ভবানীপ্রসাদ ভট্টাচার্য্য, ফিচার রাইটার, দুর্গাপুরঃ
আর একজন মানুষের কথা না বললে 'মানকর বৃত্তান্ত ' অসম্পুর্ন থেকে যাবে! তিনি হলেন 'ক্ষেপা ডাক্তার ' নিত্যগোপাল ভট্টাচার্য্য!
ভাল্কী গ্রামের সাহিত্যিক জীতেন্দ্র নাথ বন্দোপাধ্যায় তাঁর 'হর পার্বতী সংবাদ ' প্রবন্ধে মানকরের ডাক্তার নিত্যগোপাল ভট্টাচার্য্যের বিচিত্র চিকিৎসার বিবরন লিপিবদ্ধ করেছেন! নিত্যগোপাল ছিলেন তৎকালের এল,এম,এফ, ডাক্তার এবং কালী সাধক!
তিনি কোলকাতার বিখ্যাত ডাঃ এস,কে, সুররায়ের ছাত্র ছিলেন! সেই সময়ে নিত্যগোপালের সমকক্ষ কোন ডাক্তার মানকর এলাকায় ছিল না! লোকে তাঁকে ক্ষেপা ডাক্তার বলতেন কারন তিনি পালকীতে চড়ে রুগী দেখতে যেতেন!কখনো এক পায়ে চটি পরে, তো কখনো ধুতির বদলে মশারী পরেই রোগী দেখতে কলে বেরতেন! কখনো কখনো কালী সাধনায় বসে থাকতেন , রোগী দেখতে বেরতেন না! স্ত্রী যদি বলতেন ঘরে চাল বাড়ন্ত ,তবেই রোগী দেখতে বেরতেন! তিনি ছিলেন ধন্বতরী চিকিৎসক নির্ভুল রোগ নির্নয় করতেন!অব্যর্থ ওষুধ দিতেন!
একদিন পালকী চড়ে একটি ছেলে বিয়ে করতে যাচ্ছে, তাকে দেখেই নিত্যবাবু বললেন " কেন বাবা পরের মেয়ের সর্বনাশ করতে যাচ্ছো? তুমি তো আজকের রাত পেরবে না! বরযাত্রীরা বলে উঠলো ক্ষেপা ডাক্তারের কথা বাদ দে ...বলে কিনা রাত পেরবে না! চল চল! নিত্য ডাক্তার বললেন, যাচ্ছো যাও, কিন্তু ওই পাত্রটির জল পিপাসা পেলে জল খেতে দিও না , জল খেলেই মরবে!
পরের দিন সেই পাত্র বউ নিয়ে ফিরছে! কয়েক জন বিদ্রুপ করে বলল, চল ক্ষেপা ডাক্তারকে দেখিয়ে নিয়ে যাই পাত্র মরেনি বৌ নিয়ে ড্যাং ড্যাং করে ফিরেছে!
নিত্যবাবু অবাক হয়ে বললেন তাইতো হে, এতো দিব্যি বেঁচে আছে! এরপর জিঞ্জাসা করলেন, " রাস্তায় খুব পিপাসা পায়নি?" বেয়ারা বলল, " পেয়েছিল কিন্তু জল কোথায় পাবো, কাছেই একটা আখের ক্ষেত থেকে একটা আখ ভেঙে তার রস দিয়েছিলাম!"
নিত্যবাবু বললেন, " চল হে আমাকে আখ বাড়ীটা দেখতে হবে, কি আছে ওখানে" আখ ক্ষেতে গিয়ে বললেন, আখ গাছের ঝাড়টা ওপড়াও আখ গাছের নীচে দেখা গেল এক জোড়া কেউটে সাপ!
উনি বললেন," এ রোগের ওষুধ বের হয়নি, সাপের বিষ আখ গাছে সংক্রামিত হয়েছে সেই রস খাওয়ায় ছেলেটি সুস্হ হয়ে গেছে! বাকী গাছগুলি এ রোগের ওষুধ! এগুলি ভবিষ্যতে কাজে লাগবে!
একবার কলে গিয়ে রোগীর বাড়ীতে গিয়ে রোগী না দেখে নিত্যবাবু পেয়ারা গাছে উঠে পেয়ারা খাচ্ছেন, বাড়ীর লোক জিঞ্জাসা করলো,ডাক্তার বাবু রোগী দেখবেন না? তিনি বললেন, " তোমাদের রোগী ভাল হয়ে যাবে, কিন্তু বারান্দায় যে কাসলো সে তেরাত্রি বলবো না! সত্য সত্যই তিনি দিনের আগেই লোকটা মুখে করে উঠে মারা গেল!
আর একবার নিত্যগোপাল রুগী দেখতে যাচ্ছেন, মাঝ রাস্তায় দুজন লোক বলল, " ডাক্তার বাবু আপনি ফিরে যান, রোগী মারা গেছে! নিত্যবাবু বললেন, " ওহে, ঘরে আমার মুদ্রা ক'টা চাই ঘরে চাল বাড়ন্ত, খাবো কি? চল হে মড়াটাকেই দেখে যাই ! রোগী না দেখে মুদ্রা নেবো কি করে?"
তখন শ্মশান যাত্রার তোড়জোড় চলছে, ডাক্তারবাবু বললেন, "মড়াটা একবার খোল হে, না দেখে মুদ্রা নেবো কি করে?মড়ার নাড়ী দেখে নিত্যবাবু তো রেগে আগুন, তোমরা তো সাংঘাতিক লোক জ্যান্ত মানুষটা পোড়াতে যাচ্ছিলে? আমি তোমাদের নামে কেস করবো" !বাড়ীর লোকদের বললেন, " দয়াকরে কাঁদবেন না , রোগী আধঘন্টার মধ্যে কথা বলবে"! জিভে কয়েক ফোঁটা ওষুধ দিতেই সত্যিই আধ ঘন্টার মধ্যে রোগী উঠে বসল!
আসন্ন মৃত্যু পথযাত্রী রোগীর প্রেসক্রিপশন লিখতেন, কাঠ, কুচি, কলসী, কড়ি ইত্যাদি! কোন রোগী দেখতে গেছেন, বাড়ীর লোক বলল " ডাক্তারবাবু রোগী ছটফট করছে, ডাক্তারবাবু বুঝলেন রোগীর বাঁচার আশা নেই!
তিনি বলতেন," আমি চলে গেলে তোমরাও ছটফট করবে " সত্য সত্যই রোগী মারা গেল! তাঁর মতো চিকিৎক সত্যিই বিরল! তাই আজও তাঁর চিকিৎসা পদ্ধতি লোকের মুখে মুখে ফেরে!
নিত্যবাবুর পুত্র গিরিজা শংকর ভট্টাচার্য্য ( চানুবাবু) স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন! ভারত সরকার স্বাধীনতা সংগ্রামীর স্বীকৃতি স্বরূপ 'তাম্রপত্র ' ও পেনশন প্রদান করেন!স্বনাম ধন্য স্বাধীনতা সংগ্রামী ফকির চন্দ্র রায়ের সাথে স্বদেশী আন্দোলন করে তিনি কারাদন্ড ভোগ করেন!
( চলবে)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours