fiture
দেবর্ষি মজুমদার, লেখক, বীরভূম:

 শ্রীনগর গুফকার রোড । যেন দিল্লির ১০ জনপথ!  গুফকার নীচেই সোনওয়ার বসতি। ওখান থেকে জাস্ট ১০ মিনিটের হাঁটা পথ। দেখা যাবে কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আব্দুল্লার বাড়ি। আমদের গন্তব্য ওখানে নয়। গন্তব্য সোনওয়ার বসতি এলাকায়।  ওখানেই বাস করেন পঁচাত্তর বছর বয়সের বৃদ্ধ আলী মুহাম্মদ। ব্যবসা ট্রান্সপোর্টের। জম্মু শ্রীনগর রুটে তাঁর বেশ কয়েকটি বাস চলাচল করে। তাঁর স্ত্রী বিয়োগ আগেই হয়েছে।  দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে সাজাদ হামদানি। বিশ্বভারতীর কলাভবনের অধ্যাপক তিনি। 
চারদিন হল কাশ্মীরের পুরো পরিস্থিতি ভিন্ন, উত্তেজনা পূর্ণ। তাই বাড়ির জন্য চিন্তা হলেও, উদ্বিগ্ন নন হামদানি সাহেব। থাকেন শান্তিনিকেতন এলাকায়। তিনি জানান, এটা নতুন কিছু নয়। মাত্র চার দিনে পড়েছে। ছোট বেলায় একটানা কুড়িদিন কারফিউ দেখেছি। কাশ্মীরীরা জানে এই সময় কি করতে। ৬ মাসের চাউল আমরা আগে থেকেই মজুত করে রাখি। সিটিতে কিছু অসুবিধা হতে পারে। কিন্তু গ্রামে কোন অসুবিধা হয় না। তিনি বলেন, সমস্যাটা অন্য জায়গায়। কারফিউ, জঙ্গী হানা আর কারফিউয়ে ৩০ বছর ধরে বাবার মত অনেকের ট্রান্সপোর্ট সহ বিভিন্ন ছোটখাটো ব্যবসা ধাক্কা খাচ্ছে। পর্যটন বন্ধ। এরকম চলতে থাকলে মানুষ বাঁচবে কী করে?  সাজাদ হামদানির একটু পরিচয় দেওয়া ভালো। আম আদমির থেকে তাঁর দৃষ্টিকোন  আলাদা। জন্ম সূত্রে  কাশ্মীরী। একজন অধ্যাপক। আবার শিল্পী। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক এবং তারপর কলাভবন থেকে স্নাতকোত্তর করেন তিনি। তাঁর কথায় উঠে আসে
কাশ্মীরীদের স্বপ্ন ও ব্যর্থতার কথা।  তিনি জানান, ৩৭০ ধারা তুলে লাভ কি ক্ষতি সেটা ভবিষ্যত বলবে। আমরা জাস্ট ফেড আপ। আমরা চাই এই সমস্যার একটা স্থায়ী সমাধান।  তারপর বলতে থাকেন, আমার প্রজন্মের ৭০ শতাংশ মানুষ তো মারা গেছেন।  কেন তা  আপনারা জানেন।  ৩০ শতাংশ আছে যারা চেষ্টা করছে এই সমস্যার মধ্যে থেকে এগিয়ে যেতে। আমার তিনটে ব্যাচমেট ছিল।  তার মধ্যে একজন আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। আরেকজন  শ্রীনগর আর্ট কলেজে পড়ান। কাশ্মীরের অবস্থা ঠিক থাকলে এরকম অনেক কিছু হতে পারত। আপনি বুঝতে পারছেন, আমি কি বলতে চাইছি?  এখন তো মাছি বর্ডার পেরোতে পারে না। দক্ষিণ এশিয়ায় যদি দ্বন্দ্বগুলো না থাকতো,  অনেক স্বাধীনভাবে ঘুরতে পারতাম।  ইউরোপে দেখুন, একটাই কারেন্সি আছে। এক জায়গা থেকে এক জায়গায় কাজ করতে যেতে পারছে।  ইস্টার্ন ইউরোপ থেকে একেবারে শেষ পর্যন্ত যেতে পারবেন। একই টাকা চালাতে পারবেন। কোথাও বর্ডারে এমন সমস্যা নেই। আপনি ইটালি, ফ্রান্স, পোল্যান্ড যান কোন অসুবিধা নেই।  জীবনটা তো মাত্র ৬০- ৭০ বছরের।  আপনি সব সময় যদি চাপের মধ্যে থাকেন,  নিজের মানসিকতার উন্নতি হলো না, দেশের উন্নতি কী করে হবে?  ? রাগ, আক্রোশ, নিরক্ষরতা, হিংসা থাকবে, তাহলে উন্নতি কী করে হবে? যে দিকে তাকাই, শুধু রাগ আর হিংসা। তাহলে সৌন্দর্য্য কোথায় থাকবে? কাশ্মীরে সব রকম সম্ভবনা ছিল। কাশ্মীরে আমার বাড়ি থেকে যদি হাঁটতে শুরু করতাম, তাহলে পাকিস্তান, পাকিস্তান থেকে আফগানিস্তান, সেখান থেকে ইরান। ইরান থেকে তুর্কি। তুর্কি থেকে ফ্রান্স। স্রেফ হেঁটে হেঁটে যেতে পারতাম। আমার এক বন্ধু আছে।  ইংল্যান্ডের লোক। তার নাম  তারা সিং বিরিয়ানা। ছোট বেলায় বাড়ি থেকে পালিয়ে ইংল্যান্ড পৌঁছে গেছিল।  ওখানে প্রতিষ্ঠিত হয়। তারপর একদিন ইচ্ছে হল, নিজের গ্রামে যাবে।  ইংল্যান্ড থেকে হাঁটতে শুরু করে। হেঁটে হেঁটে লাহোর থেকে ওয়াঘা বর্ডার হয়ে পাঞ্জাবে বাড়ি পৌঁছায়।  ৫৪০ দিন লাগে বাড়ি পৌঁছাতে। এটা ছিল ওর জীবনের একটা এডভেঞ্চার।  ওকে জিজ্ঞেস করি, কেমন অভিজ্ঞতা হল? ও বলেছিল, আমি যেখানে গেলাম, মানুষের সাথে মিশলাম। দেখলাম মানুষের মনটা বিশাল।  সবাই সাহায্য করেছে, করবে। কোন জাতি, ধর্ম নিয়ে কোন গল্প নেই। কথার সুতো টেনে বললেন,  আমিও অহিংস লোক। তার জন্য আমি শান্তিনিকেতনে আছি। রবীন্দ্রনাথের গোরা উপন্যাস আমি পড়েছি। অবশ্য সেটা ইংরেজি অনুবাদ।  রবীন্দ্রনাথ বুঝতেন উগ্রজাতীয়তাবোধ থেকে মানবতা পৃথিবীর সব থেকে বড় জিনিস।  সেখানে একজন ব্রাহ্ম নেতাকে গোরা বলছেন, আপনি আমাকে আজ সেই দেবতার মন্ত্র দিন। যিনি হিন্দু, মুসলমান খ্রিষ্টান সকলের। একদিন গোটা বিশ্বকে ভারত শান্তির বার্তা দিত।  এখন দেশ থেকে সেটা চলেই যাচ্ছে। কাশ্মীরী নতুন প্রজন্মকেও দেখে আমার অবাক লাগে। ওদের মাথায় কি যে ঢুকে গেছে । আমি বুঝতে পারি না! বিশ্বভারতীতে মাঝে মাঝে কাশ্মীরী ছাত্ররা আসে। কিন্তু নিজস্ব সংস্কৃতি সম্পর্কে ওদের কোন ধারনা নেই। একজন ছাত্রকে জিজ্ঞেস করলাম ইংরেজী শব্দ কাইটের কাশ্মীরীটা  জানো? ওতো জানে পতঙ্গ।  ওরা জানে  না কাইটের কাশ্মীরী শব্দ ‘গাঁট ব্রেয়ার’। যখন ছোট ছিলাম তখন, পাহাড় ও ক্ষেতে ৬ রকমের শাক নিয়ে আসতাম।  নিজে থেকেই হত।  খেতে খুব সুস্বাদু।  নতুন প্রজন্ম জানে না।নিজে থেকেই হত।  খেতে খুব সুস্বাদু।  নতুন প্রজন্ম জানে না। কোন ধর্ম মানুষকে হিংস্র করে না। মানুষ ধর্মের নামে এসব করছে। মানুষের ঐতিহাসিক সত্যকে  বোঝে না।  যদি এখন কোন বিশেষ ধর্মীয় রেলিকসকে ভেঙে দেখি, তার মধ্যে একের পর কোন না কোন ধর্মের সাইন বা চিহ্ন পাবো।  এভাবে দেখতে থাকলে পাঁচ হাজার বছরের পুরানো প্যাগান সংস্কৃতিকে পাবো। এগুলো নিয়ে ঝগড়ার বিষয় নয়, সমৃদ্ধ হওয়ার বিষয়। ধর্ম পরিবর্তিত হতে পারে। কিন্তু সংস্কৃতির পরিবর্তন হয় না। 
এখন তো হিন্দু সংস্কৃতি বলতে একটা জেনারেলাইজেশনের রূপ পায়।  কিন্তু এক সময় কাশ্মীরকে জ্ঞানের জন্য সারদাপীঠ বলা হত।   অষ্টম শতাব্দীর অভিনব গুপ্তা, আনন্দ বর্ধনের মত দার্শনিকরা ওখানে ছিলেন। কলহনের রাজতরঙ্গনী পড়লে বুঝতে পারবেন একদিন হিন্দু বেশি ছিল, আজ মুসলিম। কিন্তু সংস্কৃতি পাল্টায় নি। হরপ্পা মহেঞ্জাদাড়োর পুরাতত্ত্ব আমরা শিখব। হতে পারে তাদের একটা ধর্ম ছিল। কিন্তু এতদিন পর সেটা পুরো দেশের উপর লাগু হবে এটা হয় না।  কোন রাজ‍্যে বা কোন দেশে কোন ধর্মাবলম্বী সংখ্যাগরিষ্ঠ হলে  বাকিদের সেটা মেনে  চলতে হবে বা  প্রভূত্বকারী হতে হবে এটা ঠিক না।  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই ধর্মের বেড়াজালে ছিলেন না। উনি আসল মানুষ ছিলেন। তাঁর কাছে দেশ নয়,  পৃথিবী বড়ো ছিল। মানুষ ও মানবতা বড়ো ছিল। ভারতের মধ্যে যে বৈচিত্র তা পৃথিবীর কোথাও নেই। ৪০ কিমি ব্যবধানে ভাষার পার্থক্য দেখা যেতে পারে।  আমাদের  জম্মু কাশ্মীর লাদাখে ১২টি ভাষা আছে। যা অন্যর থেকে আলাদা। আসলে ভারতের মূল সুর বহুত্ব। এটা না থাকলে ভারতের স্বাদই থাকবে না।  একটা কথা শুনছি, কল কারখানা হবে। এটা ঠিক হবে না। কাশ্মীর বড় জায়গা নয়। ৭২ মাইলস ব্যাসের জায়গা।  ওখানে গাছপালা, পাহাড়, নদী প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের জায়গা। ভূস্বর্গ , জান্নাত বলে লোকে। নরক হয়ে যাবে।  ওখানে ফ্যাক্টরি করে কী জায়গাটা নষ্ট করে দেবেন? এটা একটা অজুহাত।  এটা হলে জেনোসাইড হবে—মানুষ ও প্রকৃতি এক সাথে শেষ হবে।  যদি এলাকা শান্ত থাকত কাশ্মীরীরা ব্যবসা করত।  আমি আমার ঘরে টিভি লাগাব সেটা চিন থেকে চেন্নাই, ব্যাঙ্গোলর হয়ে দিল্লী, কোলকাতা হয়ে কাশ্মীরে আসছে। বর্ডারে ট্রেড খুললে ১২ ঘন্টায় জিনিসপত্র চলে আসবে।  কিন্তু সন্ত্রাসবাদ বাড়ছে  সমস্যার জন্য।  সমস্যা মিটলে  বর্ডার খুলতো। ট্রেড হতো ।  সসারের মত এই ভ্যালি। দূষণ হলে, ওখানে থাকা যাবে না।   ওখানে ৫ থেকে ৬ পাওয়ার প্ল্যান্ট চলছে। বিভিন্ন জায়গায় ড্যাম হয়েছে। ২০১৩ সালে বন্যা হয়। কারণ কী? প্রকৃতির সাথে অন্যায় করলে। সেটাই হবে।  অথচ ফল, পর্যটন যথেষ্ট কাশ্মীরের উন্নতির জন্য। থাইল্যাণ্ড তো পর্যটন নিয়ে ভালোভাবেই বেঁচে আছে।  হেরিটেজের জায়গা কাশ্মীর।  কাশ্মীরে শুধু আপেল নয়,  উদ্ভিদের অনেক বৈচিত্র আছে। কাশ্মীরকে কেউ আবিষ্কার করে নি। করতে চায় নি। আমাজন যেমন ভাবে এক্সপেরিমেন্টের জন্য হারিয়ে যাচ্ছে। কাশ্মীরে সেটা হলে, কাশ্মীরও একদিন হারিয়ে যাবে।  আমাদের ভারতের যে শান্তির বাণীর জন্য বিশ্বজোড়া খ্যাতি ছিল। গত বছর একটি সাইকোলজিক্যাল স্টাডি পড়েছিলাম। সেখানে বলা হয়েছে, ভারত হতাশায় ভুগছে। কেন জানেন? নিজস্বতা হারালে এই মানসিক বৈকল্য আসে।  (চিত্রঃ না অন কংটালান্যান্ট থাইল্যান্ড)       
            
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours