দেবযানী ভৌমিক (চক্রবর্তী), সহকারি অধ্যাপক, কৃষ্ণনগর:

তাঁরা কেউ স্বনামে পরিচিত নন৷ কেউ অনুষ্কার মা, কেউ জুমানের মা, কেউ বা ত্বিষার মা৷ আত্ম পরিচয় তাঁদের লুপ্ত৷ তাঁরা শুধুমাত্র কারো মা হিসেবেই চিহ্নিত ৷ তাঁদের বাইরের জগতের সংস্পর্শে আসা বলতে সন্তানকে স্কুল বা বিভিন্ন চারুকলার ক্লাসে দেওয়া নেওয়া ৷ নাহলে বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেই তাঁদের নিত্য দিন যাপন৷ কুর্নিশ এই সকল মাকে ৷

তাঁরা বাইরের জগতে আত্মপ্রতিষ্ঠিত নন৷ সংসারে তাই সর্বক্ষণের সেবাদাত্রী৷ স্প্রীং দেওয়া পুতুলের মতো নিত্য চলমান এই মায়েরা৷ একটু বসার ফুরসৎটুকু নেই৷ সাতসকালে উঠে বাড়ির বাসি কাজ সেরে পুজো দিয়ে রান্নাঘরে ঢোকা ৷ স্বামী সন্তানকে সময়মতো খাবারদাবার করে দিতে হবে যে৷ তাও কি রোজ এক খাবার করলে হবে ! তাদের তো মুখেই রুজবে না রোজ এক ডাল মাছ তরকারি ৷ তাই সেক্ষেত্রেও দস্তুরমতো গবেষণা করে ঠিক করতে হয় নিত্য নূতন রেসিপি৷ আর বাচ্চার স্কুলের টিফিন,--- মুখরোচক না হলে তো বাড়িতে ফেরৎ নিয়ে আসবে৷ মা হয়ে কী করেই বা সহ্য হয় বাছার এতটা সময় অনাহার ৷ তাই রোজ রোজ টিফিন নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা ৷ সেক্ষেত্রে আবার কিছুটা স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতাও চলে যে৷ কোন্  মা কতটা ভালো টিফিন বানান তা নিয়ে বাচ্চাদের নিজেদের মধ্যেও একটা লড়াই চলে ৷

তারপর সন্তানকে তৈরি করে স্কুলের পথে রওনা৷ কেউ কেউ অবশ্য নিজেই স্কুটিতে চড়িয়ে বাচ্চাকে নিয়ে যান৷ কিন্তু সবার তো আর স্কুটি বা নিজস্ব গাড়ি ঠিক করা থাকে না৷ কাজেই বাড়ি থেকে বেরিয়েই গাড়ি খোঁজা ৷ ঘর্মাক্ত মা তাঁর এক হাত দিয়ে বাচ্চার হাত ধরেন; আর এক হাতে সন্তানের স্কুল ব্যাগ , টিফিন ব্যাগ ৷ আচ্ছা এই মায়েদের কি দুইয়ের বেশি হাত থাকে ! নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সন্তানকে স্কুলে পৌঁছে দেওয়াটাও একটা রোজকার উদ্বেগ৷ যদিও ছেলেমেয়েরা স্কুলে ঢুকে গেলে মায়েদের কিছুটা মুক্তির আকাশের সন্ধানলাভ৷ 'ওলো সই, ওলো সই' --- পরস্পরের কাছে মায়েদের চলে মনের ভাব বিনিময়ের এক অনাবিল আনন্দের আস্বাদন ৷ বুক ভরে শ্বাসগ্রহণ৷ তবে খুব বেশি সময় এখানেও কাটানো যাবে না৷ বাড়িতে যে অনেক কাজ পড়ে থাকে৷

মায়েরা আবার রওনা হন বাড়ির পথে৷ বাড়িতে ফিরেই অসুস্থ শ্বশুর শাশুড়িকে দেখাশোনা৷ অনেকের অবশ্য আয়া রাখার সামর্থ্য থাকে  ৷ কিন্তু আয়াকে নির্দেশ দিয়ে কাজ করানোটাও তো একটা বড় কাজ৷ শুধু তাই নয়, রান্নাঘরের অসমাপ্ত কাজটাও তো সারতে হবে৷ তারপর ঘরে ঢুকে বিছানাপত্র পরিপাটি করে ময়লা জামাকাপড় কাচার জন্য দেওয়া৷ কাজের বৌ করলেও অনেক সময়ই নিজেকেই করে নিতে হয় ৷ সংসারের বর্ণমালা সুছন্দে গেঁথে তোলার কৃতিত্ব পুরোটাই  এই সকল গৃহবধূরই ৷যাঁরা সংসারে পূর্ণ সময়ের কর্মী৷ কিন্তু যেহেতু সে শ্রম কোনও পারিশ্রমিক দাবি করতে পারে না তাই তার মূল্য এই সংসার সমাজ কখনই দেয় না৷ এমনকি সংসারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারীও  তাঁরা নন৷

কথা বলে জানা গেল বেশ কিছু এমন নারীর জীবনের কথা৷ তাঁদের বর্তমানটা জুড়ে সংসার সন্তান থাকলেও মনের গভীরে কোথাও একটা চিনচিনে ব্যথা তাঁরা অনুভব করেন সর্বদা৷ নিজেদের জীবনের পরম স্বপ্নকে নির্বাসনে পাঠিয়ে সংসারের ঘানি টানছেন৷ কথা হচ্ছিল শমিতা রায়ের সঙ্গে৷ মস্ত এক সরকারি চাকুরের ঘরণি তিনি৷ ছেলেকে নিয়েই তাঁর সারাদিন ব্যস্ততা ৷ এছাড়া সংসারের অন্যদিকগুলো সামলানো তো আছেই৷ পড়াশুনায় অত্যন্ত মেধাবী  ছিলেন৷ এছাড়া অসাধারণ কথ্থক নাচতেন৷ বিয়ের পর সব গেছে৷ চাকরি করতে নিজেও চাননি ৷ কিন্তু নাচটা বড়ই ভালবাসতেন৷ 'ছেলে হওয়ার পর আর শুরুই করা গেল না নাচটা'৷ কথায় হতাশার সুর স্পষ্ট৷ শমিতা নাকি চেয়েছিলেন তাঁর মেয়ে হোক, তাহলে মেয়ের সঙ্গে তাঁরও নাচটা আবার শুরু হবে৷ সে আশাও অপূর্ণ রইলো৷ তবু ছেলেকে ভবিষ্যতে বড় ডাক্তার বানানোর আশায় বুক বেঁধেছেন তিনি৷

সুস্মিতা বিশ্বাসের কথা শুনে বড়ই কষ্ট পেলাম৷ তাঁকে নাকি শ্বশুরবাড়ির চাপেই শিক্ষকতার চাকরি ছাড়তে হয়েছিল৷ কি না বৃদ্ধ শ্বশুরকে কে দেখভাল করবে, ও বাড়ি থেকে বেরোলে? ওঁ বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান৷ সুস্মিতার সাহচর্য তথা আর্থিক সহায়তা তাঁদের খুবই প্রয়োজন৷ কিন্তু বিয়ের পরই সঞ্জয় প্রেমিক থেকে যে এভাবে প্রভু বনে যাবেন ওঁ ভাবতেই পারেননি৷ এরপর মেয়ের জন্মের পর থেকেই ক্রমশ নিজের বাবা মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ কমেছে৷ মাত্র এক বছরের ব্যবধানে তাঁরাও চলে গেলেন৷ মেয়ে হয়ে কিছুই করতে পারলেন না৷ এই যন্ত্রণা ওঁকে কুড়ে কুড়ে খায়৷ কিছুদিন হল কবিতা লিখে ওর বেশ সুনাম জুটছে৷ তাতেও সঞ্জয়ের প্রবল ঈর্ষা৷ আর তা থেকেই যত ঝামেলা৷ মেয়ের মুখ চেয়ে সবই নীরবে সহ্য করতে হচ্ছে তাঁকে৷ না হলে যে ওঁর যাওয়ারও কোনও জায়গা নেই৷ সারাদিন মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ততা ছাড়াও বৃদ্ধ শ্বশুরের সেবা যত্ন করে চলেছেন ঠাণ্ডা মাথায়৷ সব সামলে সম্ভব হলে সাহিত্যসভায় যান৷

অসাধারণ গানের গলা ছিল বনানীর৷ বনানী মুখোপাধ্যায় ৷ এখন যদিও শুধুই রাজীবের মা হয়ে বাঁচা ৷ জীবনসঙ্গী ত্রিদিব ওঁকে গানটা ছাড়তে বারণ করেছেন বারবার৷ কিন্তু এই বড় পরিবারে বৌ হয়ে এসে সবার মন যোগাতে যোগাতে নিজের ভালবাসার বিষয়টাই হারিয়ে গেছে জীবন থেকে৷ আগে অনেকখানি এগিয়ে ছিলেন বলে বিনা রেওয়াজেই অনায়াসে গান গাইতে পারতেন কারো অনুরোধে৷ কিন্তু সেভাবে তো আর প্রতিষ্ঠা পাওয়া যায় না৷ অথচ তাঁর গুরুজি চেয়েছিলেন তিনি সঙ্গীতকেই আশ্রয় করুন৷ সে আর হল কই ! ত্রিদিব ছাড়া আর কেউ গানটা বজায় থাকুক চাননি৷ তার ওপরে ত্রিদিবের দূরে দূরে চাকরি৷ সন্তানকে নিয়ে বনানী শ্বশুরবাড়িতেই থাকেন৷  রাত থাকতেই তাঁর দিন শুরু হয়ে যায়৷ সারাদিন সংসারের কাজের পরেও ছেলেকে নিয়ে দৌড়োদৌড়ি৷ গান তাঁর গলায় আর আসে না খুব একটা৷ 'গানের কত পুরস্কার আমার বাপের বাড়িতে রয়েছে, কেউ বিশ্বাসই করবে না ওগুলো আমার পাওয়া' ! গলায় আক্ষেপের সুর ঝরে পড়ে ওঁর৷

সংসারের এহেন দুগ্গাদের ঋণ শোধ করা দূরের কথা, সংসার বরং তাঁদের সহজলভ্য শ্রমকে স্বাভাবিক প্রাপ্তি বলেই ধরে নেয়৷ কৃতজ্ঞতা দূরে থাক,কথায় কথায় তাঁদেরই অবমাননা করে৷ হাসিমুখে তাঁরাও মেনে নেন জীবনের অপ্রাপ্তিগুলোকে৷ তাঁরা তাঁদের সন্তানের মধ্যেই সুখ ও  তৃপ্তি খোঁজেন৷ নিজের জীবনের চূড়ান্ত স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটাতে চান পরবর্তী প্রজন্মের মধ্য দিয়ে৷ তাই  নিজেদের বর্তমানকে তাঁরা নির্দ্বিধভাবে সঁপে দেন সংসার ও সন্তানের উন্নতিতে৷ এইসব মায়ের জন্যই আজও পৃথিবীটা সুন্দর৷ আন্তরিক শ্রদ্ধা তাঁদের৷
 
 
 
 
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours