kash,ir ki koli
কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:



যদি হয় আপনার কাশ্যপ গোত্র তাহলে সাবধান।
অনেকেই এখন উর্ধ্ববাহু। কারোর খোয়াব ঝেলমের পাড়ে বাড়ির। আবার কেউ আরও একধাপ এগিয়ে। তাদের আবার বাড়ির সঙ্গে নারীও চাই। তাও আবার কাশ্মীর কী কলি। আসলে সেই কোন যুগে শাম্মি কপুর 'কাশ্মীর কী কলি'র নেশা ধরিয়ে দিয়ে গেছিল, আজও তা নামেনি। দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেছে পঞ্চান্ন বছর। এতদিন তা ঘাপটা মেরে লুকিয়েছিল মগজের ভেতরে। এখন সুযোগ বুঝেই ফোঁস করে ফনা মেলেছে। সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে, এই অতি উৎসাহী মানুষরা ধরেই নিয়েছেন, তাঁদের উচ্চাশাপূরণের ব্যবস্থা করে দিয়েছে মোদি সরকার। তিনশো সত্তর ধারা তোলাই হয়েছে কাশ্মীরে তাঁদের বংশবিস্তারের সুপ্ত মনোকামনা পরিতৃপ্তির জন্য।

কিন্তু আপনি ভুল করেও ওই অতি উৎসাহীদের দলে নাম লিখিয়ে বসবেন না যেন। বিশেষ করে আপনার গোত্র যদি কাশ্যপ হয়। সর্বনাশ হবে। কাশ্মীর আপনার গুরুগৃহ। ঋষি কাশ্যপের বাস ছিল ওই কাশ্মীর উপত্যকাতেই। আপনার পূর্বপুরুষরা ছিলেন তাঁর শিষ্য। আর হিন্দুশাস্ত্র মতে, গুরুকূল শিষ্যরা সমগোত্রীয়। তাঁদের পারস্পরিক সম্পর্ক ভ্রাতৃত্বের। আজ যাঁরা কাশ্মীরবাসী তাঁদের অনেকেই হতে পারেন আপনার গুরুভাই। কাশ্যপ গোত্রের মানুষজন। সবর্ণে প্রজাপতির নির্বন্ধ নিষিদ্ধ, হিন্দু শাস্ত্রমতে। সুতরাং গায়ে বিধর্মীর লেবেল লাগার আগেই সতর্ক হোন।

কাশ্মীর শব্দটা এসেছে কাশ্যপমার থেকে, এমনটাই প্রবাদ। এর তথ্যনিষ্ঠ ইতিহাস, ভূগোল নিয়ে তর্ক বাঁধতেই পারে। তবে দ্বাদশ শতাব্দীর রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থতে সেরকমই বলা হয়েছে। কাশ্যপমার- এর অর্থ কাশ্যপের বাস। এই মত মানতে রাজি না কিছু ইতিহাসবিদ। তাঁদের মত, কাশ প্রজাতির মানুষরা এই উপত্যকায় ঘর বেঁধেছিলেন। সেই সূত্রেই জায়গার নাম কাশ্মীর।

প্রশ্ন একটাই, এমন কী করেছিলেন কাশ্যপমুনি যে তাঁর নাম থেকেই গোটা উপত্যকার নাম হয়ে গেলো কাশ্মীর? রাজতরঙ্গিনী পাতা ওল্টালেই প্রশ্নটির জবাব মিলবে।

তীর্থ করতে বেরিয়েছিলেন কাশ্যপমুনি।
রজৌরি হয়ে ঘুরতে ঘুরতে তিনি নওকাবাদানে পৌঁছন। স্থানীয় মানুষরা তাঁকে ঘিরে ধরে। হাতজোড় করে বলেন, "বাঁচান মুনিবর। দৈত্যের ভয়ে অতিষ্ঠ আমরা।" ওই মানুষরা ঋষিকে জানান, মেরু পর্বতমালায় ঘেরা এক বিশাল সরোবরে এক দৈত্যের বাস। জলেই ঘরবাড়ি, তাই ওই দৈত্যের নাম জলোদ্ভব। এলাকার মানুষের মধ্যে সে আতঙ্ক তৈরি করেছিল। হাতের সামনে কোনও প্রাণীকে পেলেই মেরে ফেলতো। তার ভয়ে কেউ ওই সরোবরের আশপাশে যেতেও সাহস সেতো না। দৈত্যের ভয়ে ভীত, সন্ত্রস্ত মানুষগুলো কাশ্যপমুনির কাছে করজোড়ে প্রার্থনা জানালো, আমাদের সহায় হোন মুনিবর। ওই দৈত্যকে মেরে আমাদের বাঁচান।
মন গললো কাশ্যপমুনির। সম্মুখসমরে ডাকলেন সরোবরের দৈত্য জলোদ্ভবকে। শুরু হলো এক ভয়ঙ্কর লড়াই। দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেল নাগাড়ে এক হাজার দিন। তবু জলোদ্ভবকে বধ করা তো দূরঅস্ত, বাগেও আনতে পারলেন না ঋষিবর। পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার আশীর্বাদ। জলোদ্ভব ছিল ব্রহ্মার আশীর্বাদ ধন্য।

অতঃপর পুত্র অনন্তনাগের সঙ্গে পরামর্শে বসলেন ঋষি। ঠিক হলো, প্রথমেই ওই সরোবরকে জলশূন্য করতে হবে। খবর পেয়েই বিষ্ণুদেব এগিয়ে এলেন কাশ্যপের সাহায্যে। তিনি ত্রিশূল দিয়ে  চিড়ে দিলেন
উপত্যকার পশ্চিম দিকে বারামুল্লার পাহাড়ের বুক। হু-হু করে জল বেরোতে লাগলো সরোবর থেকে। জল কমতেই, আর নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারলো না জলোদ্ভব। লক্ষণ ভালো ঠেকলো না। তখনই সে আশ্রয় নিলো পর্বতের তলায়। খোঁজ আর খোঁজ। এক হাতে সূর্য অন্য হাতে চন্দ্র বিষ্ণুর। ঘটনার গুরুত্ব বুঝে ছুটে এলেন পার্বতী। তিনি গোটা পর্বতটা দিয়েই চাপা দিয়ে দিলেন জলোদ্ভবকে। সেই পর্বতে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে প্রাণ গেলো দৈত্যের। জলোদ্ভব নিধনের পরেই জয়ধ্বনি দিয়ে উঠলো এলাকার মানুষ। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সবাই।

যে পর্বতের তলায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ গেলো ভয়ঙ্কর দৈত্যের, তার নাম হলো হরি পর্বত। আর ওই ঘটনার পরেই জায়গার নাম হলো কাশ্যপমার। মানে, কাশ্যপের ঘর। তার থেকে কাশমার। শেষ পর্যন্ত কাশ্মীর।
বুদ্ধধর্মেও প্রায় একই ধরনের ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে আবার কাশ্যপমুনির সঙ্গে নাম জুড়ে গেছে মঞ্জুশ্রীর। সে সময় এক বিশাল ভূখণ্ড জুড়ে ছিল অগাধ জলরাশি। কাশ্যপমুনি আর মঞ্জুশ্রী হাতে হাত মিলিয়ে ওই এলাকাকে জলমুক্ত করলেন। সেখানে যে দুটি জনপদ তৈরি হলো, তার নাম হলো তিব্বত আর নেপাল।
ভূতাত্ত্বিক গবেষকরাও কিন্তু প্রায় একই ধরনের কথা শুনিয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য, হিমালয় সংলগ্ন এক বিশাল এলাকা সুদূর অতীতে ছিলো জলের তলায়। ওই সাগরের নাম ছিল টেথিস। একইসঙ্গে ওই এলাকা ছিলো ভূমিকম্পপ্রবণ। তার জেরেই ফাটল ধরে পর্বতমালায়। তৈরি হয় জল বেরনোর রাস্তা। জেগে ওঠে ডাঙা।

জলোদ্ভব নিধনের পর ওই সরোবরের পাড়ে যেতে আর কোনও বাধা রইলো না। শোনা যায়, সেখানে গুরুকুলও খুলেছিলেন ঋষি কাশ্যপ। প্রকৃতির সৌন্দর্যের টানে আকর্ষিত হলেন দেবাদিদেব মহাদেবের। তিনি হামেশাই সতীকে নিয়ে ওই সরোবরের পাড়ে আসতেন নির্মল বায়ু সেবন করতে। ঋষির দৃষ্টি এড়ালো না সেই ঘটনা। একদিন তিনি ওই সরোবর দান করে দিলেন সতীকে। সেই থেকে মেরু পর্বতমালায় ঘেরা ওই সুরম্য সরোবরের নাম হলো সতী সার। আবার দেবী গৌরীর পছন্দের জায়গা ছিল শ্রীনগর। গণেশের হাত ধরে তিনি আসতেন শ্রীনগরে। যে রাস্তা দিয়ে তিনি আসতেন, তার নাম হয়েছিল গৌরী মার্গ। পরে তা হয়ে দাঁড়ায় গুলমার্গ।

কাশ্মীর উপত্যকায় প্রতিষ্ঠা হয়েছিল নাগবংশের। সেই সূত্রেই উপত্যকার অনেক জায়গার নামের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে নাগ শব্দটা। যেমন অনন্তনাগ, কমরুনাগ, বেরিনাগ। এই নাগেদের পিতা ঋষি কাশ্যপ। তাঁর তেরোজন স্ত্রীর মধ্যে একজন ছিলেন কদ্রু। তাঁর গর্ভেই নাগ জন্মায়। ঋষি কাশ্যপের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে কাশ্মীর উপত্যকায় নাম। নীলমাতা পুরাণের মত, এই উপত্যকাতেই বাস ছিল গিরিরাজকন্যা উমার। এছাড়াও বিভিন্ন দেবদেবীর যেন অগাধ বিচরণ ছিল গোটা উপত্যকা জুড়ে। তাই বোধহয় কাশ্মীরের মাথায় ভূস্বর্গের রাজমুকুট।

এবার ভেবে দেখুন কী করবেন। শয়নে স্বপনে শুধুই কি কাশ্মীরের মেয়েদের দেখবেন? কিন্তু সন্দেহ অন্যখানে, আপনি সেই কাশ্মীরসুন্দরীর মনে ধরবেন তো? আবার উল্টো ঘটনাও ঘটতে পারে। কাশ্মীরের ছেলেরাও দেখতে দারুণ। আপনার পাশের বাড়ির মেয়েটার নজরও এবার পড়তে পারে তাদের ওপর। শেষ পর্যন্ত আপনার একুল ওকুল, দুকুল না হারাতে হয়!
 


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours