স্বাধীনতার মানে বুঝতে অর্ধ-শতাব্দী
পেরিয়ে গেল, তবু আজও বুঝলাম না স্বাধীনতা কী। হয়তো স্বাধীন দেশে জন্মেছি
বলে আমার মতো অনেকের স্বাধীনতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা গড়ে ওঠে নি। তবু
স্বাধীনতা অর্জনের দু'দশকের সামান্য বেশি সময়ের মধ্যে পৃথিবীতে আসতে
পেরেছিলাম বলে, স্বাধীনতার রেশ খানিকটা পেয়েছিলাম।
এই
প্রসঙ্গে মনে পড়ছে যে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এই দিনটিতে, স্বাধীনতা
সংগ্রামের অংশ নেওয়া প্রধানশিক্ষক জাতীয় পতাকা তুলতে গিয়ে প্রায় প্রতিবার
চোখের জল ফেলতেন। সেসময়ে সেই অশ্রুর তাৎপর্য বুঝতে না পারলেও, আজ বুঝি কতটা
আবেগ থাকলে এই কান্নাটি আসত তাঁর। অথবা বলতে পারি, পাড়ার সেই বৃদ্ধ
রিক্সা চালকের কথা যিনি সারাদিন বিনা পারিশ্রমিকে এদিন রিক্সা চালাতেন।
স্বাধীনতা মানে তাঁর কাছে দেশকে ভালবাসা। আর যেহেতু দেশ একটি বিমূর্ত
ধারণা, তাই দেশবাসীর জন্য সেদিন তাঁর নিজের মতো করে তিনি সেবা করতেন।
আমাদের শহরগুলির বিভিন্ন পাড়ার নামকরণের মধ্যেও কিন্তু মিশে থাকত এই আবেগ।
সুভাষপল্লি, অরবিন্দনগর, দেশবন্ধুপাড়া, নেতাজী নগর...না মহানগরের মতো
পরিকল্পিতভাবে নয়, স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই নামকরণ হয়ে যেত সামগ্রিক আবেগ থেকে।
যখন
বড় হচ্ছি তখন কিন্তু এই আবেগ ধীরে ধীরে স্তিমিত হচ্ছে। এতদিন অন্যের
মুখাপেক্ষী থাকা একটি রাষ্ট্র নিজের মতো করে নিজের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা
করছে। আবেগ সরিয়ে রেখে তাই বাস্তবের মাটিতে নেমে আসতে হচ্ছে সবাইকেই।
স্বাধীনতার আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে, দেশভাগের যন্ত্রণাকে বুকে লুকিয়ে, দাঁতে
দাঁত চেপে, চলছিল লড়াই। এঁরা হয়ত স্বাধীনতা আন্দোলনে সেভাবে অংশ নেন নি
অথবা স্বাধীনতার সময় ছোট ছিলেন। অন্যদিকে, যে মানুষগুলি প্রত্যক্ষভাবে
লড়েছিলেন স্বাধীনতার জন্য, তাঁরা ধীরে ধীরে বৃদ্ধ হচ্ছিলেন। কিন্তু
স্বাধীনতা উত্তর একটি নবরাষ্ট্রে একটু ভাল থাকবার জন্য স্বাধীনতা আন্দোলন ও
দেশভাগের অভিঘাত যাঁদের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে পড়েছিল, উভয়েই
রাষ্ট্রের গোলামি করছিলেন সেসময়। উদ্দেশ্য একটিই যে, দেশকে স্বমহিমায়
প্রতিষ্ঠা করা। তাই স্বাধীনতা দিবস নিয়ে আলাদা করে আদিখ্যেতা দেখাবার তাদের
মন ও মানসিকতা হয়ত বা ছিল না, কেননা তারা জানতেন যে, স্বাধীনতা শব্দটি
তখনই সার্থক হবে যখন নিরন্ন দেশবাসী বলে কোন শব্দবন্ধ থাকবে না।
তৃতীয়
প্রজন্মের আমরা এক অদ্ভুত সন্ধিক্ষণের সাক্ষী। দ্রুত বদলকে আমাদের মতো কেউ
প্রত্যক্ষ করে নি। এই প্রজন্মের একজন হিসেবে রেডিও, ট্রানজিস্টার,
গ্রমাফোন রেকর্ড দেখেছি, আজ ও এল ই ডি টিভি দেখছি। ল্যান্ড ফোনের তার বসাতে
যেমন দেখেছি, এখন ওঠাতেও দেখছি। অতি দ্রুত বদলে যাওয়া সময়ের প্রবল
সাক্ষী হিসেবে আমাদের অবস্থান স্বাধীনতার যৌবন থেকে বৃদ্ধ হওয়াতে। আর এই
বদলে যাওয়া সময়ে স্বাধীনতা দিবসের অর্থও বোধহয় বদলেই গেল!
এখন
সত্যি বলতে দেশে চতুর্থ প্রজন্ম এসে গেছে। এই প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতা
বলতে হয়ত একটি দিন মাত্র, যেদিনটায় পতাকা তোলা হয়, দেশাত্মবোধক গান গাওয়া
হয়, দোকানপাট বন্ধ রাখা হয় আর নিছক ফূর্তি করা হয়। তাই বাইক বা গাড়িতে
ফ্ল্যাগ লাগিয়ে হৈ হৈ করলেই হল। কখনও সেই হৈ হৈ এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে,
পুলিশ প্রশাসন নাক গলাতে বাধ্য হয়। দিনভর নানা অনুষ্ঠানে ছবি তুলে, সোস্যাল
মিডিয়াতে সেই ছবি পোস্ট করে স্বাধীনতা দিবস পালন কোন তাৎপর্য নিয়ে আসছে?
নাকি আর পাঁচটা হুজুগের মতো এটিও একটি হুজুগে পরিণত হয়েছে? এই একটি দিনে
দেশাত্মবোধক গান শুনবার মাত্রা বেড়ে যায়। পাড়ায় পাড়ায় নানা অনুষ্ঠানে
চলতে থাকে এই জাতীয় সঙ্গীত। মুখে তিন রং স্টিকার লাগিয়ে ঘুরতেও দেখা
যায় অনেককে।
আর
এখানেই প্রশ্নটা এসে যায়, স্বাধীনতা শব্দটির অর্থ কী? দিন বদলের সঙ্গে
শব্দের অর্থ বদলালেও মাত্র তিন প্রজন্মের মধ্যে স্বাধীনতা মানেটি এভাবে
পাল্টে যাবে তা কি কেউ ভেবেছিলেন কখনও? কেন স্বাধীনতা দিবস, কী করে এলো
দিনটি...সেই তাৎপর্য বুঝবার বোধটুকুও বোধহয় আমরা হারিয়েছি। সেজন্যই,
স্বাধীনতা দিবস আলাদা করে কিছু নয়, একটা ছুটির দিন মাত্রে পরিণত হয়েছে
অধিকাংশ মানুষের কাছে। না, কাউকে দোষ দিচ্ছি না। দোষ গুণ ইত্যাদি
ব্যাপারগুলি আদতে আপেক্ষিক। দোষ কাকে দেব? দিলে নিজেদেরকেই দিতে হয়।
আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে আমরাই ঠিকঠাক বোঝাতে পারিনি স্বাধীনতা দিবস
ব্যাপারটি কী ও কেন। দ্রুত বদলে যাওয়া সময়ের তীব্র বেগে আমরা নিজেরাই
দিশাহারা হয়ে গেছি!
অর্ধ
শতাব্দী পেরিয়ে এসেও স্বাধীনতার মানে তাই বুঝতে পারি না। কিংবা বুঝলেও
সংশয়ে ভুগি এই ভেবে যে, যা শুনেছি নাকি যা দেখেছি বা যা দেখছি...কোনটা
স্বাধীনতা? ইংরেজরা দেশের শাসনভার আমাদেরকে দেবে...এক আমলে এই ছিল
স্বাধীনতা। জাতীয় পতাকাকে দেখে আবেগে অশ্রু বিসর্জন ও দেশের হিত সাধনে
রাষ্ট্রের গোলামি... কখনও এটাও স্বাধীনতা মনে করা হত। দেশপ্রেম,
আত্মবলিদানের কথা মনে রেখেও নিজের মতো করে থাকা...হয়ত এটাও স্বাধীনতা।
আবার, উদ্দাম একটা দিন, অর্থহীন উল্লাস...হতে পারে স্বাধীনতা এটিও!
তবু,
ছোট্ট মেয়েটি হাতে তিন রঙের সেই ছোট্ট পতাকাটা তুলে নেয়, ডাগর চোখে
তাকায়। আধো বুলিতে স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা জানায়। পরম যত্নে তার
মাথায় হাত রাখি....
মন ভরে যায় এক অনির্বচনীয় আনন্দে।
হয়ত এটাই স্বাধীনতা.....
Post A Comment:
0 comments so far,add yours