স্বাতী রায়, লেখিকা ও চিত্রগ্রাহক, কলকাতা:
এক...
" হাঁ দিদি, বোলা। রেখা বোলাতানি।
...... লোকাল থানে মে যাইঁ পড়ি। আপলিকেসন লিখি কি নাহি?
..... আচ্ছা, হাম আওয়াতানি।"
সস্তার মোবাইল ফোন টা রেখে এক গাল হেসে রেখা বলল " কা বোলি দিদি, ই ফোনুয়া যব সে আ গাইল, হামার চ্যান নাহি, পুছো কা পুছাতানি"
"কাট,
কাট" শুনে বুঝলো প্রিয়া, ক্যামেরা রোলিং ছিল। এহ, আবার ডিরেক্টরের ঝাড়
খেতে হবে। বড্ড বদমেজাজি এই ডিরেক্টর। যদিও তার বয় ফ্রেন্ড, কিন্তু ফিল্ডে
এক ফোঁটাও রেয়াৎ করে না।
কাচুমাচু মুখে ক্যামেরাম্যান
বিশ্বজিতকে একবার তারপর শমীকের দিকে তাকালো। যাক বাবা, দুজনেই মন দিয়ে
ক্যামেরায় দেখতে ব্যস্ত। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রেখার দিকে মন দিল প্রিয়া,
অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর। জুতোসেলাই থেকে চণ্ডিপাঠ সবই দেখতে হয়, আসলে
ভূমিকা স্পট বয় থেকে প্রোডাকশন ম্যানেজার সবই।
দুই..
মহিলা
জাগরণ মঞ্চ নামে এক ইউ পি বেসড এনজিওর জন্য ডকুমেন্টারি শুট করতে বেনারস
আসা। বেশ ইন্টারেস্টিং প্রজেক্ট - মহিলা সশক্তিকরণ ( Women empowerment)।
এই কাজ টা করতে আসার আগে প্রিয়ার আসলে কোনো ধারনা ছিল না গ্রামীণ এলাকায়,
হরিজন বস্তি তে ব্যাপারটার ঠিক কী চেহারা। রেকি করতে এসে খানিক টা ধারনা
হয়েছিল এনজিওর কর্ণধার সুনীতার সাথে কথা বলে। সুনীতার বাড়ি মুঘল সরাই থেকে
আরো দশ কিলোমিটার ভিতরে এক গ্রামে। সুনীতা চতুর্বেদী। প্রবল প্রতাপ
ব্রাহ্মণ পরিবারের বাড়ি পালানো মেয়ে। সোশিয়লজি নিয়ে বেনারস হিন্দু
ইউনিভার্সিটি থেকে অনার্স করার আগে থেকেই পিতাজী, দাদাজী বিয়ের জন্য পাত্র
খোঁজাখুঁজি শুরু করেছিলেন। অগত্যা পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর আর অপেক্ষা না করে
সোজা বড়ে ভাইয়ার বাইক নিয়ে চম্পট। ভাগ্যিস বড়ে ভাইয়া বোনের প্রেমে অন্ধ
ছিলেন তাই আরেকটি অনার কিলিং থেকে উত্তরপ্রদেশ বেঁচে যায়। পিতাজী, দাদাজী
সুনীতা কে ত্যাজ্য করেছে, যে ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে দিন রাত চামার-হরিজন
দের সাথে ওঠা বসা করে তার সাথে সম্পর্ক রাখতে লজ্জা হয় তাঁদের। এটা অবশ্য
সুনীতার বড়ে ভাইয়ার বুদ্ধি, আদরের একরোখা বোনের প্রাণ বাঁচাতে। তার পর
সুনীতার যাত্রা শুরু হয় এই এনজিও নিয়ে। ইউনিভার্সিটি তে পড়তে কাজল দিদি
এসেছিলেন, এক বিখ্যাত ফান্ডিং সংস্থা থেকে বেনারসের গ্রাম এলাকায় পিছড়ে
বর্গ কি মহিলা দের নিয়ে কাজ করতে। বিষয় - মহিলা সশক্তি করণ, অর্থাৎ women
empowerment ইন রুরাল এরিয়া। তার কথা শুনে সমাজ বিদ্যার সেরা ছাত্রী টির
মনে হয় শাদী, বাল-বচ্চার চেয়েও বেশী প্রয়োজন তার এই সংগঠনটি। তার পরেও বছর
১৫ র লড়াই আছে তার। এই মুহূর্তে বেনারসের আশেপাশে চল্লিশটি গ্রামে দশ
হাজার সদস্য মহিলা জাগরণ মঞ্চর। রাস্তা সহজ ছিলনা, টুকরোটাকরা গল্প শুনে
প্রিয়ার মনে হয় এই মহিলা কে নিয়েই আস্ত একটা সিনেমা তৈরি করা যেতে পারে।
তার শহুরে আপাত সপ্রতিভ ব্যক্তিত্বর অহমিকায় গঙ্গা মাইয়ার জল ঢেলে দেয় এই
বছর ছত্তিরিশের লড়াকু লৌহমানবী। রেকি করতে আসার সময় থেকেই সর্বত্র তাদের
গাড়ির আগে মাথা মুখ ওড়নায় জড়িয়ে তীব্র গতিতে বাইক চালিয়ে পৌঁছে যাচ্ছিল
সুনীতা। কী কাজ হয়েছে, ডকুমেন্টারি তে কী কী দেখানো হবে তা নিয়ে আলোচনা
করতে করতে গ্রামে ঢুকছিল তারা। অসাধারণ পি আর ভদ্রমহিলার। সামনে যেই পড়ুক
না কেন নাম জানেন তিনি। আলাপ করিয়ে দেন হরদতপুর গ্রামের রেখার সাথে। এখন
থেকে সেই বাকি সব গ্রামে নিয়ে যাবে ও আলাপ পরিচয় করিয়ে দেবে।
তিন...
রোগা
ডিগডিগে অপুষ্টি তে ভোগা রেখার সমস্ত ঔজ্জ্বল্য-আত্মবিশ্বাস চোখে। রেকি
শেষ করে ফিরে যাওয়ার পর তিন মাস পর পর তিন ধাপে শুটিং করতে এসেছে তারা। এখন
তো আরাজিলাইন ব্লকের দেওরা, জগরদেভপুর, যখিনি, বারেইনিকলা, হরদতপুর এই সব
গ্রামের মহিলা তো বটেই বাচ্চাদের সাথেও দারুণ দোস্তি হয়ে গেছে প্রিয়ার।
শুটিং চলা কালে কাজের কথার বাইরে এক মুহূর্ত ও নষ্ট করা চলে না। আলো পড়ে
আসার পর ধুলোমাখা স্বর্গীয় হাসিমুখের বাচ্চাকাচ্চা গুলোর সাথে হুটোপুটি
করতে দেখলে তখন আর সিরিয়াস ডায়রেক্টর মশাইও বকেন না, হাসি মুখে প্রিয়ার
ঘাড়ে - কোলে চাপা ছানাদের ছবি তুলেও দেন। কাজ করতে করতে এক একটা ঘটনা জানতে
পারে আর অবাক হয়ে যায় প্রিয়া, কুর্নিশ জানায় এই টিপছাপ হরিজন মহিলাদের
সাহস-শক্তি-মনের জোর ও একতা কে। এই ডিগডিগে রেখার ভিতরে এত জোর আসে কোথা
থেকে? চোদ্দ বছর বয়েসে বিয়ে হয়ে এসেছিল, দুই বাচ্চার মা। দশ বছর আগে যখন
নারী সঙ্ঘে যোগ দেয়, বর-শাশুড়ি কম বাধা দেয়নি? কী বলেছিল গো রেখা দিদি?
'সাস আউর মরদ মিলকে বহুত মারালওয়া, পতহু বাহার যাহি করিঁ তো গাঁও মে ইজ্জত
না রহিল করিঁ।' মনে মনে ভাবে প্রিয়া- বাহ রে, শহরের বনেদী বাড়ির শাশুড়ি আর
এই ছোট্ট হরিজন বস্তির আনপড় শাশুড়ি সবই তো এক। বাড়ির বউ বাইরে গেলেই মান
যায়, কিন্তু পেটালে কিছুই যায় না। ' ফির হাম বোলি যো করন সকে কর লেউ, হাম
নারী সঙ্ঘ না ছোড়িঁ। সুনীতা দিদি বহুত মদত করিল উ বখত'। নিজের বাড়ির লড়াই
সামলে আরো কতো বাড়ির লুগাই- পতহুর বুকে বল যুগিয়েছে রেখা দিদি, প্রিয়া অবাক
হয়ে শোনে। তাদের আইনি অধিকার বোধ এসেছে, এখন তারা স্যানিটারি হাইজিন বোঝে,
গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র চেনে। পুলিশ - পঞ্চায়েত প্রধান- বিডিও কারোর
চোখে চোখ রেখে কথা বলতে ভয় পায়না। নারী সঙ্ঘ করার অপরাধে এক গৃহবধূ কে বর
বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে, তাকে বলে রেখা - 'জিতনা অধিকার তোহরে মরদ কা,
উতনাহি তোহরা, তালা তোড় কে ঘর মে ঘুসবে করি। আউর মরদ হাত উঠায়ে তো বোলিঁ -
আজ তু হামকা পিট লেউ, কল হজার আউর আউরাত আকে তোহরাকো পিটিঁ তো কাইসন লাগিঁ
?' উত্তর শুনে প্রিয়া ভাবে এই একতা থাকলে থোড়েই লাগতো ফোর নাইন্টি এইট এর
কবচ! না ভয়ে নয়, পরের বার গিয়ে শুনলো এই নারী সঙ্ঘের জোরে বউ একশো দিনের
কাজ, প্রাপ্য রেশন যোগাড় করতে পেরেছেন বলে বর বাবাজী আর বাধা দেন না, গায়ে
হাত তোলা তো দূর। ' ই চালিস গাঁও মে আভি ঘরেলু হিনসা খতম দিদি।আর শহরের
ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স ?!
'গায়ে ধুম জ্বর নিয়েও রেখা
কাজে যায়, ' ই হামার পরিবার হোই গ্যাইল দিদি, ক্যাইসে হাঁথ ছোড়েঁ?' বাকি
সমস্ত গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ছে তারা।পরিবার বড় হচ্ছে...
চার...
এই
বার জমিয়ে ঠাণ্ডা পড়ে গেছে নভেম্বরেই। ভোর চারটেয় মুঘলসরাই নেমে চন্দন দার
গাড়িতে হোটেল। লাগেজ নামিয়ে ফ্রেশ হয়েই শুটিং স্পটে পৌঁছতে হবে।
সূর্যোদয়ের সময় থেকেই শট নিতে হবে। বাড়ির পুরুষ কাজে শহরের দিকে যাচ্ছে,
লাইন দিয়ে সাইকেল শহর মুখী, আর গাড়ি শহরের কোলাহল ধুলো ধোঁয়া ছাড়িয়ে ক্রমশ
ঢুকে পড়ছে দূষণ হীন সবুজের ভিতর। গ্রামের ভিতর ঢুকে দুপাশে বাজড়ার ক্ষেত
পেরিয়ে এক পরিত্যক্ত দালানবাড়ির পাশে গাছের নীচে গাড়ি পার্ক করেন
শুদ্ধাচারী ব্রাহ্মণ চন্দন দা। এনার সব কিছুতেই শুদ্ধতা খোঁজার বাতিক। চা -
পকোড়া থেকে এটিএম অব্ধি সবই বিশুদ্ধ চাই গপ্পোবাজ চন্দন দার। গাড়ি থেকে
নেমে রেল লাইন পেরিয়ে গ্রামে ঢোকার পায়ে চলা পথ। ঘুম ভেঙে সবে দিনের কাজ
শুরু করছে বাড়ির মহিলারা। এই গ্রামের সামনেকার ক্ষেত সহ পুর দুই
বর্গকিলোমিটার জায়গা শহরের এক ব্যবসায়ী কিনে নিয়ে পাঁচিল তুলে ঘিরে
দিয়েছিল। ফলে তিন কিলোমিটার ঘুরে গ্রামে ঢুকতে বেরোতে হত। বাচ্চাদের
স্কুলছুট হওয়ার সংখ্যা বাড়ছিল। অত ঘুরে গ্রামে আসাযাওয়ার কারণে এই গ্রামে
কেউ মেয়ের বিয়ে দিতে চাইছিল না। দু দিন ধরে বেনারস-গোরখপুর রাস্তা অবরুদ্ধ
করে দিয়েছিলেন মহিলা জাগরণ মঞ্চের সদস্যরা। শেষ পর্যন্ত পিছু হটে ব্যবসায়ী,
পাঁচিল ভেঙে আবার রাস্তা করে নেয় গ্রামবাসী। মহিলা জাগরণ মঞ্চের সাফল্যের
মুকুটে আরো একটা পালক যোগ হয়। কান পাতলে বুঝি শোনা যায় শত মহিলার হুঙ্কার -
"আওয়াজ দো, হাম এক হ্যায়" বা "হাম আপনা অধিকার মাঙ্গতে, নেহি কিসিসে ভিখ
মাঙ্গতে"।
পাঁচ...
আজ
শুটিঙের শেষ দিন। দুপুরের এলাহী খাওয়া রেখা দিদির ঘরে, রশুন পেঁয়াজ শুকনো
লঙ্কা দিয়ে ঢ্যাঁড়শ ভাজা, কাঁচা লঙ্কার আঁচার আর গরমা গরম রুটি।শুদ্ধাচারী
ব্রাহ্মন চন্দনদা হরিজন বস্তির খাবার তো দূর জল ও মুখে তোলেন না| দাঁতে
দড়ি দিয়েই বসে থাকেন, আবার একথা ডিরেক্টর জানলে রাগারাগী করবে তাই তার জন্য
লুকিয়ে আনা বিস্কিটের প্যাকেট চুপিচুপি হাতে দিয়ে আসে প্রিয়া, চন্দনদা
লাজুক হাসে, ক্যা করে দিদি, অচ্ছুত কর দেঙ্গে জাতবালে হামকো| গাছের ছায়ায়
পাতা দড়ির আধ ভাঙা খাটে শুয়ে ঝিরঝিরে হাওয়ায় চোখ লেগে আসছিল প্রিয়ার। ডাক
এলো, আজ কিশোরী দের খোখো খেলার শুট আছে। শরীর চর্চা দূর, লোকের সামনে
বেরোতেই লজ্জায় গুটিয়ে যেতো এই মেয়ে গুলি। ফুল হয়ে প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই
বিয়ে, বছর ঘুরতে কোলে একটি বাচ্চা। পড়াশুনো শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়ানো
দুঃস্বপ্ন ছিল। আজ এই মেয়ে গুলই জোর গলায় অ্যায়লান করে - পুলিশ হতে চাই,
স্কুলে পড়াতে চাই, সমাজ সেবী হতে চাই - এমনকি ফুটবলার হতে চাই।
কাজ
গোটানোর পর সব চেনা মুখ গুলোর চোখ ছলছল। টুকটুক নামের পুচকি মেয়ে এক থোকা
টগরফুল এনে প্রিয়ার ঝুঁটি তে গুঁজে দিল। দ্রৌপদী জড়িয়ে ধরলো, ঝাপসা চোখে।
'ফির কব আয়িঁ পিয়া দিদি?'
- জলদি দিদি, তোহার ঘরমা রেহেন দেইঁ লাগি।
ঝরঝর
করে কেঁদে ফেলে দ্রৌপদী। এই দ্রৌপদীই এক থানায় নাম বলার পর কন্সটেবল রা
হাসাহাসি করছিল - তুহার পাঁচ মরদ? দ্রৌপদী প্রবল বিক্রমে ঘুরে গিয়ে বুক
চিতিয়ে দাঁড়িয়ে বলেছিল ' হাঁ হামার নাম দ্রৌপদী। উ নাহি জিসকা চির হরন কিয়া
থা কুতিয়া লোগ, হাম উ দ্রৌপদী - কোই হাঁথ লাগায়ে তো উওকা চিড় দেঁহি'।
আচমকা
ফোন আসে প্রিয়ার কাছে, ওদিকে সুনীতা। বলে গাড়ি নিয়ে তাড়াতাড়ি হরদতপুরের
সামনের মোড়ে পৌঁছতে। রেখার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
হুড়মুড় করে রহনা দেয় প্রিয়াদের গাড়ি। ' গিয়ে কী দেখবো? কী হয়েছে, কতটা
লেগেছে কিছুই না বলে ফোন রেখে দিল। উফফ।' ভাবতে ভাবতে স্পটে পৌঁছে দেখে
রেখা রাস্তার ধারে একটা গাছে হেলান দিয়ে বসে। পায়ে হাত, মুখ ব্যথায় বিকৃত।
পাশেই একটি বাইক উলটে পড়ে আছে আর একটি বছর বাইশ তেইশের ছেলে কে বেশ কিছু
পুরুষ মহিলা ঘিরে দাঁড়িয়ে। ছেলেটি কাঁদো কাঁদো মুখে হাত জোর করে দাঁড়িয়ে। '
গলতি হো গ্যাইল বা, আন্ধেরে মে ঠিক সে দেখ নাহি সকিঁ'। ধরাধরি করে রেখা
কে গাড়িতে তুলতে তুলতেই বাইক চালিয়ে ঝড়ের গতিতে হাজির সুনীতা। ততক্ষণে
প্রায় বিচার সভা বসে গেছে ছেলেটির। গণধোলাই আসন্ন প্রায় এমন সময় বাজখাঁই
গলায় রেখা, ' এহ, কোই হাঁথ না লগাইঁ ছোড়া কো। যা তু ঘর যা। হট যাওরে সব।'
নির্বাক -স্তব্ধ জনতার চোখের সামনে দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে ছেলেটি কোনোরকমে
বাইক দাঁড় করায়। স্টার্ট দিতে যাবে, এমন সময়ে ক্লান্ত স্বরে বলে রেখা 'আব
সাওধনি সে চলাইঁ, কিসিকো মার উর দেঁই তো পিট জাঁই, বঁচাইবাকে কোই না রহিঁ'।
গাড়িতে উঠিয়ে প্রিয়া-শমীক বুঝতে পারে ফিমার বোন ভেঙেছে। ইয়া ফুলে গেছে বাঁ
পা। কী অসম্ভব সহ্য ক্ষমতা এই মহিলার ভাবতে ভাবতে তার হাতেই অজ্ঞান হয়ে
যায় প্রিয়ার রেখা দিদি। এর পর হাসপাতাল - এক্স রে - প্লাস্টার সব কাটিয়ে হা
ক্লান্ত দল হোটেলে ফিরে আসে। পর দিন সন্ধায় ট্রেন। সকালে দল বেঁধে
হাসপাতালে যাওয়া হল। এখন জ্ঞান ফিরেছে, পায়ে প্লাস্টার - মুখে হাসি নিয়ে
সরকারী হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে রেখা দিদি। প্রিয়া সামনে দাঁড়িয়ে মাথার
চুলে হাত বুলিয়ে দিল। রুক্ষ তেল হীন চুল, ধুলো মেখে আরোও জট পাকিয়ে আছে।
কাল ছাড়বে হাসপাতাল। পা ভাঙা ছাড়া আর কোনো চোট নেই। প্রিয়া ভোজপুরীতে
জিজ্ঞাসা করলো, ছেড়ে দিলে ছেলেটা'কে, ওর শাস্তি হওয়া দরকার ছিল। অমন ভাবে
আনাড়ির মত চালাচ্ছিল, পা ভেঙে গেল, মরে গেলে কী হত? ভাবলেশহীন মুখে রেখার
উত্তর - 'হামার পিছে পুরা সঙ্গঠন রহিল বা, উকরা হাথ প্যায়ের তোড় দেইল তো
উকরা কোউন দেখিঁ দিদি? হামার তাগত হাম উসপে কাঁহে দিখাইঁ?'
ছয়...
"কখন
থেকে বলছি এবার খেয়ে নে, তা না বাপ-বেটী তে হাঁ করে টিভিতে চোখ বিঁধিয়ে
বসে পঞ্চাশ বার দেখা সিনেমাই দেখে চলেছে। " দক্ষিণ কলকাতায় নিজের ফ্ল্যাটে
খাটে পা ঝুলিয়ে বসে প্রিয়া, চোখ টিভিতে। মন পড়ে কয়েকশো কিলোমিটার দূরে
উত্তর প্রদেশের গ্রামে। আত্মীয়তা হয়ে গেছিল সরল সিধা শক্তিশালী মানুষ
গুলির সাথে। প্রথম বার বেনারস গিয়ে কোনো এক গ্রামের ঠাণ্ডা কুয়োর জল খেয়ে
ফেলেছিল। শমীক বারবার করে বলে দিয়ে ছিল বাইরের জল খাস না, পেটে সইবে না।
ঠোঁট ছুঁইয়ে রেখে দিস, হরিজন রা বাকি সমাজে জল অচল, জল না খেলে কষ্ট পাবে-
মিশবে না। কিন্তু ভরা গরমে গাড়িতে রাখা মিনারেল ওয়াটারে তৃষ্ণা মেটে না
প্রিয়ার। টলটলে ঠাণ্ডা জল দেখে লোভে পড়ে ঢকঢকিয়ে খেয়ে ফেলে সাবধান বানী
ভুলে গিয়ে। ব্যাস পরদিন কমোডের উপরেই অস্থায়ী আস্তানা। ঝাড়া উনত্রিশ বার
আসা যাওয়া করে নেতিয়ে পড়েছিল, এমন সময়ে সুনীতা এসে তাকে স্থানীয় রামকৃষ্ণ
মিশন ডাক্তার খানায় নিয়ে যায়। পাশে বসে নিজে ও আর এস গুলে খাওয়ায় আর বকা
দেয় আগে বলনি কেন? হাসপাতালে পৌঁছেই দায় সারতে পারতো। মানুষ গুলো অনেক টা
পালটে দিয়েছে তাকে, ভাবতে ভাবতে কানে চেনা আওয়াজ আসে। টিভিতে অনেকবার দেখা
স্পাইডারম্যান, চোখ - মন আটকে যায় প্রিয়ার শেষ দৃশ্যে - পিটার পার্কার মেরী
জেন কে প্রত্যাখ্যান করে চলে যাচ্ছে। মেরীর কান্না মাখা মুখ, ফোকাস
পিটারের দিকে, ক্যামেরা জুম হচ্ছে। ব্যাক ভয়েসে পিটার নিজের মনে - "গ্রেট
পাওয়ার কামস উইদ গ্রেট রেসপনসিবিলিটি......"
Post A Comment:
0 comments so far,add yours