্চন হয়ে যাচ্ছে - এই আর কী।
আজ
একটি ইচ্ছা অপূর্ণ রয়ে গেলো। বায়ুস্ফীত রবারের পানসিতে ক'রে সমুদ্রের বুকে
কিছুটা ভেসে বেড়াবার ইচ্ছে হচ্ছিল। জীবনদায়ী জামা গায়ে পরে সেই উত্তেজক ও
ঝুঁকিপূর্ণ পর্যটনসুখ এই যাত্রায় আর হলো না।
আজ
অন্য একটি নতুন অভিজ্ঞতা অবশ্য সঞ্চয় হলো। ছাত্রজীবনে পড়েছিলাম উদ্ভিদের
ট্রপিক-ট্যাকটিক-ন্যাস্টিক চলনের বিষয়ে। এর মধ্যে লজ্জাবতী লতার
সিসমোন্যাস্টিক চলনের কথাও পড়েছিলাম। জেনেছিলাম অবশ্য আরও আগে। তবে চাক্ষুষ
অভিজ্ঞতা হয়নি কখনও। আমাদের হলিডে হোমের প্রাঙ্গণেই অসংখ্য লজ্জাবতী লতার
সাক্ষাৎ পেলাম। স্পর্শমাত্রই তাদের শরমকুণ্ঠিত স্পর্শকাতর সঙ্কোচন দেখে
বহুদিনের একটি কৌতূহলের নিরসন হলো। লজ্জাবতী ফুলগুলিও ভারী মনোরম - ছোট্ট
পরাগ রেনুর মতন গোলাপী - পেলব - অনুভবসুন্দর। (ক্রমশ)
সুন্দর
ReplyDelete